মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
একাত্তর.
২০১২ সালের মাঝামাঝি ছিল আমার জীবনে এক গভীর চিন্তার সময়। রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যাবে এমন আশায়, লিবারেল পার্টির নেতৃত্বটা তখন হয়ে উঠেছিল একটা লোভনীয় ব্যাপার। সেই সময় বব রে’কে এই নেতৃত্বের একজন যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হচ্ছিল, তারপরেই নাম আসছিল সেই সময়ের অন্টারিও’র প্রিমিয়ার ডালটন ম্যাকগুয়িন্টির নাম। এমনও শোনা যাচ্ছিল, একটি দল ব্যাংক অব কানাডার চৌকস গভর্নর মার্ক কারনে’কে লিবারেল পার্টির নেতৃত্বের জন্য ঠিক করেছে। এ ছাড়াও আরও কিছু নাম যেমন ফ্রাংক ম্যাককেনা এবং জন ম্যানলি’র নাম সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছিল। আমি আরও কয়েকটি নাম বলতে পারি যাদের নাম সেই সময় আলোচিত হচ্ছিল, তাদের মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়, বর্তমান ও প্রাক্তন ককাস সদস্য মার্ক গারনিউ ও মার্থা হল ফিন্ডলে’র নাম যারা জোরেসোরে জানান দিচ্ছিল, তারা একসঙ্গে এই নেতৃত্বে আসার জন্য কাজ করবে।
আমি যখন মনে মনে ঠিক করেছিলাম, আমি নিজেই লিবারেল পার্টির নেতৃত্বের জন্য লড়বো, তখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এই নেতৃত্ব নিয়ে যারা লড়াই করবে, সে যেই হোক না কেন তাদের নিয়ে বেশি চিন্তা করে আমার সময় নষ্ট করা উচিৎ হবে না। নেতৃত্বের দৌড়ে থাকা বা যারা ইতিমধ্যে নিজেদের এই দৌড় থেকে সরিয়ে নিয়েছেন, এদের সবাইকে আমি ভালোভাবেই জানতাম এবং তাদের সবার প্রতিই আমার গভীর শ্রদ্ধাবোধ ছিল। কিন্তু সেই সময় দলের অভ্যন্তরের এই লড়াই বা দৌড়ের চেয়ে আরও বেশ কিছু বিষয় আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি বারবারই চাচ্ছিলাম এই নেতৃত্বের লড়াইয়ে আমাদের প্রচারণার ধরণটা কেমন হবে। নেতৃত্বে পৌঁছানো এবং এর পর আমাদের কাজ বা কর্মসূচী কেমন হবে সেই বিষয়টার প্রতিও স্পষ্ট বক্তব্য থাকার প্রতি আমি জোর দিচ্ছিলাম। একেবারে অতি প্রয়োজন থেকেই আমি উপলব্ধি করেছিলাম, শুধু মাত্র নেতৃত্বে জয়ী হলেই আমাদের তেমন কিছু হবে না, বরং তার পর লিবারেল পার্টিকে কোন পথে নিয়ে যাওয়া হবে সে ব্যাপারে একটা স্বচ্ছ ধারণা সবার থাকা উচিৎ এবং সবাইকে সেই ব্যাপারটা খোলাখুলিভাবে জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের যদি সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেবার কোন ব্যাপার চলে আসে, তাহলে আমাদেরকে দৃঢ়ভাবে নিজেদেরকে তৈরী করতে হবে এবং এই প্রস্তুতি পর্ব শুরু করতে হবে এই নেতৃত্বের পর্ব থেকে। নেতৃত্বে জেতার জন্য আমাদের কী কী করতে হবে সেটা ঠিক বা চুড়ান্ত করাই আমাদের জন্য যথেষ্ঠ নয়, বরং আমাদের ঠিক করা উচিৎ আগামী ২০১৫ সালের ফেডারেল নির্বাচনে জেতার জন্য আমাদের কী করা উচিৎ। এই নেতৃত্বের লড়াই এবং যোগ্য কাউকে এই নেতৃত্বের জন্য নির্বাচিত বা মনোনীত করা হচ্ছে এই পদক্ষেপের সামনে এগুনোর প্রথম ধাপ।
আমরা জানতাম, এই প্রচেষ্টাটা খুব একটা সহজ নয়। অধিকাংশ নেতৃত্বের প্রচারণা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ এক প্রতিযোগিতা যার মূল লক্ষ্য থাকে দলকে সামনে এগিয়ে নেবার জন্য যে ট্রেন তৈরী থাকে সেটার দায়িত্ব নেয়া। যিনি নেতা হবেন তিনি সেই ট্রেনের চালকের আসনে বসবেন এবং তিনি যদি সত্যি ভাগ্যবান হন, তাহলে সেই ট্রেনটিকে সঠিক গন্তব্যে নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন। সেই সময় আমার বারবার মনে হচ্ছিল, এবারের প্রচারণাটা হবে একেবারে আলাদা, আমার এটাও মনে হয়েছিল, আমার পার্টির ইতিহাসে এটা হবে একেবারে নতুন কিছু। এই ট্রেনে যারা যাত্রী হবে তাদের কাছে আমাদেরকে যেতে হবে, তারা যে রকম ট্রেনে চড়তে চাই, আমাদেরকে সেই ধরনের ট্রেন নির্মাণ করতে হবে এবং একই সাথে সব পথেই আমাদেরকে সেই ট্রেনটা নিয়ে যেতে হবে। আর এই কারণেই বিশেষভাবে প্রয়োজন সেই অশেষ আশা আর কঠোর পরিশ্রম। এর জন্য আমাদের দরকার একটা বস্তুনিষ্ঠ কর্ম পরিকল্পনা আর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যা এই সব মানুষের ঈপ্সিত কাজ সফলভাবে শেষ করতে সহায়তা করবে।
শিক্ষাকতার বছরগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে আর পাপিনিউ’তে প্রচারণা চালাতে গিয়ে আমি ভালভাবেই শিখেছি কিভাবে বিভিন্ন ধরনের সব মানুষকে ও তাদের মেধাকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যায়। সেই সাথে কিভাবে তাদের মূল্যবোধকে ঠিক রেখে তাদের স্বপ্ন ও শক্তিকে উজ্জীবিত করা যায়। আমি যে স্বাপ্নিক দৃষ্টি নিয়ে কাজ করছি, সেটা তাদেরকে উপলব্ধি করাতে চাচ্ছিলাম। আমি জানতাম, লিবারেল পার্টির নেতা হিসেবে এটাই হবে আমার আসল কাজ।
সব বস্তুনিষ্ঠ পরিকল্পনার মত, আমাদের সব কাজের খুব সাধারণ একটা হিসেব করলে বলা যায়; আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, সুন্দর সব ধারণা আর জনগণ, দল এবং পরিকল্পনা, আশা আর কঠোর পরিকল্পনা। সব কিছুর ওপর আমরা চেয়েছিলাম একটা জাতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে লিবারেল পার্টিকে পুনর্গঠিত করতে যেটা কানাডার প্রধান প্রধান সমস্যাগুলোর সুন্দর ও ফলপ্রসূ সমাধানের জন্য বস্তুনিষ্ঠ ও নিরবিছিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এটা নিশ্চয় নতুন ও চমৎকার সব ধারণা নিয়ে এগুবে আর এর সাথে যুক্ত হবে দেশের সব অংশ থেকে অসংখ্য সব মানুষ। যথার্থভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, আমরা জানতাম, এমন প্রচারণা ঠিক করে দিবে যিনি এই নেতৃত্বের দৌড়ে জিতবেন তিনিই লিবারেল পার্টিকে নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা রাখবেন।
আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী হলেও এটা ঠিক, আমি সব লিবারেলকে বলা শুরু করবো, আমরা যা ভেবেছি তার চেয়েও আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। বর্তমানে আমাদের পার্টি কয়েকটি রাস্তার এক মোড়ে এসে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু আমি সবার উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আমার প্রচারণা আর পরিকল্পনা যদি কেউ পছন্দ করে এবং কেউ যদি আমাকে ভোট দেয়, তবে তাদের উদ্দেশ্যে আমার বক্তব্য হচ্ছে, আমি খুবই দ্রুত সব কিছু ঠিক করে দিতে পারবো না। এর মানে আমি বুঝাতে চেয়েছিলাম, কোন কিছুর সত্যি সত্যিই ব্যাপক পরিবর্তন করতে হলে আমাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হবে আর ধৈর্য্য ধরতে হবে। নিঃসন্দেহে আমাদের ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে এটা আমাদেরকে সঠিকভাবে সামনে এগুতে সাহায্য করবে। আমরা কখনই কারো গভীর উদ্দীপনাকে থামিয়ে দিতে চাইনি, বা কারো আশাবাদকে খাটো করে দেখতে চাইনি। আমরা এই উদ্দীপনা আর আশাব্যঞ্জকতাকে জাগিয়ে রাখা আর স্বপ্নময় করার জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে চাই, আর নিঃসন্দেহে রাজনীতি আমাদের জন্য এই পরিবেশ তৈরীতে ব্যাপক ভ‚মিকা রাখবে। সেই সাথে একই সময়ে আমাদের সবার স্পষ্টভাবে মনে রাখতে হবে, শুধু প্রত্যাশাই আমাদের জন্য যথেষ্ঠ ছিল না, এবং আমরা সত্যিই জানতাম, সেটা একেবারেই যথেষ্ঠ ছিল না। সেটাকে সুষ্ঠুভাবে জিইয়ে রাখতে বা সেটাকে সম্মান জানাতে হলে দরকার ছিল আমাদের কাজের শাণিত নৈতিকতা এবং আমাদের মধ্যে এমন এক শৃংখলাবোধ সৃষ্টি করা এবং সেই অনুযায়ী কাজ করা যা প্রমাণ করে যে আমরা সঠিক ও প্রয়োজনীয় কাজের মধ্য দিয়ে সামনে এগুচ্ছি।
সেই সময় লিবারেল পার্টির নিস্ক্রিয়তায় কানাডার জনগণ ধরেই নিয়েছিল, দলটি তাদের চাওয়া পাওয়া থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে, সেই কারণে এই পার্টি যে হঠাৎ করে তাদের দেশ নিয়ে আশা দেখাবে সেটা অনেকের ধারণায় আসছিল না। এখন আমরা যদি আবার জনগণের সেই বিশ্বাস ফিরে পেতে চাই, তাহলে আমাদের আবার সেই পূর্বের ধারায় ফিরে যেতে হবে। সহজ কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, আমাদের কাজে কর্মে প্রমাণ করতে হবে, আমরা তাদের সাথেই আছি এবং আমরা জনগণের সার্বিক মঙ্গলের জন্য কাজ করতে চাই। সাহিত্যিক ভিক্টর হুগো যে চল্লিশ বছর বয়সকে বলেছিলেন, ‘যৌবনের বৃদ্ধাবস্থা’ সেই চল্লিশ বছরেই আমি আমার দলকে নম্র হয়ে এক নতুন আলো ঝরানো আগামীর কথা শুনিয়েছিলাম। আমি জানিয়েছিলাম, আমাদের সফলতা আসবেই, কিন্তু সেটার জন্য আমাদের অনেক কিছু করতে হবে। আমাদের প্রয়োজন নতুন এক যাত্রার, যে যাত্রায় থাকবে নতুন নতুন সব চিন্তাভাবনা, আর এগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য নতুন কিছু মানুষ। এই যাত্রায় আমাদের প্রথম যে কাজটি করতে হবে, সেটা হচ্ছে পার্টির যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে সেগুলোর প্রতি যথাযথভাবে আলোকপাত করা এবং কানাডার সাধারণ মানুষের স্বপ্ন, আশা ও চাওয়া পাওয়াকে সম্মান জানিয়ে সেগুলোকে সুন্দরভাবে ঠিক করা। আমি সবাইকে এটাও বলেছিলাম, আমার এই বক্তব্য যদি নিছক শ্লোগানের চেয়ে বেশী কিছু হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের এই যাত্রাকে সফল করার জন্য কানাডার সেই সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে লাখে লাখে মানুষকে আমাদের এই যাত্রায় শামিল করাতে হবে।
এই সব কিছু ভেবে ২০১২ সালের ২ ফেরুয়ারি আমার অকালে হারিয়ে যাওয়া সবচেয়ে ছোট ভাই মিশেলের সাইত্রিশতম জন্মদিনে পাপিনিউ’র একেবারে কেন্দ্রভ‚মির এক জনাকীর্ণ কমিনিউনিটি সেন্টার থেকে আমার নেতৃত্বের প্রচারণা শুরু করেছিলাম। সেদিন সোফি আর আমার সন্তানরা আমার একবারে পাশে বসেছিল। আমি সেদিন উপস্থিত সবার উদেশ্যে বলেছিলাম, আমি এই নেতৃত্বের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হলাম মূলত দুটি কারণে, যার একটি হচ্ছে কানাডার প্রয়োজন একটি নতুন নেতৃত্ব আর কানাডার জনগণের চাই নতুন এক পরিকল্পনা। আমি এটাও সবাইকে জানিয়েছিলাম, আমি যদি এই লড়াইয়ে বিজয়ী হই, তবে আমি যে পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগুবো, সেটা হবে কানাডার মধ্যবিত্ত জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি। আমি আরও বলেছিলাম, বর্তমান সরকার এ দেশকে সুন্দর করার জন্য তেমন কিছুই করতে পারে নি। আমাদের দেশের সৌন্দর্য্য, বৈচিত্রতা আর আমাদের পূর্বসূরীদের কাছ থেকে আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য যে সুন্দর একটি দেশ তৈরীর কাজ সেটা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। সর্বোপরি হার্পার সরকার আমাদের মধ্যে যে বিভেদ আর দ্ব›েদ্বর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে সেটা কোনভাবেই কানাডার জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। এখন আমাদের সময় হয়েছে এর অবসান ঘটানো। কানাডা পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় এক দেশ, আমাদের এমন এক নেতৃত্বের প্রয়োজন যা আমাদের দেশের এই স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের সামনে এগুতে সাহায্য করবে এবং আমাদেরকে বিশ্বের দরবারে মহিমান্বিত করবে। (চলবে)