মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
উনপঞ্চাশ.
প্রচারণার মধ্যে কিন্তু আর্ট আর সাইন্সের একটা খেলা আছে। কিছু মানুষ এমনি’তেই এই বিষয়টা ভালো পারে, কিন্তু সবাই এ ব্যাপারে তেমন কাজ দেখাতে পারে না। তবে এটার জন্য কিছু মৌলিক বিষয়ের জ্ঞান অর্জনই যথেষ্ট নয়, বরং সেই বিষয়গুলি ভালোভাবে চর্চা করতে হয়।
পাপিনিউ’র ভোটারদের কাছে ভালোভাবে পৌঁছানোর জন্য বা তাদের মন জয় করার জন্য আমাকে কিভাবে আরো বেশি স্ব উদ্যোগী হতে হবে, সেই বিষয়টা আমি শিখে গিয়েছিলাম। সবার সাথে খুব বিনয়ী ও ভালোভাবে নিজেকে উপস্থাপন করা অবশ্যই খুব ভালো ও প্রয়োজনীয় একটা কৌশল, কিন্তু কোনো এক অনুষ্ঠান বা আয়োজনে নিজেকে একেবারে বিনয়ের অবতার হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরলে অনেক সময় আবার আসল উদ্দেশ্য নাও হাসিল হতে পারে।
আমার প্রচারণার একেবারে শুরুতে ছেলেমেয়েদের খেলার একটা অনুষ্ঠানে অনেক মানুষের এক জমায়েতে আমিও উপস্থিত ছিলাম। একবারে স্টেজের মুখোমুখি অনেক মানুষ বসে ছিল। ওদের পেছনে একটা ফাঁকা বড় জায়গা ছিল যেখানে অনুষ্ঠান চলাকালীন ছোট বড় অনেকেই নিজেদের মত হাঁটাহাঁটি করছিল। আমার মনে হয়েছিল ঐ মুহূর্তটা একটা মোক্ষম সময়, যখন খুব সহজেই ভোটারদের সাথে একটা যোগাযোগ করা যেতে পারতো, কিন্তু মূল খেলা থেকে সবার দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেবার জন্য আমি সেই মুহূর্তে তেমন কিছু করিনি। যখন খেলায় কোনো রূপ বিঘœ না ঘটিয়ে আমি একটা সময় পেলাম, তখনই আমি দ্রæত গতিতে আমার চেয়ারটা তাদের সামনে ঘুরিয়ে তাদের একেবারে কাছাকাছি গিয়ে, তাদেরকে মনে করিয়ে দিলাম সেই মুহূর্তে সবার সাথে কথা বলা যেতেই পারে, আর সেই সাথে তাদের সবাইকে বলেই ফেললাম, আমি এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি।
সেই মুহূর্তে আমার সেই কাজে কেউ কোনো আপত্তি তুলেনি বা আমাকে বাঁধাও দেয়নি। সত্যি বলতে কি, আমি প্রায় দেড় বছরের মত সময় ধরে পাপিনিউ’তে আমার নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছি, কিন্তু আমি যেখানেই নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরা এবং আমার উদ্দেশ্য সবাইকে বলার জন্য যে প্রচেষ্টা চালিয়েছি তার জন্য কখনও কারো দ্বারা কোনো রকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হইনি। এখনকার সময়ে লক্ষ্য করা যায়, অনেক ভোটারই রাজনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক মত প্রকাশ করে বা এক ধরনের অনীহা দেখায়, কিন্তু তারপরও দেখা যায় কোনো রাজনীতিবিদের সাথে হাত মেলানো বা কুশলাদি বিনিময়ের ব্যাপারটা সবাই ভালোভাবেই নেয়।
কয়েক মাস প্রচারণার পর সব রাজনীতিবিদই বুঝতে পারে তার অবস্থানটা কোন পর্যায়ে রয়েছে। রাজনীতি করতে হলে তোমাকে অনেক বিষয়ই মাথায় রাখতে হবে, বা অনেক কিছুই মনে রাখতে হবে, যা অন্যরা স্বাভাবিকভাবেই রাখে না। সত্যি কথা বলতে কি, কানাডার অনেকেই জানে না তাদের এলাকার পার্লামেন্ট সদস্যের নাম কি, সেখানে কে কে এমপি হবার জন্য লড়াই এ লিপ্ত হয়েছে, এই বিষয়ে বেশির ভাগেরই কোনো চিন্তা বা মাথা ব্যাথা থাকে না। সেই সাথে আমি এটাও লক্ষ্য করেছি, নামের শেষ অংশটি খুবই বিখ্যাত বা খুবই পরিচিত কিছু একটা হলেও সেটা সাধারণ মানুষের কাছে তেমন কিছু যায় আসে না।
আমার ক্যাম্পেইন ম্যানেজার এলেক্স লান্থিয়ের আমার প্রচারণারকে খুবই বেশি কার্যকরী করার জন্য বেশ কয়েকটি কৌশল অবলম্বন করেছিল। একদিন আমি একটা এলাকা দিয়ে হাঁটছিলাম, এবং আমি যাকেই সামনে পাচ্ছিলাম তাকেই খুব দ্রæত কখনও ‘হাই’, আবার কখনও ‘হ্যালো’ আবার ‘আপনার সাথে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগছে’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলছিলাম। আমার এই কাজটি এলেক্স লক্ষ্য করে আমার পাশে এসে আস্তে করে আমাকে একটু পাশে নিয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠে, ‘হ্যালো, আমার নাম এলেক্স লান্থিয়ের, আপনি কে?’
আমি বলে উঠলাম, ‘আমি জাস্টিন ট্রুডো।’
এলেক্স আমার এই উত্তর শুনে একটু হেসে উঠেছিল, তারপর সে আমার কানের কাছে কিছুটা মুখ এনে বলতে লাগলো, ‘এইতো ঠিক বলেছো। এবার থেকে তুমি যার সাথেই হাত মেলাবে বা যার সাথেই কুশলাদি বিনিময় করবে, তাকেই তুমি তোমার নামটা বলবে। তাদের কানের ভিতর তোমার নামটা পৌঁছিয়ে দাও, তুমি যদি সেটা না করো, তাহলে তুমি সবার কাছে সব সময়ই নাম না জানা এক অপরিচিত ব্যক্তিই রয়ে যাবে, যেমন আমরা অনেক অপিরিচিত ব্যক্তির সাথেই কথা বলি, হাত মিলাই, কিন্তু দৃষ্টির আড়ালে গেলে আমরা সব কিছুই ভুলে যাই এবং সাধারণত আর কখনও তাদের কথা আর মনেও রাখি না।’
আমি একেবারে আনকোরা রাজনীতিবিদ হলেও মানুষের সাথে সত্যিকারের এক সম্পর্কের বন্ধন তৈরীর ব্যাপারটাই আমি সব সময়ই গুরুত্ব দিতাম। তুমি যদি কখনও কারো কাছে ভোটের জন্য যাও, তবে অবশ্যই তার নামধাম জিজ্ঞেস করা বা বিভিন্ন বিষয়ে তার চিন্তা ভাবনার ধরনটা জানার জন্য নিশ্চয়ই তোমাকে ধৈর্য্য সহকারে তার কথা শুনতে হবে। যদি গুরুত্ব ও ধৈর্যের সাথে কথা শোনা না হয়, তাহলে সে ধরনের যোগাযোগের কোনো মূল্য থাকবে না, আমি বলতে পারি সেটাতে দুই পক্ষের যোগাযোগটা সুন্দর না হয়ে, বরং সেটা হবে নিছক সময়ের অপব্যবহার।
বলা হয়, তুমি কত জনের সাথে ভোটের ব্যাপারে কথা বললে, সেটা তোমার দিকে ভোট টানার কোনো মাপকাঠি নয়, এবং এটাও মনে রাখতে হবে, তুমি সবাইকে তোমার পক্ষে ভোট দেবার জন্য তোমার দিকে টানতে পারবে না। আমি বেশ কিছু বয়স্ক ভোটারের কাছ থেকে তিক্ত কিছু অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। তারা আমার সাথে যে ধরনের নেতিবাচক ব্যবহার করেছে সেটা আমি কখনও প্রত্যাশা করিনি। তাদের এই ধরনের ব্যবহার পাওয়ার আসল কারণ ছিল, আমি আমার বাবা পিয়েরে ট্রুডোর সন্তান। আসলে তাদের কোনো কারণে রাগ বা ক্ষোভ ছিল বাবার ওপরে, সেটা তারা আমাকে পেয়ে ঝেড়েছিল। তারা অনেকেই আমাকে দেখে রেগে গিয়েছিল এবং তাদের দরজা নক করার জন্য আমাকে কিছুটা বকাবকি করেছিল। তারা বাবার জন্য কেনো আমার ওপরে রাগান্বিত হয়েছিল, সে ব্যাপারে তাদের সাথে যে কথা বলবো সেই সুযোগ তারা আমাকে দেয়নি, এমন কি আমিও ঐ ধরনের বয়স্ক মানুষের সাথে কোনো ধরনের যুক্তি তর্কে যেতে চাইনি। তারপরও আমি খুঁজার চেষ্টা করতাম এমন কোনো দিক আছে কি না যেটাতে দুই পক্ষের কিছু মিল আছে।
আসলে কোনো এক সাবেক রাজনীতিবিদ যদি একজন ভোটারের মনের মধ্যে এক নেতিবাচক আসন নিয়ে থাকে, তবে সেই রাজনীতিবিদের সন্তানের প্রতিও এক নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ পাবে এটাই স্বাভাবিক। আমি যখনই এমন কারো সামনা সামনি হতাম, তখন আমি হাসি মুখে তার সামনে আমার হাতটা বাড়িয়ে বলতাম, ‘আপনি আমাকে ভোট দিন আর নাই দিন, আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে নিজের কাছ ভালো লাগছে। আপনি ভালো থাকবেন।’ এমন কথা বলে আমি পরের দরজার দিকে পা বাড়াতাম।
আরেকটা বিষয় হচ্ছে, তুমি যখন কোনো বড় দলের প্রার্থী হয়ে ভোটারদের কাছে ভোট চাইবে, তখন তোমার কথার প্রতিটি শব্দের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়। এক দল মানুষই আছে, যারা বসেই থাকে তোমার ব্যবহৃত শব্দের কোথাও কোনো গরমিল আছে কিনা বা কোন সামান্য ফাঁক আছে কি না, যেটা ধরে একটা সমালোচনার ঝড় তুলতে পারা যায়। তোমার উদ্দেশ্য যতই ভালো হোক না কেনো, তোমার সামান্য বেফাঁস কথার জন্য তোমার প্রতিপক্ষ সব সময়ই অপেক্ষা করে থাকে। আমি এখানে একটা উদাহরণ দিতে পারি, ২০১৩ তে কনজারভেটিভরা আমাকে প্রথম যে আক্রমণ করেছিল সেটার সূত্র ছিল আমি ১৯৯০ সালে আমার কোনো এক সাক্ষাৎকারে আমি বাবার সম্পর্কে কী বলেছিলাম। তারা আমাকে যেভাবে এবং যে বিষয়ে আক্রমণ করেছিল সেটার সাথে সেই সাক্ষাৎকারের বিষয় বা সময়ের কোনো প্রাসঙ্গিকতা ছিল না। তবে আমি এটা বরাবরই মনে করি, এমন কোনো আক্রমণের জবাব নগ্নভাবে না দিয়ে বরং একটু অপেক্ষা করা উচিৎ। আমি বিশ্বাস করি এবং দেখেওছি, কানাডিয়ানরা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন এবং তারা খুব সহজেই ধরে ফেলে কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক। কানাডিয়ানরা জানে কিভাবে তুষ থেকে গম বের করে আনতে হয়।
এর মানে আমি কিন্তু বলছি না যে, তুমি এই ধরনের ভিত্তিহীন কোনো আক্রমণ বা সমালোচনার কোনো জবাব দিবে না। অনেকেই খুব ভালো মনেই ভালো উদ্দেশ্যে কিছু বলে থাকে এবং ভাবে সেই কথার কেউ কোনো খুত পাবে না এবং কোনোভাবেই সে কোন রূপ আক্রমণ বা সমালোচনার শিকার হবে না। কিন্তু কখনোই এটা বলা যেতে পারে না। কারণ অহরহ দেখা যায়, ফেইসবুক বা টুইটারে তার কথার কোনো এক অংশ তুলে ধরে বা একটু বিকৃত করে অনেকেই সেটাতে সমালোচনার ঝড় তুলে দেয়।
আবার এটাও মনে রাখতে হবে, তুমি যদি কখনও কোনো বিষয় খুবই সহজভাবে নাও, অথবা হালকা চালে কথা বলো, সেটাতেও এক বিরূপ পরিস্থিতির শিকার তুমি হতে পারো। সেই পাপিনিউ’র প্রচারণার সময় আমার ওয়েব সাইট এ একজন ছাত্র আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিল, ‘যদি ভিনগ্রহ থেকে কেউ কানাডায় এসে এদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে, তবে কি সে ‘চার্টার অব রাইটস এন্ড ফ্রিডমস’ এর সব সুবিধা ভোগ করবে?’ আমার মনে হয়েছিল, ছেলেটি একটা অদ্ভুত ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন করেছে, এবং সেই সাথে প্রশ্নটি বিজ্ঞান কল্প কাহিনীর প্রতি আমার যে আগ্রহ আছে, সেটাকে একটু উসকে দিয়েছিল। সেই সাথে একজন ছোট ছেলে যে এমন ধরনের চিন্তা ভাবনা করতে পারে, সেটাও আমাকে খুবই মুগ্ধ করেছিল। যদিও আমার পরামর্শকরা সব সময়ই এই ধরনের বিষয় এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিতেন কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে করছিল ছেলেটির প্রশ্নের উত্তর দিতে। ফলে আমি লেখেছিলাম, অবশ্যই এমন কেউ যদি কানাডায় এসে নাগরিকত্ব গ্রহণ করে থাকে, তবে তাকে অন্য যে কোনো নাগরিকের মতই সব সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে। আমার সেই লেখা দেখে অন্টারিও আইনজীবী পরিষদের সাবেক সভাপতি মন্তব্য করেছিলেন, আমি যা বলেছি তা যথার্যই সত্য, কিন্তু আমার এই লেখাটা মানুষ নয় এমন কারোর প্রতিও নাগরিক অধিকারের বিষয়টা যে প্রয়োজ্য হতে পারে এমন এক আলোচনা বা যুক্তি তর্ক উস্কে দিতে পারে।
কয়েকদিন পরে ‘লা প্রেস’ এ একটা কার্টুন ছাপা হয়েছিল, যেটাতে দেখানো হয়েছিল আমি একজন ই.টি. (ভিনগ্রহের প্রাণী) যে চার্টার অব রাইটস এর সব অধিকার ভোগ করে থাকে, আর স্টিফেন ডিওন’কে দেখানো হয়েছিলো আরেকজন কিম্ভুতকার ই.টি হিসেবে, যে আমার দিকে তার এক বিশাল বড় আঙ্গুল তাক করে আছে। (চলবে)