মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
মনিস রফিক
ঊনষাট.
কিন্তু মাঝে মধ্যেই দেখা যায়, রাজনীতিতে প্রায়ই বাস্তবতা আর সত্যকে কিছু অনুমান আর মিথ্যা পরাজিত করে ফেলে। আমরা আমাদের আসল বক্তব্য আর সত্যিকারের কাজের লক্ষ্যকে সঠিকভাবে মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম। আমাদের এই ব্যর্থতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল, যখন টেলিভিশনে মি. হারপার তাঁর কিছুটা বানানো বক্তব্য নিয়ে জনগণের সামনে নিজেকে তুলে ধরলেন, তখন আমরা সত্যের কাছে থেকেও তেমন কিছুই করতে পারিনি। মি. হারপারের বক্তব্যের পর পরই স্টিফেনী ডিওনের একটা বলিষ্ঠ আর মিথ্যার ঘোরপ্যাঁচ উম্মোচিত করার মত এক বক্তব্যের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু তাঁর প্রচার মাধ্যমে যারা কাজ করছিল, তারা তৎক্ষণাৎ তেমন কোন ভূমিকাই পালন করতে পারে নি। পরের সন্ধ্যায় যখন সেই প্রত্যাশিত বক্তব্য টেলিভিশনে প্রচার করা হল, তখন ডিওনের কথাগুলোর উপস্থাপনে এমন একটা অপেশাদারিত্বের ছাপ ছিল যে মনে হচ্ছিল, কোন একটা সস্তা সেল ফোনে সেটা ধারণ করা হয়েছে। এটার জন্য হয়ত কাউকেই ওভাবে দোষারোপ করা যাবে না, কিন্তু যেহেতু ডিওন ছিলেন দলের প্রধান নেতা, সেজন্য কোনভাবেই এটা থেকে তিনি রেহাই পাবেন না। ফলে যা হবার তাই হল, আমরা একেবারেই ধরাশায়ী হয়ে পড়লাম। আর পরের দিন গভর্ণর জেনারেল স্টিফেন হারপারের সংসদ অধিবেশন ডাকার অনুরোধের অনুমতি দিলেন, ফলে আমাদের খেলা সেই বারের মত খতম হয়ে গেল।
সেই সন্ধ্যাতেই আমার ও অন্যান্য লিবারেলদের কাছে একটা বক্তব্য একেবারে সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, শুধু একটি দলের মূল্যবোধ আর স্বপ্ন থাকলেই চলবে না, তাদের সেই স্বপ্ন আর মূল্যবোধকে একেবারে পেশাদারীত্বের সাথে সঠিকভাবে সবার কাছে পৌঁছিয়ে দিতে হবে।
চারদিন পর স্টিফেনী ডিওন দলের প্রধান থেকে পদত্যাগ করলেন। এর ফলে আবার দলের নতুন নেতা নির্বাচনের জন্য একটা দলীয় কনভেনশনের প্রয়োজন দেখা দিল। ২০০৯ সালের মে মাসে ভ্যাংকুভারে এই আয়োজনের ব্যবস্থা হল। দলের নতুন নেতা হবার দৌড়ে মাইকেল ইগনাতিয়েফ, বব রে এবং দোমিনিক লেবø্যাংক অংশ নেয়ার ইচ্ছাপোষণ করলেন। কেউ কেউ আমাকেও এই দৌড়ে অংশ নেওয়ার জন্য দলের কাছে আমার নাম প্রস্তাব করেন, কিন্তু সেই মুহূর্তে দলের ওমন এক গুরুত্বপূর্ণ পদে যাবার আমার কোন ইচ্ছে ছিল না। সত্যি বলতে কি আমার রাজনৈতিক জীবনের এত শুরুতে আমি দলীয় নেতৃত্বের কোন ধরনের কোন্দলে জড়াতে চাইনি। বরং সেই মুহূর্তে নিরপেক্ষভাবে সেই কনভেনশনের কো-চেয়ার হওয়াটাই আমার কাছে অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল। এদিকে দলের নীতি নির্ধারকদের পরামর্শে দোম ও বব রে খুব দ্রæতই এই দৌড় থেকে সরে দাঁড়ালেন, ফলে আমরা বুঝেই গেলাম, মাইকেল ইগনাতিয়েফ’ই হতে যাচ্ছেন লিবারেল পার্টি অব কানাডার নেতা।
![](https://i0.wp.com/www.banglakagoj.com/wp-content/uploads/2023/02/Bk-5.jpg?resize=696%2C522&ssl=1)
মি. ইগনাতিয়েফ অনেক গুণে অভিজ্ঞ ছিলেন। মাইকেল একাধারে ছিলেন চিন্তাশীল আর মানুষকে উথাল পাথাল করে জাগানো এক নেতা, সেই সাথে বিভিন্ন জনপদ ও দেশে তাঁর দীর্ঘ ভ্রমণ মানুষ ও পরিবেশ সম্পর্কে তাঁর মধ্যে এক বুদ্ধিবৃত্তিক মনন তৈরী করেছিল যা তাঁকে এমন একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিল যার দ্বারা বিশ্ব রাজনীতির যে কোন কঠিন বিষয় সুন্দরভাবে সমাধান করার দার্শনিক পথ বের করা সহজেই সম্ভব ছিল। আমি লক্ষ্য করেছিলাম, বাবার অনেক গুণের প্রতিফলন ছিল তাঁর চরিত্রে। সত্যি বলতে কি, রাজনীতির অঙ্গনে নেতা হিসেবে কাজ করার অনেকগুলো গুণই মাইকেল রাজনীতিতে প্রবেশ করার আগেই রপ্ত করে এসেছিলেন। সেই জন্য আমার বরাবরই মনে হয়েছিল, যেখানে অন্যান্য লিবারেল নেতারা পার্টিকে বারবার ব্যর্থতার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, সেখানে আমরা কেন তাঁর মত একজনকে দলের নেতা নির্বাচিত করবো না যিনি একজন সফল প্রধানমন্ত্রী হবার ক্ষমতা রাখেন।
কিন্তু মাইকেলের একটা বিষয়ে কিছুটা ঘাটতি ছিল। তা হচ্ছে, তিনি কানাডার রাজনীতির আসল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটা ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারেননি, সম্ভবত দীর্ঘদিন দেশের বাইরে অবস্থান করার ফলে এই বিষয়টায় তাঁর একটু ঘাটতি পড়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, এটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় দূর্বলতার দিক। তারপরও বলতে হয়, তাঁর সেই সময়টা এত খারাপ নাও হতে পারতো। তিনি লিবারেল পার্টির নেতৃত্ব নিতে কানাডায় ফিরেছিলেন সম্ভবত দলের সবচেয়ে ক্রান্তির সময়ে, যেমনটি উনিশ’শ সালের শুরুতে লুরিয়েরকে নেতৃত্ব গ্রহণ করার সময় নিতে হয়েছিল। মাইকেল মুখাপেক্ষী হয়েছিলেন হারপারের কনজারভেটিভদের যারা মিথ্যাকে সত্য বলে বানাতে ওস্তাদ ছিল আর যারা অবলীলায় প্রচার মাধ্যমকে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করে বাজে খেলা খেলতে পারদর্শী ছিল। আমার মনে হয়, কানাডার মানুষ ইতিপূর্বে কখনও এমন খেলা দেখে নি। টরীরা যখন মাইকেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো তখন লিবারেলরা অনেক বিষয়েই পিছিয়ে ছিল, বিশেষ করে দলের কার্যক্রম চালানোর মত অর্থ সংগ্রহ করার আধুনিক কৌশল ও দক্ষতা তাদের ছিল না। ফলে কনজারভেটিভদের সাথে লড়াই চালাতে গিয়ে লিবারেলদের হোঁচট খেতে হচ্ছিল।
সব কিছুর ওপরে লিবারেলদের যে সমস্যা ছিল, তা হচ্ছে তারা কানাডার মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল, আর তারা নিজেদের মধ্যে অন্তর্কলহেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এর চরম মূল্য আমাদেরকে দিতেও হয়েছিল।
![](https://i0.wp.com/www.banglakagoj.com/wp-content/uploads/2023/02/Bk-4.jpg?resize=516%2C751&ssl=1)
সেই সময় কোন লিবারেল সদস্যই ধারণা করতে পারছিল না ২০১১ সালের মে’র নির্বাচনে আমাদের অবস্থা কেমন হবে। শেষ ভোট গণনা শেষ হলে আমরা দেখেছিলাম, আমরা মাত্র ৩৪টি আসন পেয়েছি। স্টিফেন হারপারের কনজারভেটিভরা শেষ পর্যন্ত ১৬৬ আসন পেয়ে পার্মামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। আর জ্যাক লেটন এর এনডিপি ১০৩টি আসন পেয়ে আমাদেরকে তিন নম্বর দলে পরিণত করেছিল।
আমি পাপিনিউ থেকে আবার নির্বাচিত হয়েছিলাম, কিন্তু সেই নির্বাচনের রাতটা আমাদের দলীয় কর্মী ও ভলান্টিয়ারদের কাছে ছিল অন্তোষ্টিক্রিয়ার এক কালো রজনী। পার্টির ১৪৪ বছরের ইতিহাসে লিবারেলরা সবচেয়ে অপমানজনক এক হার হেরেছিল। তখন আমার চিন্তায় বারবার মনে হচ্ছিল, এই পরাজয়ের কবর দীর্ঘদিন ধরে রচিত হয়েছে এবং এর পেছনে অনেক গুরুতর ভুল রয়ে গেছে। তবে সত্যি বলতে কি, লিবারেলদের এই করুণ পরাজয়ে আমি কোন রকম বিস্মিত হইনি। আমি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছিলাম, দেশের মানুষের সাথে পার্টির সংযোগ ও সম্পর্ক একেবারে ক্ষীণতর অবস্থায় পৌঁছেছিল, ফলে পার্টি থেকে সাধারণ মানুষদের মুখ ফিরিয়ে নেয়াকেই এই পরাজয়ের এক অপরিহার্য মূল কারণ বলে ধরে নেয়া যায়।
সেই নির্বাচনের রাতে বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী আর নির্বাচন বিশ্লেষক এমন প্রশ্ন করেছিল, লিবারেল পার্টি কি সত্যি সত্যি টিকে থাকতে পারবে? আসলে সেই মুহূর্তে এটা কোন অতিরঞ্জিত বচন ছিল না। মাত্র সাত বছরে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্ষমতাশীল দল থেকে একেবারে তৃতীয় স্থানে গিয়ে নেমেছিলাম। আমাদের নেতা তাঁর নিজের আসনে হেরে গিয়েছিলেন। সেটা ছিল এক চরম হতাশাজনক পরিস্থিতি। এমন এক ক্রান্তিকালে, কানাডার লিবারেল পার্টির সদস্যদের বিষন্ন ঝাপসা চোখে আগামীর দিকে তাকানো ছাড়া আর কিছুই ছিল না। (চলবে)