সাজ্জাদ আলী : এক:
কথা একেবারে পাকা করে নিয়েছি। তার লাউয়ের জাইংলা (মাচা) বানায়ে দেবো। বিনিময়ে ফলনের আধাআধি ভাগ দেবে। স্বভাবে সে চতুর, সহজে কি রাজি হয়! কাজটুকু ফাও ফাও করায়ে নেবার সব রকমের ফন্দিই এটেছিলো! গত ৪টি গ্রীস্মে তার লাউগাছ জাইংলার অভাবে মাটিতে লতিয়েছে। বড় বড় পাতা হয়, কিন্তু লাউয়ের জালিগুলো মাটির ছোঁয়ায় পচে যায়। জাইংলা বানানোর কাজটা আমার জন্য কঠিন কিছু না। গাঁয়ে বড় হওয়ার সুবাদে ওসব কায়দা-কানুন জানা আছে। শৈশবে দাদীর বাড়িতে ঈমান দাদা আর পাচু ভাইকে মোটা মোটা পাটখড়ি দিয়ে জাইংলা বানাতে দেখেছি। বাঁশের খুঁটির উপর বিছানো, খড়ির বোনা সেই মাচায় দাদী গাছের আগাগুলা তুলে দিতেন। আকর্ষী দিয়ে খড়ি পেচিয়ে ধরে গাছগুলো বেড়ে চলতো। থরে থরে কদু ঝুলতো সেই জাইংলায়। চোখের সামনে আজো তা ভাসে।

কোনো রকমের চুক্তিতে না আসার জন্য কত যে যুক্তি তার! আল্লাহ মাবুদ, রহম করো! বলে কিনা,
জমি আমার ব্যাকইয়ার্ডে, চাষী আমি, গাছে পানি দেবো আমি, চারা আমার, গাছের যতœআত্তি আমারই করা লাগবে; আপনি খালি জাইংলা বানাবার জন্যি অর্ধেক ভাগ চান কোন আক্কেলে? এ কোন বিচার?
ও সেই কথা? আচ্ছা, তাইলে মনে কইরা দেখেন তো, ৩ বছর আগে আপনারে গাছ লাগানোর জন্য গর্ত খুইড়া দিছিলাম। সেই বছরেই গাছের পাতায় পোকা লাগলে শত মাইল দূরের নার্সারীতে গিয়া অরগানিক সার আইনা দিছিলাম। আর গত বছর লাউয়ের চারা আনতে আপনারে রাজধানী শহর অটোয়ায় গাড়ি দাবড়াইয়া নিয়া গিছিলাম। এত্তগুলান কাজের কোনোই বিনিময় দ্যান নাই। কন তো, সেইগুলান কোন বিচার ছিল?
ফুঁসে উঠলো যেন! গাছে তো লাউ ধরেই নাই! তার আবার বিনিময় কী?

লাউ হয় নাই বইলা কি আমার ‘খাটুনি’ কদর পাবে না? আর ওই তুচ্ছ লাউ নিয়া কে ভাবতেছে? আপনি তো অপরূপ সৌন্দর্যের গোলাঘর, সেখানটায় দুদন্ড বসতে দিলেই তো আমার ঘটি উপচে পড়তো!

উপচে পড়বে কী করে? আপনার ঘটির তো তলা ফুটা! আইজ দিলে কাল শ্যাষ, আবার হাত বাড়ান। নইলে জীবনের উজান ঠেইলা আপনার ঘটিতে যতটা রস ঢালছি, সে কি কম কিছু?
যাই হোক, এত সব ঝগড়া-তর্কের পরে ঠিক হয়েছে যে, তার লাউয়ের ফলনের অর্ধেক পাবো। তবে লাউ-পাতার কোনো ভাগ দেবে না। বন্ধুত্বের খাতিরে আমি তাই মেনে নিয়েছি। এখন লাউ ধরলে হয়, আর সে কথা রাখলে হয়।

জুন, জুলাই ও আগষ্ট এই তিন মাস কানাডায় সব্জী ও ফুলের বাগান করার মতো আবহাওয়া থাকে। এর আগে-পরে ঠান্ডায় গাছ বাঁচে না। কানাডার মাটির গুণ আছে, গাছের একটু যতœ করলেই প্রচুর ফল ধরে। আর ফুল গাছে থোকা থোকা ফুল ফোটে, যদিও অধিকাংশের কোন সুবাস নেই! এই ৩ মাস সময়ে বাঙালিরা দেশি সব্জী ও ফুলের বাগান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

দুই:
সেদিন আমাদের ঈশিতা ৭টা গ্যান্দা ফুলের চারা দিয়েছে (গাদা ফুল)। বিশেষ এই ফুলটির সাথে শৈশব স্মৃতি জড়িয়ে আছে। হাইস্কুলে আমার সহপাঠি বুলিদের পালানের গ্যান্দা ফুলগুলো ছিল দশ গাঁয়ের মধ্যে সেরা। কত বর্ণের ফুল যে ফুটতো! হলুদ গ্যান্দা, থোকা গ্যান্দা, রক্ত গ্যান্দা ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সৌন্দর্যের বিবেচনায় সেগুলো ছিলো প্রায় বুলির সমকক্ষ। একদিন বাদে একদিন ওদের বাড়িতে ফুল আনতে যেতাম। এই ঘন ঘন যাওয়ায় সে মুখ টিপে হাসতো। কি জানি হয়তো বা গমনের নেপথ্য কারণ সে আন্দাজ করতে পেরেছিল। আজ ক’যুগ পরেও বুলির সেই হাসিটি মননে দাগ কেটে আছে, ভুলতে পারি না কিছুতেই।

গত বছরে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরের গ্রামে গিয়ে এক ক্যালকেশিয়ান বন্ধুর বাড়ি থেকে ঈশিতার জন্য গ্যান্দা ফুলের বিচি জোগাড় করেছিলাম। সে ভাল মালিনী, গত সিজনে তার গাছে গোটা বিশেক ফুল ফুটেছিল। কি মস্ত সাইজের ফুল রে বাবা! বুলিদের ফুলের দুটোর সমান একটা। এ বছরে ঈশিতা-মালিনীর ফুলের বাগানে ফুল ফোটার অপেক্ষায় আছি। এই সাথে কিছু সব্জীর গাছও তাকে মাটিতে পুঁততে বলেছিলাম। বললো, দরকার নাই, শামস টিপে-বেছে ফ্রেস তরকারী কিনতে পারে। অগত্যা চুপ হয়ে গেলাম। ঈশিতার মুখে শামসের
তারিফ বলে কথা!

তিন:
ক’দিন আগে বন্ধু-দম্পতি আমিন-রওশনদের বাড়িতে বারবি-কিউ মেশিনে মাংস পোড়ানো খাওয়ার নিমন্ত্রণ ছিল। ওদের সাহস আছে বটে! এই করোনাকালে কেউ কাউকে বাড়িতে ডাকে নাকি? ড্রাইভওয়ে পেরিয়ে সোজা ব্যাকইয়ার্ডে ঢুকে দেখি পাঁচিলের পাশ দিয়ে মাটি কুপিয়ে গাছগাছালি লাগিয়েছে। টমেটোর চারাগুলো ন্যাতানো, যেন মাজা সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। বেগুনের চারাগুলো মরি মরি করছে। একটা লাউ গাছ পাঁচিলের গা বেয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। এক কোণে শশা ও ঢেঁড়সের গাছও দেখলাম মনে হয়। মোটাদাগে ওদের ব্যাকইয়ার্ডের গাছগুলোকে পুষ্টিহীনই বলতে হবে। এই দম্পতির বাগান বিলাস যত তীব্রই হোক না কেন, কাজটিতে তাঁদের দক্ষতা প্রশ্নবোধক।

জীবনের চলার পথে কখন যেন ওদের আমার পছন্দের আসনে বসিয়েছি। পরিচয়ের সূচনায় ভদ্রমহিলাকে আমি ‘আপা’ ডাকতে শুরু করেছিলাম। একদিন তিনি জানতে চাইলেন, অন্য বন্ধুরা সবাই আমাকে ‘ভাবি’ ডাকে। আপনি কেন ‘আপা’ বলেন?

সম্বোধন বড় কোনো ব্যাপার না গো বোন। একটা কিছু ডাকলেই হলো। তবু আপনি যখন ব্যাখ্যা চাইছেন, তো বলছি। ‘ভাবি’ ডাকলে মনে হয় যেন কারো বউকে ডাকছি, ব্যক্তিটি গৌণ হয়ে পড়ে। আর আপা বা বোন ডাকলে যেন সরাসরি ওই মানুষটিকেই ডাকলাম।
তবে আমার ব্যাখ্যা কাজে আসেনি। সে তার জানের-জান পারাণের-পরাণ “আমিনের বউ” হয়েই থাকতে চায়। যাই হোক, ভদ্রমহিলা তাঁর বাগানের সব ধরণের গাছ ঘুরিয়ে দেখালেন। একটা চেরি গাছ দেখিয়ে বললেন, এটা গত বছর লাগানো হয়েছে। এর ৫টা ডালে ৫ রংয়ের চেরিফল ধরার কথা। তবে গত শীতে ২টা ডাল মরে গেছে। এখন দেখা যাক বাকি ৩ ডালে কয় রংয়ের চেরি ফলে। একপাশে দেখি বোম্বাই মরিচ গাছে থোকা থোকা মরিচ ধরে আছে। একেবারে টসটসে সজীব সে মরিচগুলো। সারা ব্যাকইয়ার্ডের অন্য সব গাছগাছালি যেখানে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত, সেখানে এই বোম্বাই মরিচগুলো দেখে ভারি আনন্দ হলো।
মরিচগুলো নেড়েচেড়ে দেখছি আর বাগান-মালিকের প্রশংসা করছি। তিনিও নীরবে শংসাবাক্যগুলো গিলছিলেন। বললাম, কোন একটা মরিচ যদি বতি হয়ে থাকে তো মাংস পোড়ার সাথে খেতে চাই। সাথে সাথেই ভাবি ঢাউস দেখে একটা মরিচ ছিঁড়ে নিয়ে বারবি-কিউ মাংস উল্টে দিতে গেলেন। মেশিনের ডালা খুলতেই পোড়া মাংসের গন্ধে ব্যাকইয়ার্ড ময় ময়, পেটের ক্ষুধা দ্বিগুণ বাড়লো। আমি এসে আমিন ভাইয়ের পাশের চেয়ারে বসতে বসতে মরিচ চাষীনির কীর্তন গাচ্ছিলাম। ভাই মুচকি হেসে বললেন,
পেছনের ‘ইতিহাস’ তো জানেন না, তাই ‘ভুগোল’ আউড়ে যাচ্ছেন।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম ওর দিকে…..
মরিচ ধরা গাছই নার্সারী থেকে কিনে এনে দুদিন আগে লাগানো হয়েছে। তবে একথা কিন্তু আমি আপনাকে বলি নাই, আর আপনিও শোনেন নাই! শান্তি-রক্ষা অবশ্য-কর্তব্য!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)