মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

বাইশ.
১৯৯৪ সালে ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করার পর আমাকে যে বিশেষ সিদ্ধান্তের দোলাচলে পড়তে হলো তা হচ্ছে, আমি তখন কোন পথ ধরে সামনে এগুবো। আমার বয়স তখন মাত্র বাইশ আর কেবল মাত্র ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতক পাশ করেছি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বছরগুলোতেও আমি এমন কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম। যখন আমি ব্রেবফ এ পড়তাম, তখনো এই ধরনের সমস্যাগুলো আমাকে প্রায়ই ভাবাতো, কিন্তু সেই সময় আমি যে ধরনের নম্বর পেয়েছিলাম তাতে যে কোনো বিষয় নিয়ে পড়ার সুযোগ আমার ছিল।

আমি সে সময় সাহিত্যে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শুধুমাত্র পড়ার প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা থেকেই নয়, বরং এর ফলে আমি আমার উচ্চ শিক্ষা চালিয়ে যাবার পথ উন্মুক্ত করে রাখতে পারবো বলে। যদিও তখন আমি প্রথমে কী ডিগ্রী নিবো সেটা ঠিক করে ফেলেছিলাম, কিন্তু তখনও আমি ভাবিনি শেষ পর্যন্ত কী নিয়ে পড়াশুনা করবো। সত্যি বলতে কি, সেই সময়ে আমি মূলত যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলাম তা হচ্ছে, কোন পথ ধরে আমার সত্যিকারভাবে সামনে এগুনো উচিৎ।

সম্ভবত এই চ্যালেঞ্জের কথা মাথায় রেখেই আমি আর আমার সেই ব্রেবফ এর বেশ কিছু পুরনো বন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম স্নাতক পাশের পর পরই আমরা এক দীর্ঘ ভ্রমণে বের হবো। ঐ সময় পর্যন্ত আমি পৃথিবীর প্রায় পঞ্চাশটির মতো দেশ ভ্রমণ করে ফেলেছি। এই ভ্রমণের অধিকাংশই ছিল বাবার সাথে, কিন্তু এবার সময় আসলো একেবারে নিজের মতো করে ভ্রমণে বের হবার। আমি খুবই সামান্য কিছু জিনিস আমার ব্যাগে ভরে নিলাম। ব্যাপারটা কিন্তু সত্যিই খুবই ভাববার ছিল যে কত অল্প পরিমাণ জিনিসপত্র ব্যাগে নেয়া যায় কারণ দীর্ঘ পথেতো সেগুলো আমাকেই বহন করতে হবে, সেই সাথে এটাও মাথায় রাখতে হয়েছিল যে ঐ ভ্রমণটা চলবে চার ঋতু ধরে আটলান্টিক পেরিয়ে তিনটি মহাদেশে।

গ্রীষ্মটা আমি কাটিয়েছিলাম ফ্রান্সে, একেবারে আমার নিজের মত করে। প্রভেন্স থেকে নরম্যান্ডি ভ্রমণ করে আমি প্যারিসে থিতু হয়েছিলাম। সেখানে আমি আমার অধিকাংশ দিন কাটিয়েছিলাম মিউজিয়াম আর লাইব্রেরীতে। সবার কাছ থেকে বা সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আমি আমার এক নিজস্ব জগত তৈরী করে নিয়েছিলাম। এর ফলে আমি খুব সহজেই নতুন কারো সাথে বন্ধুত্ব করার যে সম্ভাবনা থাকে সেটা থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছিলাম। তবে এর ফলে আমি নিজেকে দেবার মত যথেষ্ট সময় পেয়েছিলাম যার ফলে আমি আমার নিজের সম্পর্কে আর নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাবার প্রচুর সময়ও পেয়েছিলাম।

আমি প্রায়ই ভাবতাম, আমার বাবা আমার বয়সে কী করেছিলেন। ব্রেবফ এ পরীক্ষায় অসম্ভব সুন্দর ফলাফল, মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন স্কুলে শীর্ষস্থান, তারপর হার্ভার্ডে মাস্টার্স। তারপরও আরো পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া, আর লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স এবং সরবন এ পড়াশুনা করেও ডিগ্রী না নেওয়া। তারপর বেশকিছু বছর তিনি ব্যাপক ভ্রমণ করে বেড়িয়েছেন – বলা যেতে পারে গোটা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছেন, আবার কখনও কখনও নানা ধরনের কাজ করেছেন। এই নানামুখী কাজে কখনও তিনি আইনজীবীর কাজ করেছেন, কখনও বা কুইবেকের শান্ত বিপ্লব (কুইবেক’স কুআইট রেভ্যুলেশন) এর পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক পত্রিকা বের করেছেন, এর মধ্যে তিনি দুই একটা বইও লিখে ফেলেছেন আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবিধানিক আইনও পড়িয়েছেন। এগুলো সবই তিনি করেছিলেন তাঁর মধ্য চল্লিশে প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হবার পূর্বেই। আমি ইতিমধ্যে বাবার সেই পথ থেকে অনেকটা সরে এসেছি, এবং আমি নিজের সম্বন্ধে এটাও বুঝে গেছি যে, বাবার মত সেই বুদ্ধিবৃত্তিক সর্পিল পথ আমার নয়।

আফ্রিকার ভ্রমণে জাস্টিন ট্রুডো

আমার মা সিমোন ফ্রাসার নামে ভ্যাংকুভারে গড়ে উঠা একটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে ডিগ্রী নিয়েছিলেন, তারপর বিয়ের জন্য পূর্ব দিকে এসে আমার বাবার সাথে সংসার শুরু করেছিলেন। আমি তখনই ভেবে রেখেছিলাম যে আমি সংসার করবো। তবে আমি এটাও মাথায় রেখেছিলাম, আমি কোনোভাবেই বাবার মত অনেক বেশী বয়সে আর মা’য়ের মত এতো অল্প বয়সে কখনও সংসার শুরু করবো না।

ঐ গ্রীষ্মেই এক নীরব শান্ত পাহাড়ী এলাকায় আমি গভীর উপলব্ধিতে অনুভব করেছিলাম আমার জীবনের পরবর্তী ধাপটা কি হবে। আমার সত্যিই মনে হয়েছিল, আমার একজন স্কুল শিক্ষক হওয়া উচিৎ। আর এটা হলে এই পৃথিবীতে আমার চলাটা সত্যিই খুবই ইতিবাচক হবে। আমার এটাও মনে হয়েছিল, এই চাকুরীটা আমার নতুন কিছু শেখার প্রতি যে দূর্ণিবার আকাঙ্ক্ষা, অন্যের সাথে মত এবং জ্ঞানের আদান প্রদান করা আর আমার চারপাশের মানুষদের ভালোভাবে বুঝতে পারার যে প্রচেষ্টা, তাতে আমাকে সাহায্য করবে। এবং ঐ সময়ে আমার জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হচ্ছে, এই পথটা আমার পরিবার ও আমার অতীত থেকে আমার নিজের চলার পথকে আমার মত করে তুলবে।

এই যে হঠাতই আমার নিজের মত করে আমার পথ খুঁজে পাওয়ার যে উম্মাদনা তা থেকে সেই মুহূর্তে আমার আনন্দ সংবরণ করতে না পেরে উত্তেজিত হয়েই বাড়ীতে ফোন করলাম। মা আমার এই পরিকল্পনার কথা শুনেই ফোনের অপর দিক থেকে বলে উঠলেন, ‘জাস্টিন, তুমি আমাকে এক চমৎকার কথা শুনালে, আমি সত্যিই তোমার এই সিদ্ধান্তে অভিভূত।’ তিনি একটু থেমে আবার বলেছিলেন, ‘তুমি কী জানো, তোমার অস্থিমজ্জায় রয়েছে সেই সুদূর স্কটল্যান্ডের এক স্কুল শিক্ষকের চেতনা প্রবাহ।’ আমি বুঝলাম, মা আমাকে তাঁর দাদা স্কটল্যান্ডের ব্যানফ শহরের স্কুল শিক্ষক জেমস জর্জ সিনক্লেয়ারের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন যিনি ১৯১১ সালে স্থানীয় ভূ-স্বামীর সামন্ততান্ত্রিক নীতির প্রতিবাদে নিজ পরিবার নিয়ে ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় স্থায়ীভাবে পাড়ি জমিয়েছিলেন।

মায়ের সমর্থনে আমার বিষয়টা ভালোই লাগলো, আমার মনে হলো আমার পরিবারের নিকট অতীতের একটি বিষয় আবার ঝালিয়ে নেয়া যাবে। এই পরিকল্পনা মাথায় গেঁথে নিয়ে ঠিক করলাম পরবর্তী শীতে ম্যাকগিলের শিক্ষা অনুষদে ক্লাস শুরু করবো। যাহোক, আমার সামনে বছরব্যাপী যে ভ্রমণের বিষয়টা আছে তাতে আবারো গভীরভাবে মন দেয়ার জন্য তৈরী হলাম।

২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে আফ্রিকার লাইব্রেরীয়ার রাজধানী মনরোভিয়ায় স্কুল ছাত্রদের সাথে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।

সেপ্টেম্বরে আমার প্রিয় তিন বন্ধুর সাথে লন্ডনে মিলিত হলাম। তারপর সেই তিন বন্ধু অর্থাৎ ম্যাথিউ ওয়াকার, এলেন স্টিভারম্যান, মার্ক মিলার এবং আমি একসাথে অসম্ভব সুন্দর এক অভিযানে নিজেদের জড়িয়ে ফেললাম। আমরা এক বিচিত্র দলের সাথে যোগ দিলাম। আমাদের এই নতুন দলে ছিল বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ, কিছু অস্ট্রেলীয় ও একজন ফিনল্যান্ডীয়। আমরা শুরু করলাম স্থলপথে আফ্রিকা ভ্রমণের। কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা খুবই দ্রুত গতিতে ফ্রান্স ও স্পেন পার হয়ে গেলাম। মহাসড়কের রেস্ট হাউসের পেছনেই আমরা আমাদের ক্যাম্প করতাম। আমরা অধৈর্য্য হয়ে পড়েছিলাম, কত তাড়াতাড়ি ইউরোপের মাটি থেকে আমরা বিদায় নিতে পারি। আমরা আমাদের বাড়ীর সাথে ফোনে শেষ কথা বলি জিব্রাল্টার থেকে, তারপর ফেরীতে চড়ে মরক্কোর দিকে যাত্রা শুরু করেছিলাম।
মরক্কোর ফেজ ও মারাকেচ হয়ে এটলাস পর্বতমালা ধরে আমরা এগুতে শুরু করেছিলাম। আর পশ্চিম সাহারার যে জায়গায় মরুভূমি আটলান্টিকের সাথে মিশেছে সেই জায়গার পাথর থেকে ঝিনুক তুলে রাখতাম আমাদের সকালের নাস্তার জন্য। তারপর সাহারার এক বিরাণ জায়গা পার হয়ে আমরা মৌরীতানিয়ায় পৌঁছেছিলাম। সেই জায়গার যে স্মৃতি আমার স্মৃতিপটে জ্বলজ্বল করে তা হচ্ছে সেই জায়গার সেই বালুর সব স্তুপ আর সেই পথ ঠেলে ঠেলে পার হওয়া। সেই সময় আমি বাসি টুনা সালাদ খেয়ে কঠিনভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তারপর খুব মনে পড়ে, একটা ছোট গ্রামে এক জেলের বাড়ীতে কত আনন্দে ইচ্ছেমত কোরিয়ার সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা করেছিলাম এবং কিভাবে কাস্টমস এজেন্টদের কাছে আমাদের বিয়ার এর শেষ সম্বলটুকু লুকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলাম।

উত্তর আফ্রিকা থেকে পশ্চিমে যাওয়াটা বেশ সুমধুর ছিল। মালি জায়গাটা ছিল খুব বৈচিত্র্যময় আর বন্ধুত্বপূর্ণ। তবে আমরা বিভিন্ন ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম। ম্যাট ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েছিল। বামাকো’তে তার চোখে মরিচের গুড়া ছিটিয়ে তার কাছ থেকে সামান্য কিছু ডলার হাতিয়ে নিয়েছিল ছিনতাইকারীর দল। অল্পের ওপর দিয়েই সবকিছু গিয়েছিল। প্রাচীন সভ্যতার পুরাতাত্তি¡ক এক পথ দিয়ে যাবার সময় একটা গ্রামের সবচেয়ে শক্তিশালী মাস্তানের সাথে পাঞ্জা লড়াইয়ের বাজিতে মার্ক তাকে হারিয়ে দিয়েছিল। তারপর আমরা একটা একেবারে বিরাণ গ্রামের জায়গাই গিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের একটা গাছ দেখানো হয়েছিল এবং আমাদের জানানো হয়েছিল, কিছুদিন পূর্বেও ঐ গাছের নীচে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী ছেলেমেয়েদের বলী দেওয়া হতো। (চলবে)
মনিস রফিক : চলচ্চিত্রকর্মী, টরন্টো, কানাডা