মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

 

পঞ্চাশ.
আমি যখন পাপিনিউ সংসদীয় এলাকার দ্বারে দ্বারে আর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতে শুরু করলাম, তখন আমার মূল লক্ষ্যই ছিল সেই এলাকার মঙ্গলের জন্য যে সব সংগঠন কাজ করে তাদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানা এবং তাদের সাথে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলা। এ ধরনের কাজ করতে আমার মন থেকেই ভালো লাগতো। এই ভালো লাগা থেকেই আমি একসময় বিভিন্ন ধরনের নাগরিক সেবামূলক কাজ যেমন, ‘কাতিমাভিক’, তুষার ধস থেকে রক্ষার সচেতনা তৈরী করা, যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ এবং অন্যান্য কল্যাণমূলক কাজে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছি। পাপিনিউ এমন একটা জায়গা যেখানে যে সব নতুন অভিবাসী এসে বসতি গড়তো, তারা সবাই একেবারে শূন্য থেকে তাদের জীবন শুরু করতো। তাদের টিকে থাকার জন্য লড়াই আমাকে মুগ্ধ করতো, একই সাথে নূন্যতম মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য তারা যে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাতো, তাদের সেই কঠোর কঠিন পরিশ্রম আমাকে অনেক সময় ব্যাথিত করতো। আমি লক্ষ্য করতাম, সেই সব নতুন অভিবাসীদের একান্ত চাওয়ার বিষয় ছিল, বাসস্থান, শিশুসেবা আর কর্মসংস্থান।

ভিলেরী এলাকার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে গড়ে উঠা ‘লা মেশন ডে কোয়ার্টার ভিলেরী’ সংগঠনটি ছিল এমনই এক প্রতিষ্ঠান যার মূল লক্ষ্যই ছিল এমন সব বিষয় নিয়ে কাজ করা। তাদের মূল উদ্দেশ্যই ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে যে সব মানুষ একেবারে পিছিয়ে আছে, তাদেরকে সর্বতোভাবে সহায়তা করে তাদেরকে এমন দক্ষ ও আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তোলা যাতে তারা সমাজের খুবই কার্যকরী সদস্য হিসেবে নিজেদের তৈরী করতে পারে। লা মেশন কোয়ার্টারের স্বেচ্ছাসেবীরা এলাকার ক্ষুধার্তদের মধ্যে নিয়মিতভাবে খাবারের ব্যবস্থা করতো, যাদের চিকিৎসার প্রয়োজন হতো তাদের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতো, এছাড়া তারা পিতামাতার জন্য ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করতো যাতে তারা নিজেদেরকে নতুন ও প্রয়োজনীয় কাজের সাথে খাপ খাওয়িয়ে নিতে পারে। সাধারণত একটু অবস্থাশালী কানাডিয়ানরা যারা এমন সব পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে বলে কখনও ভাবেনি তারা সাধারণত ‘লা মেশন ডে কোয়ার্টার ভিলেরী’র মত স্বেচ্ছাসেবীমূলক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতো না, কিন্তু ভিলেরী এবং সারা কানাডার এ ধরনের জায়গায় এ স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোই কমিউনিটি’র মানুষের জন্য সেবা কার্যক্রম চালিয়ে সেই সব মানুষের মধ্য এক ধরনের বন্ধন সৃষ্টি করে আসছে।

আমি বেড়ে উঠার সাথে সাথে এই ধরনের অনেক সংগঠন ও তাদের কার্যক্রমের সাথে পরিচিত হয়েছি। আমি দেখেছি, এই সব সংগঠনগুলোর প্রধান সমস্যাই হচ্ছে তারা তাদের কার্যক্রম চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়। এসব সংগঠনে যারা কাজ করে তারা মূলত এক ধরনের সমাজসেবার মানসিকতা থেকেই কাজ করে যায়, কিন্তু তারা কিভাবে নিয়মিত অর্থের যোগান পাবে, অথবা তাদের কার্যক্রমকে ভালোভাবে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তাদের কি করতে হবে সেটা তারা জানে না অথবা সে ব্যাপারে তারা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পায় না।

এরা যে উৎস থেকে সাধারণত অর্থের সংস্থান পেয়ে থাকে, সেগুলোতে যে প্রচলিত নিয়ম আছে তা হচ্ছে, তাদের কার্যক্রমের জন্য তাদেরকে প্রতি বছর দরখাস্ত করতে হয় এবং তাদের কার্যক্রম আর কাগজপত্রের সবকিছু ঠিক থাকলে তারা পরবর্তী বছরের জন্য তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। তবে, তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া বা তাদের টিকে থাকা অনেকটা নির্ভর করে সেই সব এলাকার রাজনীতিবিদদের মর্জির উপর। যখন তাদের অর্থের প্রয়োজন পড়ে, তখনই তারা নতুন কোনো কার্যক্রমের পরিকল্পনা তৈরী করে যেগুলোর বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করে স্থানীয় এমপি, এমপিপি ও স্থানীয় সিটি কাউন্সিলরের উপর। এই সংগঠনগুলো বাধ্য হয় প্রতি বারো মাসে নতুন করে তাদের কার্যক্রম সাজাতে। পাপিনিউ’র এমপি হিসেবে আমি তাদের প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলাম, যাতে তারা তাদের কার্যক্রমকে ভালোভাবে চালিয়ে যেতে পারে সেজন্য আমি এমন একটা মডেল তৈরি করবো যাতে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবার জন্য নিয়মিত অর্থের সংস্থান পেতে পারে আর এসব প্রতিষ্ঠানে যারা মানুষকে সহযোগিতা করার মানসিকতা নিয়ে কাজ করে তারা যেন অর্থের জন্য বেশী চিন্তা না করে নিজেদের কাজে বেশি করে মন দিতে পারে।

মুসলিম কমিউনিটির মানুষের সাথে জাস্টিন ট্রুডো

তবে এখানে একটু সমস্যা হলো, এসব প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করে তাদের প্রায় সকলেই স্বেচ্ছাসেবী যার ফলে তাদের কাছে এই কাজগুলো মূলত হচ্ছে ঐচ্ছিক। কিন্তু বিষয়টা আবার এভাবে দেখাও ঠিক না। ভিলেরী’র মত কমিউনিটিতে কাজ করার জন্য স্বেচ্ছাসেবীরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ তারা এসব জায়গায় তাদের শারীরিক ও মানসিক শ্রম না দিলে, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে।
যখন কমিউনিটিতে স্বেচ্ছায় কাজ করার কোনো উপলক্ষ্য আসে, তখন রাজনিতিবিদদেরই কিছু উদাহরণ সৃষ্টি করা উচিৎ যাতে অন্যান্য সবাই এ ধরনের কাজে মাসে বা বছরে একদিনের জন্য হলেও প্রত্যক্ষভাবে কাজ করতে পারে। আমি এক্ষেত্রে ২০০৮ সালের একটা ঘটনার কথা বলতে চাচ্ছি, সেই সময় ‘দেস আমিস দ্যু পার্ক জারী’ নামে একটা স্বেচ্ছাসেবীদের দল আমার রাইডিং এর একটা বড় পার্কে বসন্তে পরিষ্কার কাজ চালানোর আয়োজন করে। আমি আমার নিজস্ব কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীসহ জিন্স এবং টি শার্ট পরে সেখানে সময়মত গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। সেখানে কয়েকজন কাউন্সিলর, এমপি এবং মেয়র উপস্থিত ছিলেন।

তাদের সবাই স্যুট পরে এসেছিলেন। আমরা সবাই প্রথমে হাতে দস্তানা পরে, দেখানোর জন্য কিছু আবর্জনা তুলে, তারপর স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্দেশ্যে কিছু ভালো কথা বলে সবাই মিলে কয়েকটি ছবি তুললাম। ছবি তোলা শেষ হলে আয়োজকদের একজন সবাইকে আনুষ্ঠানিকভাবে ধন্যবাদ জানালেন। সেই ধন্যবাদ পাওয়ার পর মেয়র এবং কাউন্সিলররা ভাবলেন তাদের কাজ শেষ, ফলে তারা তাদের গাড়ীর দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমি সবার সাথে আরো তিন ঘন্টা সেই পার্ক পরিস্কারের কাজ করতে লাগলাম।

তারপরের বছর আবার যখন সেই বার্ষিক পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার সময় এসেছিল, তখন যেসব রাজনীতিবিদ সেখানে উপস্থিত ছিল তারা সবাই জিন্স আর টি শার্ট পরে এসেছিল, আর শুধু মাত্র দেখানোর জন্য ছবি না তুলে সকল স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে মিলে সত্যিকারভাবে পরিচ্ছন্নতার জন্য তারা কাজ করেছিল। আমাদের উদাহরণ’টা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং পরবর্তীতে এমন কাজে রাজনীতিবিদরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিতে থাকে।
আমি সত্যিই মনে করি, বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের প্রতি সবার যে দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে তা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের সত্যিকারের স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের সাথে নিজেদের জড়িত রাখতে হবে যেটা শুধুমাত্র লোক দেখানো বা ছবি তোলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। এই স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে তাদের কার্যক্রম ও লোকবল’কে চালানোর জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তা সংগ্রহ করার জন্য বেসরকারী পর্যায় থেকে সংগ্রহের পাশাপাশি সরকারের কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদী অর্থ পাওয়ার একটা প্রতিশ্রুতি নেয়ার জন্যও কাজ করতে হবে। আমি যখন ‘কাতিমাভি’ এর হয়ে কাজ করতাম, তখন আমি এমনই দেখেছি এবং এ বিষয়ে আমার একটা বাস্তব অভিজ্ঞতাও হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, সবাই এইভাবে কাজ করলে, এই ধরনের কমিউনিটি কার্যক্রম আরো ভালোভাবে পরিচালিত হবে।

পাপিনিউ থেকেই আমি জেনেছি, পশ্চিমা সমাজ ব্যবস্থায় উপার্জন আর সম্পদের বৈষম্যটা কত বিশাল হতে পারে। পাপিনিউ রাইডিং এর পশ্চিম দিকেই মাউন্ট রয়্যাল ও আউটারমন্ট নামে দুটি ফেডারেল রাইডিং আছে যেগুলোতে দেশের সবচাইতে কিছু ধনী ব্যক্তি বাস করে। হাম্পস্ট্যাড আর আউটারমন্ট এর সেই আলিশান বিলাসবহুল বাড়ীগুলো থেকে ‘লা মেশন ডে কোয়ার্টার ভিলেরী’তে মাত্র দশ মিনিটেই গাড়ী চালিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু ঐ জায়গা দুটোর মানুষের জীবনযাপনের ধরনের সাথে পাপিনিউ’র মানুষদের জীবনের মৌলিক চাহিদা মিটানোর দিনরাত সংগ্রাম দেখে মনে হয় দুই জায়গার মানুষেরা দুই গ্রহে বাস করে।
আমি পাপিনিউ’তে অনেক পিতামাতাকে দেখেছি, যারা তাদের সন্তানদের সকালের নাস্তা ছাড়ায় স্কুলে পাঠিয়ে দেয়, সেই নাস্তা যোগাড় করতে তারা ব্যর্থ হন। আবার এটাও দেখেছি, একেবারে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে যারা নিজেরাই ঠিকমত একা বাইরে যাবার ক্ষমতা রাখে না, তারা পায়ে হেঁটে তাদের আরো ছোট ভাইবোনদের কিন্ডারগার্টেন এ নিয়ে যাচ্ছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, তাদের বাবা-মা’রা খুব ভোরে কাজে বের হয়, আর তাদের ছোট ছোট সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর সময় তারা কোনোভাবে তাদের ঘরে থাকতে পারেন না। তারা কাজ করে যে অর্থ পায়, সেটা দিয়ে কখনোই তাদের সংসার চলে না, ফলে অধিকাংশ মানুষকেই ‘ফুড ব্যাংক’ এর খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। সত্যিকার অর্থেই এই মানুষগুলোর কোনো জমানো অর্থও থাকে না আর অবসরকালীন সময়ে তারা তাদের জীবন কিভাবে কাটাবে তেমন কোনো পরিকল্পনাও তাদের থাকে না। (চলবে)