ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে : রাজনীতির মাঠে প্রতিপক্ষ ছিলেন। ভোটের মাঠেও হয়েছেন একাধিকবার মুখোমুখি। এমনকি খেলার মাঠেও ছিলেন তারা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। একজন ডানে থাকলে আরেকজন বামে। মতের মিল, পছন্দের মিল এক নয়। এরপরও সিলেটে চমৎকার ছিল দু’জনের সম্পর্ক। দেখা হলেই হাসিমুখে জড়িয়ে ধরতেন একজন আরেকজনকে। বসে গল্প করতেন।
একজন আরেকজনের পরিবারের খোঁজখবর নিতেন। কখনো মনে হয়নি তারা একে অপরের চির প্রতিদ্বন্দ্বী। আসলেই বাস্তবে তাই। দ্বন্দ্ব ছিল রাজপথে, ভোটের কিংবা খেলার মাঠেও। কিন্তু কখনো তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কে চিড় ধরেনি। বরং দিন দিন তাদের সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হয়েছিলো। বড় ভাই, ছোট ভাই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তারা। এরা হলেন- সিলেটের প্রয়াত সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা বদরউদ্দিন আহমদ কামরান ও বর্তমান মেয়র, বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা আরিফুল হক চৌধুরী। কামরান আর নেই। দুনিয়া ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন চিরতরে। সিলেটের সম্প্রীতির নায়কের এই প্রস্থানে শোকাহত সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ঘুম থেকে উঠেই যখন শুনলেন কামরান নেই, ছুটে গেলেন তার ছড়ারপাড়স্থ বাসায়। একা একা চলে গেলেন তিনি। বাসার সামনে বসা ছিলেন কামরানের ভাইয়েরা। তাদের সঙ্গে বসে পড়লেন চেয়ারে। কাঁদলেন কামরানের জন্য। চোখ বেয়ে ঝরে পড়লো শোকের অশ্রু। কামরানের বাসায় পৌঁছে কথা বলতে পারছিলেন না আরিফ। কথা বলতে গিয়ে বার বার কণ্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছিল তারা। দিনভর তিনি কামরানের স্মৃতি মনে করে কথা বলেন। কখনো কামরানকে বড় ভাই, আবার কখনো অভিভাবক হিসেবে অভিহিত করেন। বলেন- এই ক্ষতি পুষানোর নয়। কামরানের মরদেহ একটিবার সিলেট সিটি করপোরেশনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী। প্রিয় কার্যালয়ে একবার হলেও কামরানকে নেয়ার জন্য আকুল ছিলেন। কথা বলেছিলেন মিডিয়ার সঙ্গে। সিলেটের প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু অনুমতি মেলেনি। যেহেতু কামরান করোনা আক্রান্ত ছিলেন। এ কারণে দাফন পর্যন্ত সবকিছু হয়েছে সংক্রমণ বিধি অনুযায়ী। কামরানের মরদেহ যখন সড়ক পথে ঢাকা থেকে সিলেটে নিয়ে আসা হচ্ছিলো তখন আরিফ ছুটে যান এগিয়ে আনতে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের লালাবাজার পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যান। সেখান থেকে তিনি মরদেহ বাসায় নিয়ে আসেন। এরপর গোসল, প্রথম জানাজা, দ্বিতীয় জানাজা সব কিছুতেই উপস্থিত ছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী। লাশ দাফনের পর জিয়ারত করেন। পরে দোয়াতেও শরিক হন। কামরানের মৃত্যুতে সিলেট সিটি করপোরেশনে মঙ্গলবার থেকে চলছে তিনদিনের শোক। আরিফের মতো সিলেট সিটি করপোরেশনের চত্বর প্রিয় ছিল কামরানের। দীর্ঘদিন তিনি এই সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথম মেয়রও তিনি। এর আগে শতবর্ষী পৌরসভার শেষ চেয়ারম্যানও ছিলেন। ফলে সিলেট সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের নামটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সিটি করপোরেশনের ইতিহাসের পাতায় থাকবে কামরানের নাম। এ কারণেই একটি বারের জন্য কামরানের মরদেহ নগর ভবনের প্রিয় প্রাঙ্গণে নিয়ে যাওয়ার আকুতি ছিল বর্তমান মেয়র আরিফের। সিটি করপোরেশনের অনেক কর্মকর্তা, কর্মচারীর সঙ্গে কামরানের পারিবারিক সম্পর্ক। অনেক অসহায় পরিবারকে একটি চাকরি দিয়ে তিনি স্বাবলম্বী করে তুলেছেন। কামরানের মৃত্যুতে কাঁদছে সিটি করপোরেশন। কামরান ছিলেন আর্জেন্টিনার সমর্থক। ফুটবল বিশ্বকাপ এলেই আলাদা উত্তেজনায় থাকতেন তিনি। আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে জড়িয়ে খেলা দেখতেন। আরিফ ব্রাজিলের সমর্থক। এবারের ফুটবল বিশ্বকাপের আগে সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে প্রীতি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিলো। এতে কামরান ছিলেন আর্জেন্টিনার অধিনায়ক ও আরিফ ব্রাজিলের। দু’জনের নেতৃত্বে সিলেটের ক্রীড়া সংগঠক সহ বিভিন্ন সুধী মহলের লোকজন এই খেলায় অংশ নেন। সিলেটকে মাতিয়ে রাখতেন কামরান। আরিফের কাছে সিলেট সিটি করপোরেশনের ২০১৩ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে দু’দফা পরাজয় বরণ করলেও কখনো তিনি সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেননি। কিংবা তিক্ততার পর্যায়ে নেননি। বরং আরিফকে তিনি মুখের হাসি ও ভালোবাসা দিয়ে কাছে টেনে নিয়েছেন। কামরানের মৃত্যুতে নির্বাক আরিফ। এখনই কামরানের বিদায়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। জানালেন- ‘চিকিৎসার জন্য ঢাকায় গিয়েছিলেন। আশায় বুক বেঁধেছিলাম কামরান ভাই সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন। কিন্তু যখন এলেন প্রাণহীন দেহ নিয়ে এলেন। কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে বড় ভাইকে হারালাম।’ তিনি জানান, ‘একজন সফল জনপ্রতিনিধি, একজন সফল রাজনীতিবিদ ছিলেন বলে সিলেটের মানুষ আজ কামরানের জন্য কাঁদছে। তার মৃত্যু আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি করে দিয়ে গেল।’ মহামারি করোনা কেড়ে নিলো সিলেটের প্রিয় মানুষ কামরানকে। এ কারণে করোনা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। কামরানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সিলেটের মানুষকে লালকার্ড দেখালো করোনা। এ জন্য সিলেটের মানুষকে বাঁচাতে দ্রুতই লকডাউন চান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।