মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
ছাপান্ন.
ওটা একটা অন্যতম কারণ ছিল যার জন্য আমার অফিসের যে কোনো যোগাযোগ বা মতবিনিময়ের ব্যাপারে আমি খুবই গুরুত্বের সাথে নিজেই দায়িত্ব পালন করতাম। সত্যি বলতে কি, এ ব্যাপারে বেশির ভাগ সংসদ সদস্যই সাধারণ মানুষের সাথে ভালোভাবে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব পালন করতেন, কিন্তু ব্যাপারটা তখন আমার জন্য একটু বেশি চ্যালেঞ্জ হয়ে গিয়েছিল। পার্লামেন্ট হিল এ চিঠি পাঠানোর জন্য কোন ডাকটিকিটের প্রয়োজন পড়ে না। ফলে কানাডার যে কেউ তার বিশেষ প্রয়োজনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা বা যে কোন পার্লামেন্ট সদস্যের কাছে অনায়াসে তার চিঠি পাঠাতে পারে। আমি মনে করি, এই ব্যবস্থাটা সুন্দর একটা দেশ গড়ার জন্য খুবই প্রয়োজন। নাগরিকদের অসুবিধার কথা দেশ পরিচালনার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে এটা খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। ফলে পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে আমার প্রথম দিন থেকেই কানাডার বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য চিঠি আমি পেতে শুরু করি।
পার্লামেন্ট অফিসে আমার যে লোকবল ছিল তাদের ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি কাজ আমার অফিসে জমা হতে শুরু করে, আর আমার পাপিনিউ অফিস তখন আমার ঐ সংসদীয় এলাকার বিভিন্ন কাজকর্ম নিয়ে পুরোদমে ব্যস্ত হতে থাকে। আমার এই অবস্থায় আমাকে হাঁফ ফেলার জন্য এলেক্স এসে হাজির হয়েছিল। তার সাথে আলাপ করে চিঠিপত্রের এই যোগাযোগের কাজ করার জন্য ভলান্টিয়ার্স, ইন্টার্ন্স আর ছাত্রদের সপ্তাহে কয়েক ঘন্টা কাজ করার জন্য আহ্বান জানাতে লাগলাম। সংসদীয় রাজনীতির বিষয়টা কাছ থেকে দেখা আর কাজের অভিজ্ঞতার ঝুলিটা ভারী করার জন্য অনেকেই আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে বস্তা বস্তা চিঠির উত্তর দিয়ে আমাদের কাজের একটা সুন্দর গতি এনে দিয়েছিল।
আমি যখনই কোন অনুষ্ঠানে বা দলের কোন কাজে যেতাম, তখনই অনেক তরুণ তরুণীই আমার কাছে এসে তাদের রাজনীতি করার ইচ্ছা ব্যক্ত করতো, তখন আমি তাদেরকে শুধু বলতাম, তোমরা যদি সত্যি সত্যিই রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হতে চাও তাহলে আমার অফিসে এসে জনগণের জন্য কাজ করো, আর এই কাজের মধ্য দিয়ে জেনে নাও রাজনীতি করতে হলে তোমাদের কিভাবে নিজেদেরকে তৈরী হতে হবে। কয়েকদিনের মধ্যেই আমার তিন রুমের অফিসটা নতুন নতুন ভলিন্টিয়ার্স এ ভরে গেলো। নতুন এই সব ভলিন্টিয়াররা জিজ্ঞাসু মানুষের সমস্যা আর প্রশ্নের উত্তরগুলো তৈরী করে খামে ভরে সেই সব চিঠিগুলো যথা সময়ে সবার কাছে পাঠিয়ে দিতো। আমার অফিসের সব কম্পিউটারের সামনে এমনকি আমার ডেস্কে বসেও তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ শুরু করে দিলো। এই দৃশ্যটা দেখে আমার মনটা ভরে যেতো। তবে সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছিল, এই নতুন কর্মীবাহিনী যে কাজগুলো করতো তা জনগণের সমস্যা বা প্রশ্নের উত্তরগুলো দেবার জন্য খুবই ফলপ্রসূ হয়েছিল, আর পার্লামেন্ট হিল এর যে বদনাম ছিল যে, গণপ্রতিনিধিরা সাধারণ মানুষের কথা শুনে না বা তাদের সাথে ভালোভাবে যোগাযোগ রাখে না, সেটা অনেকটা ঘুচে গিয়েছিল।
সেই সময় আমার সামনে আরেকটা যে নতুন চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হলো, তা হচ্ছে আমার দিকে গণমাধ্যম কর্মীদের দৃষ্টিটা বেশি পড়ে গেলো। দেখা গেলো অন্যান্য সব পার্লামেন্ট সদস্যের চেয়ে আমাকে অনেক বেশি টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে হচ্ছিল। আমার নিজ সংসদীয় এলাকায় নির্বাচনে দাঁড়ানোর আগে প্রায় দেড় বছর আমি যেভাবে প্রায়ই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তাদের বিভিন্ন ধরনের কুটিল প্রশ্নের উত্তর দিতাম বা যেভাবে তাদের সাথে কথা বলে তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করতাম, সেইভাবেই আমি গণমাধ্যম কর্মী বা ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে আমার আসল লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকলাম। নিঃসন্দেহে পাপিনিউ থেকে আমি তিল তিল করে অনেক কিছু শিখেছিলাম। আমি পাপিনিউ’র মানুষের আশা আকাংখা, দুঃখ কষ্ট আর স্বপ্নের কথা জানতাম। আমি এটাও জানতাম, কিভাবে তাদের এই স্বপ্নের পথে এগুনোর জন্য আমাকে কাজ করতে হবে। সেই সাথে আমার ঐ অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছিল, গণমাধ্যম ব্যক্তিদের ক‚টচালে না পড়ে কিভাবে সুন্দরভাবে তাদের সাথে কথা বলে নিজের ধ্যান ধারণা আর লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হয়। আমার এই কাজে তারা অনেকেই আমার প্রতি মুগ্ধ হয়ে তাদের সংবাদে বা আমার সাথে সাক্ষাত্কারের কথা উল্লেখ করে প্রায়ই বলতো, ‘পার্লামেন্ট হিল এ নতুন ট্রুডোর আবির্ভাব হয়েছে।’
কিন্তু পাপিনিউ থেকে নির্বাচন করার সময় আমি যে অমানুষিক পরিশ্রম করেছি সেটা কিন্তু একজন ভালো পার্লামেন্টারীয়ান হওয়ার পথে এগিয়ে যাবার জন্য পথ দেখিয়েছে। এ মুহূর্তে আমার একটা সাক্ষাত্কারের কথা মনে পড়ছে, যেখানে আমি দেখেছিলাম, একজন সফল উদীয়মান অভিনেতাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে তার কাছে সফলতা ব্যাপারটা কেমন। এ প্রশ্নের উত্তরে সে বলেছিল, সে নিজেকে সত্যিই অনেক বেশি সফল ও সৌভাগ্যবান মনে করে যখন সে দেখে, সে যে কাজ করতে ভালোবাসে সেই কাজটাই করার সুযোগ পাচ্ছে। সে একটু থেমে আর একটু হেসে আবার বলেছিল, নিজেকে তার সত্যিই সফল মনে হয়ে যখন সে লক্ষ্য করে, তাকে একটু দেখার জন্য যখন সবাই আকুল হয়ে থাকে, বিশেষ করে সে যখন দেখে কেউ তার দরজায় টোকা দিলো এবং সে দরজা খুলে দেখলো অপরিচিত কোন একজন। সেই অপরিচিত জনকে কিছু বলার আগেই যখন সেই অপরিচিত ব্যক্তিটি ভুল দরজায় টোকা দেবার জন্য ক্ষমা চাইতে থাকে। আসলে সেই অপরিচিত ব্যক্তিটি ভুল কোন দরজায় টোকা দেয় নি, বরং সে চেয়েছিল তাকে শুধু এক নজর দেখতে। সেই অভিনেতা এমনভাবেই তার সফলতাকে ব্যাখ্যা করেছিল। আমার মনে হয়, আমরা সবাই আমাদের সফলতার স্বরূপটা বলতে গেলে এমনভাবে বলতে পারি, যা অন্যের ভিতরে এক ধরনের ভালো লাগা আর ভালোবাসার স্থান তৈরি করে।
কিন্তু যেদিন প্রথম আমি সংসদ সদস্য হিসেবে পার্লামেন্ট হিল এ পা রেখেছিলাম, সেদিন থেকেই নিজেকে সফল ভাবার কোন চিন্তায় আমার মাথায় ঢুকেনি। আমার নামের শেষ অংশটার জন্য অথবা আমার প্রতিপক্ষরা আমার সম্পর্কে কী বললো, অথবা অনেকেই আমাকে একটু দেখতে চাই কি না, এমন কোন কিছুই তখন আমার কাজে বা চিন্তায় ছিল না। কিন্তু আমার মাথায় সব সময় যেটা ছিল, তা হচ্ছে, আমি জানতাম দলের মনোনয়ন পেতে আমাকে কি কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে এবং কিভাবে আমার এলাকার ভোটারদের মন জয় করতে হয়েছে এবং তাদেরকে বুঝাতে হয়েছে যে, আমি সত্যিই তাদের মঙ্গলের জন্য কিছু করতে চাই। আমার এই কঠোর পরিশ্রম আর স্বপ্নই আমাকে কানাডার পার্লামেন্টের একটি আসনে বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এটা আমার পরম অর্জন। এই অর্জনটা আমার কাছে এত বেশী শক্তিশালী যে কেউ ইচ্ছে করলেই আমাকে এখান থেকে ছুঁড়ে ফেলতে পারবে না। প্রথমে মনোনয়ন, তারপরে নির্বাচনে জেতার জন্য আমাকে যে কঠিন লড়াই করতে হয়েছে এবং সেই লড়াইয়ের জন্য যে আমি নিজেকে তিল তিল করে তৈরী করেছি, তার ফলে আমার মনেই হয়েছিল আমি আমার এই কাজ আর পদের জন্য একজন পুরো যোগ্য ব্যক্তি।
যখন গণমাধ্যমের বিষয়টা আসতো, তখন আমার প্রধান লক্ষ্যই থাকতো আমাকে কিভাবে গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে হবে এবং আমার শব্দ চয়ন এবং প্রকাশভঙ্গী কেমন হবে। বিশেষ করে পার্লামেন্ট এর করিডোর দিয়ে হাঁটার সময় যখন সাংবাদিকরা ছেঁকে ধরতো এবং নানান উল্টাপাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতো, সেই সব প্রশ্নের উত্তরগুলো দিতে হতো একদিকে যেমন দ্রুত তেমনি অপরদিকে খুবই যথার্থভাবে। আমি নিজেকে সব সময়ই একজন নম্র মানুষ হিসেবে মনে করি এবং আমার বেড়ে উঠাতে অবচেতনভাবেই বিনয় আর নম্রতার ব্যাপারটা আমার দেহমনে ঢুঁকে গেছে। ফলে যে কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হলেই আমি আমার স্বভাবসূলভ হাসি হেসে অল্প কথায় আসল প্রশ্নটার উত্তর দেবার চেষ্টা করতাম, তারপর যদি সেটার ব্যাখ্যা দেবার প্রয়োজন পড়তো, তবে আমি যুক্তি ও ব্যাখ্যা দিয়ে সেটার উত্তর দিতাম। আমার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাটাকে আমি এখানে কাজে লাগাতাম। আমি প্রশ্নকারীকে এমনভাবে উত্তর দিতাম যে মনে হতো একজন শিক্ষক যিনি এই বিষয়টা সম্পর্কে অনেক ভালো জ্ঞান রাখেন এবং প্রাসঙ্গিক যুক্তি ও উদাহরণ দিয়ে তিনি বিষয়টা তার ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করছেন।
কিন্তু সেই পার্লামেন্টের পরিবেশে বেশীর ভাগ সময়ই সাংবাদিকরা দীর্ঘ কোন কথা বা ব্যাখা নিতো না, বরং তাদের সংবাদের শিরোনামের জন্য বা টিভি’তে চার সেকেন্ডের কোন ক্লীপের জন্য কিছু কথা বা বক্তব্য শুনতে চাইতো। এই সব ক্ষেত্রে একজন রাজনীতিবিদ যত বেশী কথা বলতো, তার কথায় ততবেশী সংবাদের খোরাক বের হয়ে যেতো, আর সেগুলোর জন্য সাংবাদিকরা ওত পেতে থাকতো। কারণ কথা বা ভাষ্যের একটু এদিক ওদিক হলেই সেটা হয়ে পড়তো সংবাদের শিরোনাম আর যেটা যে কোন ক্ষেত্রে হৈ চৈ আর আলোড়ন সৃষ্টির জন্য যথেষ্ঠ হয়ে যেতো। সেই কারণে যখনই আমার সাথে সাংবাদিকরা কথা বলতো, আমি সব সময় লক্ষ্য রাখতাম, সেই কথাটা দশ পনেরো মিনিট হোক বা অনেক ছোট হোক না কেনো। আমি প্রাসঙ্গিক কথা বলে এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করতাম যেটা দিয়ে তারা নেতিবাচক কোন শিরোনামের চিন্তা না করে ইতিবাচক শিরোনাম ব্যবহার করে তাদের সংবাদ প্রচার করতে পারে। আমি সাধারণত সাংবাদিকদের সাথে কথা বলাটা উপভোগই করতাম। আমার এই উপভোগ্য কথা বা কথোপকথনে অনেকেই আনন্দ পেতো এবং আমি লক্ষ্য করতাম, আমাকে বেশিরভাগ সাংবাদিকই ইচ্ছে করে শুধু ঘোরপ্যাঁচের কথার দিকে আর নিয়ে যেতো না। (চলবে)