অনলাইন ডেস্ক : ‘সেই ছোটবেলা থেকে মা-বাবার মুখে শোনা, ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার (চিকিত্সক) হবে। মানুষের সেবা করবে; মুখ উজ্জ্বল হবে পরিবারের, সমাজে বাড়বে সম্মান-প্রতিপত্তি। স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাও চাইতেন, বড় হয়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে তার প্রিয় শিক্ষার্থী। এই দুই পেশার বাইরে অন্যকিছু যেন কল্পনাতেই আসত না। কিন্তু সেই স্বপ্ন যেন ফিকে হয়ে এসেছে। সমাজে চিকিত্সকের সেই সম্মান আজ আর নেই।’
মেডিকেলে ভর্তির শুরু থেকে যে যুদ্ধ আর অধ্যবসায়ের শুরু, ভর্তির পরও তার যেন শেষ নেই। টানা পাঁচ বছর সমাজ-পারিপার্শ্বিকতা সবকিছু বাদ দিয়ে বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা। এমবিবিএস কোর্স শেষের পর চলে বিসিএসের প্রস্তুতি। সবকিছু ঠিক থাকলে মেলে স্বাস্থ্য ক্যাডারের সুযোগ অর্থাত ছোটবেলা থেকে লালিত স্বপ্ন সেই সরকারি চিকিত্সক হওয়ার সুযোগ মেলে। স্বাস্থ্য ক্যাডারের শুরুতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পোস্টিং। সেখানে নেই কোনো গাড়ির সুবিধা, ভাড়ায় থাকতে হবে সরকারি কোয়ার্টারে! ব্যক্তিগত সহকারী ও আলাদা কোনো অফিস থাকবে না। পদোন্নতির জন্য প্রয়োজন হবে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রির। যা শেষ করতে লাগে ১৪-১৫ বছর। এখানেও সেই কঠিন অধ্যবসায়। রয়েছে জটিল পদোন্নতি প্রক্রিয়া, সহযোগী অধ্যাপক হলেও মিলবে না গাড়ি পাওয়ার সুযোগ।
অন্যদিকে, প্রশাসন ক্যাডারে চাকরির শুরুতে মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব, ডিসি অফিসের কর্মকর্তা, এসিল্যান্ড হিসেবে যোগদান। রয়েছে ধারাবাহিক পদোন্নতির সুযোগ, গাড়ি-বাড়ির সুবিধা, গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে মাসিক ৫০ হাজার টাকা। ব্যক্তিগত সহকারী, পাওয়া যাবে আলাদা অফিসও। আর ইউএনও হলে সরকারি বাংলো ও গাড়ির সুবিধা তো রয়েছে। পদোন্নতি পেলে মন্ত্রিপরিষদ সচিবও হতে পারেন। রয়েছে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়ার সুযোগ, প্রেষণে আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজের সুযোগও আছে। তাহলে প্রশাসনিক ক্যাডার না হয়ে কেন চিকিৎসক হবেন তরুণরা— এমন প্রশ্ন ৩৮তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে নির্বাচিত হওয়া মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থীর।
নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, পদোন্নতি, সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক মূল্যায়ন বিবেচনায় স্বপ্নের সেই চিকিত্সক হওয়ার পেশায় মন টেকেনি। প্রশাসন পরিচালনার কাজের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে, সেখানে রয়েছে পর্যাপ্ত সম্মান। এ কারণে ডাক্তারি পড়লেও প্রশাসন ক্যাডার বেছে নিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়ে চিকিত্সকরা স্বাস্থ্যসেবা দিলেও নানাভাবে তাদের বঞ্চিত হতে হয়। সঠিক সময়ে পদোন্নতির সমস্যা, নানাভাবে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত হওয়া, যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা না পাওয়াসহ রয়েছে নানা সমস্যা।
এমবিবিএস পাস করে চিকিত্সক না হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হওয়া এমন আরও কয়েকজনের সঙ্গে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তাদের সবারই একই মন্তব্য। ‘ভাই, চিকিত্সক হয়ে লাভ কী? সেই মহান পেশা আজ আর নেই। এ কারণে চিকিত্সক হওয়ার বদলে পুলিশ, প্রশাসন, পররাষ্ট্র ও কর— এ চার ক্যাডারের যেকোনোটি বেছে নেয়া।’
গত মঙ্গলবার ৩৮তম বিসিএসের ফল প্রকাশের পর দেখা গেছে, এমবিবিএস পাস করা শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ক্যাডার পদ বেছে নিয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকে রয়েছেন পুলিশ, প্রশাসন, পররাষ্ট্র ও কর ক্যাডারে। তাদের সংখ্যা কত— এমন প্রশ্ন করা হয় বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)-কে। সঠিক সংখ্যা বলতে না পারলেও পিএসসি জানায়, এ সংখ্যা শতাধিক।
কেন স্বাস্থ্য ক্যাডার ছেড়ে অন্য ক্যাডারে আকৃষ্ট হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা— এমন প্রশ্ন রাখা হয় দেশের নামকরা কয়েকটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষকদের কাছে। তারা জানান, দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে চিকিত্সা পেশায় না থাকার জন্য বেশিরভাগ অভিভাবকই তাদের সন্তানদের নিরুত্সাহিত করছেন। এমনকি কিছু অভিভাবক মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নি করতেও বাধা দিচ্ছেন।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সর্বশেষ ব্যাচের প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী করোনা পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণে ইন্টার্নিতে যোগ দেননি। যদিও মেডিকেল কর্তৃপক্ষ সার্টিফিকেট না দেয়ার ভয় দেখিয়েছে তবুও শিক্ষার্থীরা ইন্টার্নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তারপরও মেডিকেল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নিতে যোগদানের ব্যাপারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
একাধিক মেডিকেল শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে চিকিত্সকদের নানামুখী ঝুঁকির কারণে শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকরা এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাই পড়াশোনা শেষে বিসিএসে অন্যান্য ক্যাডারে যাওয়ার আগ্রহ তৈরি হচ্ছে।
পরিবার থেকেও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের এই পেশায় যোগদানে নিরুত্সাহিত করা হচ্ছে। মা-বাবারা চাচ্ছেন না, তাদের সন্তান ঝুঁকির মুখে পড়ুক। চিকিত্সা ব্যতীত অন্য যেকোনো পেশায় যেতে সন্তানকে উদ্বুদ্ধ করছেন তারাও।
কথা হয় কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে। তারা বলেন, মেডিকেলে যারা পড়ে তারা অত্যন্ত মেধাবী। শুধু চিকিত্সা পেশা কেন, তারা অন্য পেশায়ও যেতে পারে। তাছাড়া চিকিত্সার চেয়ে অন্য পেশায় এখন সম্মান বেশি, সুযোগও বেশি। তাই তাদের সন্তানদের এখন পছন্দের যেকোনো পেশায় যেতে উদ্বুদ্ধ করছেন। এছাড়া বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে চিকিত্সা পেশায় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, বেড়েছে মৃত্যুঝুঁকিও। এ কারণে তাদের সন্তানদের চিকিত্সা পেশায় থাকতে উত্সাহ দেখাচ্ছেন না।
চিকিত্সকরা অন্য ক্যাডারে যেতে পারেন, তবে এ হার যদি বেশি হয় সেটি উদ্বেগের— উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক জাগো নিউজকে বলেন, চিকিৎসকরা অন্য পেশায় যেতেই পারন। কারণ একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর যেকোনো পেশা বেছে নেয়ার অধিকার আছে। যদি বিসিএসে কেউ প্রথম হয় তাহলে সে যে পেশায় যেতে চায় তাকে সে পেশা দিতে হবে। তবে খুব বেশি হারে যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে বিষয়টি উদ্বেগের।
এ বিষয়ে কথা হয় গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পরীক্ষা-কেন্দ্রিক লেখাপড়ার কারণে আমাদের মূল্যবোধের চর্চা অনেকটা কমে এসেছে। যে কারণে ডাক্তাররা এই পেশা ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছেন। বিষয়টা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কারণ তাদের জন্য পরিবারের, সমাজের এবং রাষ্ট্রের বিনিয়োগ রয়েছে। তাদের দায়িত্ব সমাজের ঋণ শোধ করা। এই ব্যাপারে কোনো ঘাটতি থাকা উচিত নয়।’
‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন ডাক্তারদের চিকিৎসা পেশায় টিকিয়ে রাখতে পারে’ বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. হারিসুল হক। তিনি বলেন, ‘ডাক্তারদের পেশা বদলানো নতুন কিছু নয়। করোনাভাইরাসের কারণে ভবিষ্যতে এই পেশা আরও বেশি ঝুঁকির মুখে পড়বে বলেও মনে হচ্ছে। তবে এ থেকে উত্তরণের জন্য অবশ্যই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন করতে হবে। ডাক্তাররা চিকিত্সা ক্যাডারে যাওয়ার পর অন্যান্য ক্যাডারদের যে আমলাতান্ত্রিক সুবিধাগুলো আছে, সেগুলো যদি ডাক্তাররাও পান তাহলে চিকিত্সা পেশায় শিক্ষার্থীদের আগ্রহ আরও বাড়বে।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে এক লাখের বেশি চিকিত্সক নিবন্ধন নিয়েছেন। বর্তমানে সরাসরি চিকিত্সা পেশায় যুক্ত এমন চিকিত্সকের সংখ্যা (সরকারি ও বেসরকারি) ৬০-৭০ হাজার। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিত্সক রয়েছেন মাত্র ২৫-৩০ হাজার। কিন্তু দেশের জনসংখ্যা ও রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় কমপক্ষে দুই লাখ চিকিত্সক প্রয়োজন।
সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সূত্র অনুযায়ী, দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পাঁচ বছরের এমবিবিএস ডিগ্রি নিতে একজন শিক্ষার্থীর ব্যয় হয় ১৮-২০ লাখ টাকা। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রতি শিক্ষার্থীর পেছনে সরকারের ব্যয় ১৫ লাখ টাকার মতো। এমন পরিস্থিতিতে মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা অন্য পেশায় চলে গেলে স্বাস্থ্যসেবার মানের তো উন্নয়ন হবে-ই না উল্টো তাদের পেছনে ব্যয়িত অর্থ বৃথা যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
চিকিৎসা পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাওয়াকে ‘স্বাভাবিক’ বলছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, চিকিত্সা পেশায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা আসলেও তারা যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছেন না। এ কারণে মেডিকেল শিক্ষার্থীরা চিকিত্সা পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
তিনি বলেন, একজন প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা বিসিএস পাস করে যোগ দেয়ার পর পর্যায়ক্রমে তার পদোন্নতি হতে থাকে। অথচ একজন চিকিত্সকের পোস্ট গ্রাজুয়েট না করলে পদোন্নতি হয় না। চার বছরের কোর্স শেষ করতে অনেক সময় আট থেকে দশ বছর লেগে যায়। এ কারণে বাধ্য হয়ে সে অন্য ক্যাডার বেছে নিচ্ছে।
মহাসচিব আরও বলেন, চিকিত্সকরা মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়ার পরও প্রশাসন ক্যাডারের অধীনস্থ হয়ে থাকতে হয়। এটি তাদের জন্য অমর্যাদাপূর্ণ। এ কারণে মেডিকেল শিক্ষার্থীরা সম্মানজনক পেশা বেছে নিচ্ছেন। একজন উপসচিব হয়ে যে সুযোগ-সুবিধা পাবেন, ৩০ বছর পর একজন চিকিত্সক অধ্যাপক হয়ে সে সুযোগ-সুবিধা পান না। এছাড়া বর্তমান করোনা মহামারির কারণে অনেকে এ পেশা থেকে সরে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন।
তিনি আরও বলেন, বিষয়টি নিয়ে এখনই চিন্তা করার সময় এসেছে। সরকার যদি এটাকে গুরুত্ব না দেয় তাহলে ভবিষ্যতে নিম্ন গ্রেডের শিক্ষার্থীরা চিকিত্সা পেশায় আসবেন। এতে দেশের মানুষ ভালো চিকিত্সক থেকে বঞ্চিত হবেন।