অনলাইন ডেস্ক : কোটা সংস্কার ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতির প্রভাব প্রবাসী আয়েও পড়েছে। গত সপ্তাহের ছয় দিনে দেশে যে পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছে, তা এর আগের এক দিনেরও কম। চলতি সপ্তাহেও প্রবাসী আয় কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মূলত শিক্ষার্থীদের ওই আন্দোলনক কেন্দ্র করে গত কয়েক দিনে সংঘটিত সহিংসতা, মৃত্যু, কারফিউ জারি ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এর অংশ হিসেবে দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠানোর বিষয়ে ক্যাম্পেইন করছে প্রবাসীদের একটি অংশ। এমন পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমার সম্ভাবনা থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দরে রেমিট্যান্স কেনার জন্য ব্যাংকগুলোকে মৌখিকভাবে নির্দেশনা দিয়েছে। এ ছাড়া গত শনিবার প্রবাসীদের বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় চলমান গুজব ও অপপ্রচার বিশ্বাস না করার আহ্বানও জানিয়েছেন।

বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ গত ৮ মে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ পদ্ধতিতে ডলারের মধ্যবর্তী দর এক লাফে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। নতুন রেট চালু করার পর ব্যাংকগুলো প্রতি ডলারে সর্বোচ্চ ১১৮ টাকায় ডলার সংগ্রহের সুযোগ পেত। গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশের পর বেশ কয়েকটি ব্যাংক প্রতি ডলার ১১৮.৫০ টাকা থেকে ১১৮.৭০ টাকায় অফার করে রেমিট্যান্স সংগ্রহের চেষ্টা করে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে বেশি দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করার জন্য মৌখিকভাবে বেশকিছু ব্যাংকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে যারা রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ পায়, এমন ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, রেমিট্যান্স সংগ্রহে ডলারের দাম বাড়ানো নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা সম্পর্কে তার কাছে কোনো তথ্য নেই। দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে হুন্ডিতে পাঠানোর বিষয়ে ক্যাম্পেইন করছে প্রবাসীরা। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমার শঙ্কা দেখছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগামী এক সপ্তাহ পর বুঝা যাবে রেমিট্যান্স কমবে কিনা। তবে যারা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠান, তারা হুন্ডিতে পাঠাবেন বলে মনে হয় না। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।

এ বিষয়ে বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, আমরা ইতোমধ্যেই রেমিট্যান্স সংগ্রহের জন্য ডলারে দর বাড়িয়েছি। কারণ গত এক সপ্তাহ ধরে ইন্টারনেট বিভ্রাটের কারণে কাক্সিক্ষত রেমিট্যান্স টানা সম্ভব হয়নি। এখন দর বাড়িয়ে রেমিট্যান্স বাড়ানোর চেষ্টা করছি। কারণ আগামী দিনে ডলারের দর আরও বাড়তে পারে।

দেশে দীর্ঘদিন ধরে ডলার-সংকট চলছে। এ সংকট কাটাতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে ডলারের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে আগের তুলনায় তদারকি কমানো হয়েছে। পাশাপাশি যে কোনো ধরনের অর্থ বৈধপথে দেশে আনার ক্ষেত্রে যে নিয়মকানুন রয়েছে, তা শিথিল করেছে। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে প্রবাসী আয়ে। সর্বশেষ জুন মাসে রেকর্ড ২৫৪ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসে, যা ছিল ৪৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রবাসী আয়ের এই গতি গত ১৮ জুলাই পর্যন্ত মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল। তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতা বেগবান হওয়ার প্রেক্ষিতে ১৮ জুলাই রাত থেকে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা হয়। পরদিন ১৯ জুলাই শুক্রবার রাত থেকে কারফিউ জারি করে সরকার। এরপর রবিবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ ছিল। ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় ব্যাংকের অনলাইন লেনদেনও বন্ধ ছিল। কয়েক দিন লেনদেন বন্ধের পর ২৪ জুলাই সীমিত পরিসরে ব্যাংক চালু হয়। ওই দিন লেনদেন চলে বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত চার ঘণ্টা। ব্যাংকিং কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ১৯ জুলাই থেকে ২৩ জুলাই বৈধ পথে তথা ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে প্রবাসী আয় আসাও সম্ভব ছিল না। এ সময়ের মধ্যে যারা বিদেশ থেকে প্রবাসী আয় পাঠিয়েছেন, গত বুধবার ব্যাংক খোলার প্রথম দিনেই তা দেশের ব্যাংকে জমা হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু সেটি হয়নি। এ কারণে গত সপ্তাহে প্রবাসী আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে ১৯ থেকে ২৪ জুলাই রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার। এর আগে ১ থেকে ১৮ জুলাই এসেছিল ১৪২ কোটি ২০ লাখ ডলার। এর মানে, প্রথম ১৮ দিনে দৈনিক গড়ে ৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। এ ধারা বজায় থাকলে জুলাই মাসে ২৪৫ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসত। ডলারের দর বাড়ানোর পর গত মে মাসে ২২৫ কোটি ডলার এবং জুন মাসে ২৫৪ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আসে। পরপর ওই দুই মাসের রেমিট্যান্স ছিল একক মাস হিসাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বশেষ ২০২০ সালের জুলাইয়ে ২৫৯ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছিল। সংশ্লিষ্টরা জানান, পাঁচ দিনের জন্য ইন্টারনেট সেবা না থাকায় ব্যাংকের পাশাপাশি মোবাইল আর্থিক পরিষেবা (এমএফএস) মাধ্যমে রেমিট্যান্স সংগ্রহকে প্রভাবিত করেছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, রেমিট্যান্স পাঠানো হয় প্রধানত পরিবারের প্রয়োজনে। ফলে সংঘবদ্ধভাবে অনেক দিনের জন্য মানুষ রেমিট্যান্স পাঠাবে না, কিংবা হুন্ডি করবে তা বাস্তবসম্মত নয়। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে জাতিসংঘ যদি তদন্ত করে কোনো ব্যবস্থা নেয়, তখন বিদেশি ঋণ ও অনুদান বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকও সরে দাঁড়াতে পারে।

এদিকে গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে প্রবাসীদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়ানোর অনুরোধ করে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, আমাদের দেশের যত সম্পদ, আমাদের সরকারের যত অবকাঠামো এগুলো কিন্তু আপনাদের রেমিট্যান্সের টাকা, দেশের কৃষক, শ্রমিক এবং ব্যবসায়ীর ট্যাক্সের টাকায় তৈরি। তিনি আরও জানান, যারা রেমিট্যান্স পাঠানোর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছেন তারা যদি টানা ৬ মাস রেমিট্যান্স না পাঠান বা বৈধ পথে না পাঠান তবে আমাদের দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষতি হবে।