হোসনে আরা মণি : হোসনে আরা মণি-র জন্ম ও বেড়ে ওঠা হিমালয় থেকে নেমে আসা উন্মুক্ত, অমলিন মধুমতি-ফটকি-গড়াই-নবগঙ্গা-চিত্রার কল্লোলিত স্রোতধারায় বাহিত পলি মাটিতে। বাবার এবং নিজের চাকরির সুবাদে বাস করেছেন রাজধানীসহ দেশের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে। তাই তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাস পড়লে আমরা দেখতে পাই স্মৃতি-বিস্মৃতির বাতায়ন ঘুরে তিনি কাহিনির পারম্পর্য তুলে এনেছেন তাঁর দেখা সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জীবনবোধ থেকে। একবিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে মানুষ মননশীলতা ও মানবিকতার যে খরায় পড়েছে তা থেকে উত্তরণের জন্য চাই মনোজাগতিক পরিবর্তন। হোসনে আরা মণি তাঁর উপন্যাস প্রবহমান- এ মানবমনের এই নিগুঢ় সংকট নিয়ে ব্যতিক্রমী কাজ করেছেন: তুলে এনেছেন মানবিক ও মানবীয় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, পূর্ণতা-অপূর্ণতা, আকাক্সক্ষা-দুরাকাক্সক্ষার কথা, রাজনীতি-সমাজ-সংসারের অগ্রন্থিত কাহিনিমালা। আজকের বাঙলা সাহিত্য প্রেম-পরিণয়, দারিদ্র্য-ক্ষুধা, আকাক্সক্ষা-অনাচার বা সমাজ-সভ্যতার ছকবাঁধা ও কষ্টকল্পিত কাহিনির পৌনঃপুনিকতায় কিছু মাত্রায় আক্রান্ত। জীবনের চিরচেনা নিবিড় আখ্যান বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্যে বিরল না হলে সংখ্যায় লক্ষণীয়ভাবে কম। বিপরীতে আঙ্গিকের ভিন্নতা, নৈর্ব্যক্তিক ব্যঞ্জনা, পটভ‚মি, চরিত্র চিত্রণ এবং কাহিনি বিন্যাসে ভাবাবেগহীন স্বতঃস্ফূর্ততা হোসনে আরা মণি-র এই উপন্যাসটিকে স্রোতস্বিনীর মতো প্রবাহিত হতে দিয়েছে। তাঁর এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো ‘হাজার বছর ধরে’ নিজেদের মতো বাংলার শ্যামল প্রান্তর জুড়ে হেঁটে চলে। দিন শেষে পাঠকই বিচারক। সম্পাদক হিসেবে তাঁদের কাছে ‘বাংলা কাগজ’-এর এই নতুন ধারাবাহিক উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
মনিস রফিক, সম্পাদক

(৯)

‘মাইয়েরে কি তুমি জজ-ব্যারেষ্টার বানাবা বৌ?’
ওপাড়ার ফালুর দাদীর মুখ বাঁকায়ে করা প্রশ্ন। ফালু আলতার সাথে পড়ে।
হিরণবালার হয়ে কথার জবাব দেয় আবদুর রউফের মা। ঢেঁকিশালে আতপ চাল কুটতে কুটতে একথা সেকথায় এসে পড়েছিল ইশ্কুল-মাস্টার-পড়া প্রসঙ্গ। ফালুর দাদী পাড়াবেড়ানি। পাড়া বেড়াতেই সে আসছে মিঞাবাড়ি। চমক লাগানো গল্প ঝাড়তে ফালুর দাদীর জুড়ি নেই। নানা ঘরের হাঁড়ির কথাও তার ঝুলিতে বিস্তর। কার ব্যাটার বৌ শাউড়ির সাথে গাছকোমর বেঁধে কোন্দল করে, কোন মাগী ব্যাটার বৌয়েরে ভাত দেয়ার আগে পেট পুরে পানি খাওয়ায় নেয়, কোথায় কোন ঠাকুরের বিধবা মাইয়্যে ছয় মাসের প্যাট খালাস করতে যেয়ে মর মর, পাড়ায় কার বিবি কার সাথে আশনাইয়ে মত্ত- এসব তার নখের আগার খবর। কাজেই ফালুর দাদীর কথার জবাবে মুখ খোলা হিরণের সাধ্যি নয়। আবদুর রউফের মা বয়সে ফালুর দাদীর কাছাকাছি, বংশীয় সম্পর্কে সে হিরণের বড় জা। আকিমনের কাছে পান খাওয়ার নামে বেড়াতে এসে সে বসে গিয়েছিল চাল কোটার কাজে হাত লাগাতে। চালের আটা টেকতে টেকতে সে বলে, ‘জজ-ব্যারেষ্টার কী কও বুজি, আলতা মা আমাগার হাউশ করে ইশ্কুলি যায়। আর কয়দিন বাদে তো বিয়ে হয়েই যাবি। যদ্দিন তা না হয় তদ্দিন ইশ্কুলি গিলি এট্টু চোখ-কান ফুইটলে চিঠি-পত্তরডা যদি পড়তি শেহে…….’
‘কিডা তুমাগেরে অত চিঠি-পত্তর ল্যাহে? আর বাড়ির মিনসেরা কি পত্তর পড়তি পারে না?’

তাতো পারেই। মিঞা বংশের প্রায় সব পুরুষই লেখাপড়া জানেঅলা। শুধু আঞ্চলিক পাঠশালা-ইশ্কুলেই তাদের পড়াশুনো নয়, কোথায় কোন মহকুমার কী এক কলেজে এ বংশেরই একজন এফ এ না কী জানি পড়তে যেয়ে শেষে ফিরে আসছিল মাথা খারাপ হয়ে। লোকটা সারাক্ষণ নাকি মাথা হাঁটুর মাঝে গুঁজে দিয়ে বিড়বিড়িয়ে কী সব বকতো। সম্পর্কে নাকি তিনি হিরণের ভাসুর হতেন। তা হিরণ তারে দেখতে পায়নি। হিরণের বিয়ের তিন মাস আগে তিনি একদিন পুকুরে একা একা নাইতে যেয়ে আর ওঠেননি। আর হিরণের এক চাচাত দেওর মাহতাব উদ্দিন, সে তো বর্তমানে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র। সেখান থেকে উলা পাশ করে তবেই ফিরবে। দুই ঈদ ছাড়া আর কোন পরবে তার দেখাই পাওয়া যায় না। কাজেই ভাতুরিয়ার মিঞা বংশ কোনভাবেই গ্রামের মোল্লা, মৃধা, মিনা, বিশ্বাস ইত্যাদি বংশের তুল্যি নয়।
শ্বশুরের বংশ নিয়ে হিরণের চাপা গরববোধ আছে। এ বোধটা সে পেয়েছে শাশুড়ি ও দাদীশাশুড়ির কাছ থেকে। মিয়া বংশ কলেমা-কালাম লেখাপড়া জানা আশরাফ বংশ। আরবি-ফারসি-বাংলা, হালে একটু-আধটু ইংরেজিও এ বংশের পুরুষেরা জানে। সেই যে কবে পথ ভুল করে দুই গোরা সেপাই এসে পড়ছিল এই গাঁয়ে, তা তাদের সাথে কথা কইতে কে পেরেছিল মিঞা বংশের ছাওয়াল আবুল ফজল ছাড়া? চৈত মাসের কাঠফাটা রোদে সিপাইদের সিঁদুরে লাল মুখ হয়ে পড়ছিল যেন খয়েরলাল। সিপাইরা কী যেন চায়, টরটরায়ে কিসের নাম জানি কয়, গ্রামের কেউ না বোঝে। শেষে আবুল ফজল এক দৌড়ে বাড়ি ঢুকে কাঁসার গেলাস আর এক কলসি পানি নিয়ে গেলে দুই সেপাই তার পড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তিয়াস মিটলে পরে তারা আবুল ফজলের হাত ধরে কতক্ষণ ঝাঁকাঝাঁকি করে কত কী জানি কয়! শেষে ফজলেরই কাছ থে পথ বুঝে নিয়ে তারা শহরের পথ ধরে। সেই ঘটনার পর গ্রামবাসীর কাছে আবুল ফজলের পরিবারের সম্মান খুব বেড়ে গেছিল। তা তার পরিবারের সম্মান কি বংশেরও সম্মান নয়?

ফালুর দাদীর মুখের উপর মুখের মতো একটা জবাব দেয়ার জন্য হিরণের মুখ ফুটি ফুটি করে। কিন্তু এখনো সে বলতে গেলে বৌ মানুষ, ময়-মুরব্বীর মুখের পরে উচিৎ কথা বলাটা তার সাজে না। তাই সে চুপ থাকে। কিন্তু তার ঢেঁকিতে পার দেয়ার জোর হঠাৎ বেশ বেড়ে যায়। তবে চুপ থাকে না আকিমন। নোটে চাল আলায়ে দিতে দিতে সে বৌয়ের মেজাজ ঠিক ধরতে পারে। বৌয়ের মেজাজ তার কাছে আহ্লাদের বিষয় নয়। কিন্তু এখন যে কারণে বৌ ক্ষুব্ধ তা তার কাছেও ক্ষুব্ধ হওয়ারই বিষয়। যদিও আলতার পড়াশুনো তার কাছেও বাড়াবাড়ি ব্যাপার। কী হবে পড়াশুনো করে মেয়েমানুষের? একটু কলেমা-কালাম জানলে আর উত্তর-দক্ষিণ চিনলেই তো মেয়েলোকের কাজ চলে যায়। রান্ধা-বাড়া, ঝাড়পোচ করা কাজের জন্যি কি আর ইংরেজি পড়ার দরকার পড়ে? কিন্তু গ্রামে নতুন ইশ্কুল বসার পর মনা মাষ্টের রমিজ মিঞারে বুঝাইছে এক আজব কথা। আজকাল নাকি কোলকাতা আর কহানে কহানে মেয়েরাও ইশ্কুলে যায়। ‘তা বাপু, ইডা কি কোইলকেতা শহর যে মেয়েমানুষ জুড়িগাড়ি চড়ে হাওয়া খাতি যায়?’- এ কথার জবাব বেশ শক্ত করেই দিয়েছিল রমিজ মিঞা। আকিমনের বংশ-গোত্তরের দিকে ইঙ্গিত করেই কিনা বলেছিল, ‘ভাতুরিয়ার মিঞা বংশ নাদানের বংশ না। দুদু মিঞার বংশ আমরা। শরিয়ত-মারেফতের হকিকত বুঝে মিঞারা চলে। এ বংশের মাইয়্যেগেরে বরাবরই কুরান-হাদিস শিক্ষা করানো হয়। নাদান বংশের মাইয়্যেছেলে বৌ করে আনলি তাগেরও কিছু শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ক্যান, তুমার মনে নেই- তুমিতো ঠিকমতন দিকও চিনতে না। উত্তর ঘরে চেরাগ দিতি কলি চেরাগ হাতে মাঝ উঠোনে খাড়ায় থাইকতে। তাই কই, মাইয়্যেমানুষেরও পড়াল্যাহার দরকার আছে, শরাফতের মা। নাদান মাইয়্যেমানুষ খালি একালে না, পরকালেও বিপদের কারণ। ঠিকমতন কুরান-কিতাব পড়তি না শিখায় তারা শেরেক-বেদাত করে বেশি, সংসারে নানা ফেৎনা-ফ্যাসাদেরও জন্ম দেয়।’ এর পর কি আর কথা চলে! তবু কথা চালাতে চেষ্টা করেছিল আকিমন, ‘ক্যান, কুরান-কিতাব পড়তি কি ইশ্কুলি যাওয়া লাগে? ইশ্কুলি কি ওসব পড়ানো হয়? পড়ায় তো যত হিন্দুয়ানি…’। আকিমনকে থামিয়েছিল রমিজ মিঞা, ‘ইশ্কুলি আরবি পড়ায় না ঠিক, পড়ায় বাংলা-ইংরেজি। তা কোরানের তর্জমা পড়তি গেলি কি ধর্মীয় দুই-একখান কিতাব নাড়াচাড়ার জন্যি লাগে বাংলা পড়াশুনো। মাতৃভাষা শিক্ষা না করলি যে চোখ ফোটে না শরাফতের মা।’

হ, চোখ ফোটে না! চোখ ফুটায়ে মাইয়্যেমানুষ হাতি-ঘোড়া হবি। সত্যিই তো, তারা কি আর জজ-ব্যারেষ্টার হবি? তা জজ-ব্যারেষ্টার নাই হোলো, তাই বুলে কি আরাক পাড়ার মাগী আইসে কথা শুনায় যাবি? কোইলকাতায় বংশীয় মুসলমান ঘরের মাইয়্যেরাও নাহি এহন ইশকুলি পড়তি যায়। আগে খালি হিন্দু ঘরের মাইয়্যেরা ফিরিঙ্গি ইশ্কুলি দুই-চারজন পড়তি যাইতো, এহন বাংলা ইশ্কুলও নাহি হইছে। সিবার ফজু মিদ্দার মাইয়ের বিয়েতে কোইলকাতার থে তেমনই কোন মাইয়ে নাহি আইছিল। ফালুর দাদীর কথার জুৎসই জবাব দিতে স্বভাবসুলভ ভুরুর ভাঁজ আরো গভীর করে চিবানো স্বরে আকিমন বলে, ‘খালি চিঠি-পত্তরের কতা না বাপু, কতা একাল-পরকাল দুইকাল নিয়ে। কুরান-কিতাব পড়তিউ আইজকাল বাংলা জানা লাগে।

আকিমনের কথায় কথা বাড়াতে ফালুর দাদীর ঠিক সাহস হয় না। আকিমনের গাম্ভীর্য, চিবিয়ে বলা কথাকে পাড়ার কুঁদুলে মেয়েমানুষেরাও ডরায়। রায়বাঘিনী প্রকৃতির নারীও আকিমনের সাথে সমঝে কথা কয়। এমন না যে, আকিমন খুব ঝগড়াটে স্বভাবের। পাড়াপ্রতিবেশীদের সাথে বিবাদের ইতিহাস আকিমনের জীবনে নেই বললেই চলে। তবু যে পাড়ার মেয়েমহল আকিমনের সাথে ভাব বুঝে কথা বলে তার মূল কারণ তার রাশের ভারত্ব।

(১০)
আলতার দাঁত নড়ে- ছোট্ট, খুদে দুধদাঁত। যখন-তখন সন্দেশ-পাটালিগুড় খাওয়ার দরুণ পোকা ধরা কালো কালো সব দাঁত। আকিমন নাতিনেরে দাঁত নড়ানো শেখায়। নড়ানোর অছিলায় আচমকা টান মেরে পোকায় ফোঁপরা দাঁত তুলে আনে। প্রথম তোলা দাঁত বড় আহ্লাদ করে ইঁদুররে উপহার দেয়। ইঁদুরের গর্তে দাঁত রেখে ছড়া কেটে নাতিনেরে শেখায়, ইন্দুর ভাই, ইন্দুর ভাই, আমার দাঁত তুই নে, তোর দাঁত আমারে দে। কও বুজি, কও।
নাতিন প্রশ্ন করে, ইন্দুরের গাঁড়িতি দাঁত দিলি কী অয় দাদী?
দাঁতগুলোন ইন্দুরের মতন চিকুন চিকুন আর মজবুত অয়।
ইন্দুরির দাঁত বুঝি খুব মজবুত?
হয়। দ্যাহো না আমাগের ধানের ডোল, গাছের সুপোরী-নারকেল, ঘরের বিছেন-ক্যাথাও কেমন কাইটে-কুটে দেয়?

আমিও কি ধানের ডোল, বিছেন-ক্যাথা এসব কাটপো?
কী যে কও বুজি! তুমি ক্যান ওসব কাটপা? তুমি তো সুন্দর সাদা সাদা দাঁত বাইর ওরে খলখলায়ে হাসবা আর একশ বচ্ছর বয়স তামাইৎ নওলা মাছের মাথা চাবায়ে খাবা।
একশ বচ্ছর! এহন আমার বয়স কত দাদী?
এই যে আইজকে তুমার পেত্থম দাঁত পইড়লো, তার মানে তুমার বয়স এহন সাত চলে।
তুমার বয়স কত দাদী?

আমার! আকিমন এবার একটু ভাবনায় পড়ে। সত্যি তার বয়স এখন কত? কখনো কি সে তার বয়স নিয়ে ভেবেছে? সেই কোন এগারো-বারো বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল। বাড়ন্ত গঠনের হওয়ায় এরা ভাবতো পনেরো-ষোলো। তারপর কত বছর কেটে গেল এ বাড়ি। বিয়ের সাত বছর পর শরাফত হলো।

অত বড় বৌ, বিয়ের বছর না ঘুরতেই বাচ্চা হবে বলে যারা খোঁটা দিত তারা বাঁজা বৌ বলে খোঁটা দিতে শুরু করেছিলো। তারপর খোদাতালার অসীম রহমতে মামুদপুরের পীরের পানিপড়া খেয়ে শরাফত এলো কোল জুড়ে। সেও আজ কত বছর! আচ্ছা, শরাফতের জন্মের দিন-সন না রমিজ মিঞা লেখে রাখছিল কোন এক খাতায়? সেই খাতা কি এখনো রাখা আছে ঘরে? যদি থাকে তো রমিজ মিঞার কাছ থেকে শরাফতের বয়সের হিসেব পাওয়া যাবে। আর তা পাওয়া গেলে আকিমনের বয়সের হিসেবটাও তো মেলে।
রাতে ঘুমানোর আগে শাউড়ি ও সোয়ামির জন্য পান ছেঁচে দিতে দিতে আকিমন কথাটা তোলে। পানের বোঁটায় চুন নিতে নিতে রমিজ মিঞা সংক্ষেপে শুধু বলে, ‘বয়সের হিসেবে কী হবি। যার যা বয়স তা তো হইছেই।’ আকিমন একমত হয় না। বয়স যার যাই হোক তা তার জানা থাকাও উচিৎ বলে কেন যেন তার এতদিনে মনে হয়। এই যে তার শাউড়ি আধা পঙ্গু, আধা অন্ধ হয়ে এখনো বেঁচে আছে। কত তার বয়স তা জানার উপায় নেই। যেকোন দিন সে মারা যাবে। কেউ জানবে না যে কত গুলোন বছর সে এই দুনিয়ায় দুনিয়াদারী করার নসীব পেল। মানুষের তো একটাই জীবন। সেই জীবনের হিসেবটাও সে জানবে না? আবার তার স্বামী রমিজ মিঞা, লোকটা চিরকালই কেমন বুড়োটে ভাবের- দেখনে, কথনে, চাল-চলনে কোনকালেই তার মাঝে যৌবনের তরতাজা পুরুষ্টভাব ছিল না। অল্প বয়সেই তার চুল পাকলো, দাঁতও পড়লো। তা কোন বয়সে যে সেসব হলো তাও কি আর ঠিকমত জানে কেউ? আকিমনের আজো শক্ত-সমর্থ শরীর। এখনো তার চুল কেবল কানের কাছে দু-চারটা পাকা। এখনো সে গরুর সিনার হাড্ডি চাবায়ে খেতে পারে। অমাবস্যা-পূর্ণিমায় কোমরের ব্যথাটা বাড়া ছাড়া তার শরীরে রোগ-বালাই বলতে গেলে নেই। তা খোদাতালার এই নেয়ামত শরীরটা কত কাল এমন নিরুপদ্রব সুস্থ থাকে, তাও কি জানা দরকার না?

তয় বয়স না জানা নিয়ে জীবনে তত সমস্যা না হলেও বয়স জানাতে যে সমস্যা হতে পারে তা তো জানাই গেল রমিজ মিয়ার মামাতো ভাই সলিম হাজির কাণ্ড দেখে।
মস্ত ধনী না হলেও বেশ অবস্থাপন্ন সংসার সলিম হাজীর। সলিম হাজীর দাদা ভুলু শেখতো ছিল বেশ বড় মাপের তালুকদার। ভিন গাঁয়ের ছোটখাটো জমিদারেরাও তাকে সম্মান করতো। তা তিনপুরুষ ধরে ভাগ হয়েও তালুক-মুলুক এখন সলিম হাজীর ভাগে যা আছে তাতে তাকে ‘বড়লোক’ বলে ‘খাতের’ করে চলে আশ-পাশের পাঁচগাঁয়ের মানুষ। সেই খাতেরের খাতিরেই কিনা, সলিম হাজী মাঝ বয়সে পৌঁছার আগেই করে এলো হজ্ব। সে বছর, যে বছরে পোরথম আসমানী জাহাজ আসমানে উড়লো আর হাজার হাজার মানুষ নাকি তা দেখলো! পানিজাহাজে চেপে সলিম হাজি গেছিল আরব মুলুকে। জাহাজবাসের কালেই নাকি সে খবরটা শুনেছিল কার কাছে। আসমানে ওড়া জাহাজ! খোদাতালার ইচ্ছেয় মানুষের কী কেরামতি! তা যুদ্ধ-বিগ্রহ লাগার কয় বছর যেন আগের ঘটনা সেটা। আর সেই যুদ্ধ কত বছর চলে শেষও হলো এই কয় বছর। একটা-দুটো চুল তখন পাকছে কি পাকেনি যে হাজীর, তার মাথায় এখন কদমফুলের রোয়ার মতো কিছু চুল। মুখের সামনের দিকে কয়টা দাঁত ঝুলতে থাকলেও ভেতরের দাঁত পড়ে-ঝরে এখন তার চোয়াল বসা চেহারা। এখন হাজীর সংসারচিন্তা ছেড়ে পরকালের চিন্তা শুরু করার বয়স। কিন্তু না, একদিন কী এক কারণে গিন্নীর সাথে তীব্র মতান্তর-মনান্তর হওয়ায় গিন্নী তারে ‘বুড়ো’ বলে দিল গাল। অমনি তা পৌরুষের গালে চড় হয়ে পড়ল হাজীর ব্যাটা হাজীর নাতি হাজীর। আর যায় কোথায়! কোথায় লুকায়ে থাকা কোন কুষ্ঠি বের করে হিসেব কষে হাজী ঠিক বের করে ফেললো যে তার বয়স আসলে মোটে ছাপ্পান্ন বছর আটমাস চোদ্দ দিন। অর্থাৎ কিনা সাতান্ন বছর বয়স হওয়ারও আগে তারে খোটা শুনতে হলো ‘বুড়ো’ বলে! এই বয়সে আল্লার নবী…তওবা, তওবা, নবীর সাথে নাকি তার তুলনা! তবে কারো সাথে তুলনা করতে নয়, বরং নিজেরে ‘প্রমান’ করতেই যেন সে হঠাৎ ঘটায়ে ফেললো ঘটনা। পাশের গাঁয়ের গেদু সর্দারের ডবকা যুবতী বেওয়া মেয়েটারে নিকেহ্ করে এনে তুললো ঘরে।

‘থাউক। বয়স জানার কাম নাই।’ মনে মনে এমন ভাবনা ভেবে আকিমন সাংসারিক বিষয়ে কথা পাড়ে। রমিজ মিয়া নিতান্তই ‘হুঁ-হাঁ’ জবাবের মানুষ, আর আকিমনও নয় অমিতভাষী, তাই কোন বিষয়েই তাদের কথা লম্বা হওয়ার অবকাশ পায় না। ধান-পাট-চৈতালী ফসল আর গরু-বাছুরের প্রাসঙ্গিক আলাপ থেকে রমিজ মিয়া হঠাৎ ভিন্ন এক প্রসঙ্গে কথা তোলে।
আলতার বিয়ের পরস্তাব!
আকিমনের মনটা হঠাৎ কেমন হয়ে যায়। আবার কেমন এক খুশি-খুশি ভাবও যেন মনে ছোঁয়া দেয়। তা বিয়ে-সাদী ব্যাপারটাই তো অমন। এর প্রসঙ্গমাত্রে মনে একটু হাসি-খুশির ঝিলিক খেলে না যায়, এমন বেরসিক আছে নাকি জগতে! তবে কিনা সময়-অসময়ের ব্যাপার আছে। আছে উপযুক্ততার ভাবনাও। আর আছে অনিশ্চয়তার আশঙ্কা যা জন্ম দেয় এক প্রবল দ্বিধা। সেই দ্বিধার ভারে ভারাক্রান্ত মনে আকিমন নিজের মাঝে কথাটা খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে, ভাবে, একটু দুশ্চিন্তিতও হয়। এই কদিনইবা আগের কথা! আলতার মা শরাফতের ভয়ে…।

কিন্তু রমিজ মিয়ার যুক্তি অন্যরকম। দাম্পত্যপ্রেমে যুগলের বয়সের ফারাক যে বিড়ম্বনা ডেকে আনে সে বোধ যেন তার নেই। আসলে সে ইতিহাস যে তার জীবনে নেই। তার জীবনে বরং উল্টোটা আছে। সোমত্থ বৌ ঘরে আনলে তারে বশ করে তাবে রেখে চলা যে পুরুষের পক্ষে কত কঠিন তাই সে শুধু জানে। কিন্তু সেসব কথা উল্লেখ না করে সংক্ষিপ্ত কথায় তার মন্তব্য, সময়ে সব ঠিক হয়ে যায়।
হ্যা, সময়ে সব ঠিক হয় বৈকি। কিন্তু যদ্দিন সময় না আসে……
রমিজ মিয়া কথা বাড়ায় না। নাতনির বিয়ের সপক্ষে তার ক‚টনৈতিক ভাবনা সে এখনই কারো কাছে খোলাসা করতে চায় না।