মণিজিঞ্জির সান্যাল : পৌষ সংক্রান্তি মানেই বাঙালির ঘরে ঘরে বর্ণিল উৎসব। প্রাচীনকাল থেকেই এই উৎসব চলে আসছে। তবে সুস্পষ্টভাবে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। হতে পারে এটা হাজার বছরের উৎসব বা তারও আগের তবে পুরাণেও এর উল্লেখ আছে। যার মধ্যে আমরা উত্তর পেয়ে যাই। পুরাণ অনুযায়ী, মকর সংক্রান্তির এই মহাতিথিতেই মহাভারতের পিতামহ ভীস্ম শরশয্যায় ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেছিলেন। আবার অন্য মত অনুযায়ী, এই দিনই দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের যুদ্ধ শেষ হয়েছিল।

বিষ্ণুদেব অসুরদের বধ করে তাঁদের কাটা মুন্ডু মন্দিরা পর্বতে পুঁতে দিয়েছিলেন, তাই মকরসংক্রান্তির দিনই সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাস হয়ে শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে আজও মানা হয়ে থাকে। আবার অন্য মতে, সূর্য এ দিন নিজের ছেলে মকর রাশির অধিপতি শনির বাড়ি এক মাসের জন্য ঘুরতে গিয়েছিলেন। তাই এই দিনটিকে বাবা ছেলের সম্পর্কের একটি বিশেষ দিন হিসাবেও ধরা হয়।

জড় বিজ্ঞান অনুযায়ী, সূর্যের গতি দুই প্রকার, উত্তরায়ণ এবং দক্ষিণায়ণ। ২১ ডিসেম্বর সূর্য উত্তরায়ন থেকে দক্ষিণায়নে প্রবেশ করে। এ দিন রাত সবথেকে বড় হয় আর দিন সবথেকে ছোট হয়। এর পর থেকে দিন বড় আর রাত ছোট হতে শুরু করে। মাঘ থেকে আষাঢ় পর্যন্ত ছয় মাস উত্তরায়ণ। আবার শ্রাবণ থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত ছয় মাস দক্ষিণায়ণ। পৌষ মাসের সংক্রান্তিকেই বলা হয় উত্তর সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি। শাস্ত্র মতে উত্তরায়ণে মৃত্যু হলে মুক্তি প্রাপ্তি হয় এবং দক্ষিণায়ণে মৃত্যু হলে ঘটে পুনরাবৃত্তি অর্থাৎ তাঁকে আবার সংসারে ফিরে আসতে হয়। সূর্য এ দিনই ধনু রাশি থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে। এর থেকেই মকর সংক্রান্তির উৎপত্তি।

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগরদ্বীপে প্রতি বছরই মকর সংক্রান্তিতে স্নানে হাজার হাজার পুণ্যার্থীর সমাবেশ হয়। অজয় নদীর তীরে হয় জয়দেবের মেলা।

সংক্রান্তি বা মকরসংক্রান্তি একটা ফসলী উৎসব, যা শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় পালিত হয়। ভারতে এই উৎসব অবশ্য রাজ্য ভেদে নানা নাম পেয়েছে। সাধারণত ১৪ জানুয়ারি বা তার এক দিন আগে-পরে এই তিথি আসে। তবে এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই উৎসবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, তার মেয়াদও আলাদা হয়ে থাকে। কোথাও কোথাও চার দিন পর্যন্তও উৎসব চলে। বাংলায় পৌষ সংক্রান্তি, তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল, গুজরাতে উত্তরায়ণ, অসমে ভোগালি বিহু, কর্নাটকে মকর সংক্রমণ, কাশ্মীরে শায়েন-ক্রাত- এমন নানা নামে এই একই উৎসব পালন করা হয়। মকর সংক্রান্তিকে ঘিরে উৎসব আক্ষরিক অর্থেই একটি সর্বভারতীয় উৎসব।
এ দিন লক্ষ্মীর আরাধনাও করা হয়ে থাকে।

এই দিন পূন্য স্নানের দিন, অনেকে গঙ্গায়, সমুদ্রে বা নদীতে স্নান করে পূন্য অর্জন করেন। মূলত জ্যোতিষশাস্ত্রে এটি একটি ‘ক্ষণ’। এই দিন সুর্য তার নিজ কক্ষপথ থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে। তাই এই দিনটিকে মকর সংক্রান্তি বলে।

(১) এই দিন এমন কিছু কাজ করলে পরিবারে সুখ সমৃদ্ধি ফিরে আসে। বলা হয়, এই দিন ঘর-বাড়ি পরিষ্কার পরিছন্ন করে রাখলে ভালো? মকর সংক্রান্তির দিনে সাধারণত সূর্যের পুজো করা হয়। যার ফলে গঙ্গায় স্নান করলে সকল রকম রোগ ব্যাধি দূর হয়।

(২) মকর সংক্রান্তি আনন্দ ও উৎ?সবের সঙ্গে পালন করা হয়। তাই ওই দিন কোনোও দুস্থ এলে তাঁকে কখনোই খালি হাতে ফেরাতে নেই। বিশ্বাস করা হয়, এতে গৃহে অন্নের অভাব হয় না এবং সুখ শান্তি বজায় থাকে।

(৩) মকর সংক্রান্তির দিন সকাল সকাল স্নান সেরে উঠোনে বা ঘরে আলপনা দিয়ে কিন্তু সূর্যদেবের পুজো করার নিয়ম প্রচলিত আছে।

(৪) মকর সংক্রান্তি বাঙালির প্রিয় একটি উৎসব। এ দিন রসনার তৃপ্তিও হয়। গুড়, চাল, দুধ দিয়ে নানা ধরনের উপাদেয় মিষ্টি, পিঠে-পায়েস ইত্যাদি তৈরি করা হয়। কথিত আছে এই বিশেষ দিনটিতে সূর্যদেব তার পুত্র শনি দেবতার প্রতি তার ক্ষোভ ভুলে যান এবং তার গৃহে সূর্যদেবের আগমন ঘটে। তাই এই দিনে সকলে মিলিত হয় এবং মিষ্টি মুখ করে সম্পর্ক বজায় রাখার অঙ্গীকার করে।

এই দিন পূন্য স্নানের দিন, অনেকে গঙ্গায়, সমুদ্রে বা নদীতে স্নান করে পূন্য অর্জন করেন। মূলত জ্যোতিষশাস্ত্রে এটি একটি ‘ক্ষণ’। এই দিন সুর্য তার নিজ কক্ষপথ থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে। তাই এই দিনটিকে মকর সংক্রান্তি বলে।

সংক্রান্তি অর্থ সঞ্চার বা গমন করা। সূর্যের এক রাশি হতে অন্য রাশিতে সঞ্চার বা গমন করাকেও সংক্রান্তি বলা যায়। সংক্রান্তি শব্দটি বিশ্লেষণ করলেও একই অর্থ পাওয়া যায়। সং+ক্রান্তি, সং অর্থ সঙ সাজা এবং ক্রান্তি অর্থ সংক্রমণ। অর্থাৎ, ভিন্ন রূপে সেজে অন্যত্র সংক্রমিত হওয়া বা নতুন সাজে, নতুন রূপে অন্যত্র সঞ্চার হওয়া বা গমন করাকে বোঝায়। সূর্য এ দিনই ধনু থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে। এর থেকেই মকর সংক্রান্তির উৎপত্তি।
পৌষ বা মকর সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতির একটি বিশেষ উৎসব বা বিশেষ ঐতিহ্যবাহী দিন। বাংলা মাস অনুযায়ী পৌষ মাসের শেষ দিনটিতে এই উৎসব পালন করা হয়। শুধু বাংলায় বাঙালিরাই নন, আমাদের দেশের নানা প্রান্তে এই দিনটিকে নানা ভাবে বিশেষ বিশেষ উৎসবের সঙ্গে পালন করা হয়। বাঙালিরা এই দিনটিতে পুজো করে পিঠে-পুলি বানিয়ে খাওয়া দাওয়া করে। এই বিশেষ দিনটি নানা রকম অনুষ্ঠান ও আনন্দের মধ্যে দিয়ে পালিত হয়। কিছু বিশেষ নিয়মকানুনের মধ্যে দিয়ে পালন করা হয় প্রাচীনকাল থেকেই। মকর সংক্রান্তির দিন দূর যাত্রা করা শুভ নয় বলে মনে করা হয়। কোথাও গেলেও নিজের বাড়িতে ফিরে আসা উচিত বলে মানুষের বিশ্বাস।

সারা দেশে মকর সংক্রান্তি পালন করা হয়।
এই দিন মানে মকর সংক্রান্তিতে খিচুড়া খাওয়া এবং দান করার রীতি রয়েছে। এই কাজের বিশেষ মাহাত্ম্য আছে।
জ্যোতিষের মতে, খিচুড়ির সঙ্গে আলাদা-আলাদা গ্রহের সম্পর্ক রয়েছে।খিচুড়িতে থাকা চাল, ডাল, হলুদ, সবজির পাশাপাশি রান্না করার ধরন কোনও না কোনও বিশেষ গ্রহের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত।

জ্যোতিষাচার্য জানিয়েছেন, ধার্মিক মাহাত্ম্য অনুসারে, মকর সংক্রান্তি-র খিচুড়িতে চাল, ডাল, হলুদ, মটর এবং কাঁচা সবজির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। খিচুড়ার চাল চাঁদ এবং শুক্রর শান্তির যোগ রয়েছে। কালো ডাল শনি, রাহু এবং কেতুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
হলুদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে বৃহস্পতির। এবং সবুজ সবজির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে বুধের। আর যখন খিচুড়ি রান্না করা হয়, তখন যে তাপ তার সম্পর্ক রয়েছে মঙ্গল এবং সূর্যদেবের সঙ্গে।

এ ভাবে মকর সংক্রান্তির খিচুড়ি প্রায় সব ক’টি গ্রহের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। মকর সংক্রান্তির দিন খিচুড়ি খাওয়া এবং দান করার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
পৌষ সংক্রান্তি মানে বাঙালির ঘরে ঘরে পিঠেপুলির বর্ণিল উৎসব। তিন দিন ধরে এই সময়ে ঘরে ঘরে হরেক পিঠে তৈরি করেন বাঙালি মেয়েরা।
যেমন, সেদ্ধ পিঠে : শীতের পিঠে বললেই মনে আসে সেদ্ধ পিঠের কথা। সেদ্ধ চালের গুঁড়ো, খেজুর গুড়, নারকেল কোরানো, নুন-চিনি সহযোগে এই পিঠে তৈরি হয়।

দুধপুলি : শীতের আর এক বিশিষ্ট পিঠে দুধপুলি। সেদ্ধপিঠের সঙ্গে এতে লাগে দুধ ও ক্ষীর।
মালপোয়া : শীতের পিঠের সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল সম্ভবত মালপোয়া। এ সময়ে অনেকেই এর জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। এতে লাগে খেজুর রস, ময়দা, ক্ষীর, খাবার সোডা, মৌরী, নুন, ঘি। গুড় জাল দিয়ে ঘন করে নিতে হবে। ময়দা, ক্ষীর, মৌরী, নুন জল দিয়ে ঘন গোলা তৈরি করতে হবে। হাঁড়িতে ঘি দিয়ে পিঠে ভেজে নিতে হবে। তারপর সেগুলি গরম গরম খেজুর রসে ডুবিয়ে নিতে হবে।

লবঙ্গলতিকা: শীতের পিঠের আর এক অতি আকর্ষণীয় জিনিস হল লবঙ্গলতিকা। ময়দা, চালের গুঁড়ো, দুধ, নারকেল, চিনি বা গুড়, লবঙ্গ ও তেল লাগে এতে। প্রথমে ময়দা, চালের গুঁড়ো জল দিয়ে মাখিয়ে ময়ান করে নিতে হবে। তারপর দুধ জ্বাল দিয়ে নারকেল কোরা চিনি বা গুড় দিয়ে তৈরি করে নিতে হবে পুর। এরপর রুটির মতো তৈরি করে তা গোল করে কেটে ওর মধ্যে নারকেলের পুর দিয়ে চারদিক দিয়ে ভাঁজ করে মাঝখানে লবঙ্গ গেঁথে মুখ আটকে, গরম তেলে একটি একটি করে ডুবো তেলে ভাজলেই রেডি।

তিল পুলি: শীতের পিঠের আর এক মজার জিনিস নারকেলের তিল পুলি। এর উপকরণ হল ভাজা তিলের গুঁড়ো, খেজুর গুড়, এলাচ গুঁড়ো, দারচিনি, আতপ চালের গুঁড়ো, তেল।
এইভাবেই আনন্দের সঙ্গে হৈ হৈ করে কেটে যায় এই বিশেষ দিনটি।
মণিজিঞ্জির সান্যাল: শিলিগুড়ি, দার্জিলিং
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ