আতোয়ার রহমান : রমজানের একমাত্র মেয়ে আয়েশা। বয়স দশ-বারো বছর। বড় উড়নচণ্ডে। পড়াশোনায় মন নেই। তবে গরু-ছাগল চরানোর নেশাটা খুব। গায়ে একটা কামিজ, পায়ে একজোড়া পুরনো স্যান্ডেল। সরু নালার মতো ঘাঘট নদীর ধারে ভোরবেলা গরুটাকে নিয়ে হাঁটে আয়েশা।নদীর দূর্বাদলঘন পাড়ে সারা বেলা গরু চরায় সে। এটি চরিয়ে লেখাপড়া চালানোর স্বপ্ন দ্যাখে। এর খাবার কিনতে পারে না, তাই রাস্তার ধারের ঘাসের উপর তার নির্ভর। গরুটির শরীর জীর্ণ শীর্ণ। দেখেই বোঝা যায় বহুদিন ঠিকমতো খাবার জোটেনি। খাবার না পাওয়ায় দুই পেট গর্তে বসে গেছে। গোটা শরীর জুড়ে হাড়ের উপর শুধু চামড়ার ছাউনি।
গরুট্যা ছাড়ি দেইস না মা, মাইনষের ফসলে মুখ দিলে গরু আটকে থুইবে, ছুটাতে পারবু না ঝগড়াঝাঁটি করি। খড়াত দিলে অনেক ট্যাকা নাগবে ছুটাতে। রমজান মেয়েকে আদরমাখা সুরে কথাগুলো বলে।
ঠিক আছে বাবা, মুই ওটাক ছাড়ি দিবান নাও। দড়ি ধরে চরাইম, জমির আইলের ঘাস কাটি ওটাক খাওয়াইম। আয়েশা বাবার অসহায় চোখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে।
তাই গরুর সাথে সাথে আয়েশাও হেঁটে চলে সারাদিন। গরু জমির আইলের ঘাস খেতে থাকে, আর আয়েশা পড়তে থাকে। কখনো গরুটি মাঠে ছেড়ে দিয়ে পাশে কোন কাঠের উপর বা মাটির ঢিবিতে বসে রীতিমত স্কুলের শ্রেণীকক্ষের বেঞ্চে বসে পড়ার মত পড়তে থাকে। কখনো গরুটিকে দড়িতে বেঁধে রাখে। মাঠে সেরকম ঘাস নেই। তবুও খুঁটি থেকে যতো দূর দড়ি যায় ততোদূর পর্যন্ত সামান্য ঘাসের সাথে মাটি কামড়ায় পশুটি।
মিঠাপুকুরের হুলাশুর হাট গ্রামে আয়েশার বাড়ি। গরুটি যেন তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তার পরিবারের সদস্য। তার থাকার ঘরের পাশেই গরুটির ঘর। সকাল হলেই সে গরুটিকে গোহাল ঘর থেকে বের করে তরতাজা কাঁচা ঘাস খাওয়ায় অথবা চাড়িতে খইল-পানিতে ভেজানো ধানের শুকনো খড় খাওয়ায়। মা পাখি যেমন মুখে করে পোকামাকড় এনে এনে তাদের বাচ্চাদের খাওয়ায়, আয়েশা তেমনি কাটা কাঁচা ঘাস বা খড় হাতে করে গরুটির মুখে তুলে দিয়ে খাওয়ায়। কোনো কোনো দিন খানিকটা চালের কুড়া, দুই এক মুঠ ভাত মাটির চাড়িতে অনেক পানির মধ্যে মিশিয়ে দেন। সাথে একটু নুনও। গরুটা দুর্বলতার কারণে চাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। আয়েশা আলাদা একটা গামলায় ভাতকুড়া মেশানো খানিকটা পানি ওর মুখের সামনে ধরেন। সামান্য কিছুটা খেয়েই শুয়ে পড়ে সে। তার বড় বড় চোখ দুটোর কোনে পানি জমতে থাকে। পরিবারের অনেক দিনের পুরোনো সাথী এই অবোধ প্রাণীটির মাথায় আয়েশা পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেন। তারও চোখ আর্দ্র হয়ে আসে। গোয়ালঘর পরিস্কার করে গোবর ফেলায় বাড়ির পেছনে। আয়েশা আর গরুর সম্পর্ক যেন ভাই বোনের মতো মায়ামমতায় জড়ানো। তার সমবয়সী অন্য মেয়েরা বিকেলে যখন তাদের বাড়ির আঙিনায় কিতকিল খেলে, সে তখন দুপুরের কড়া রোদে গরুটিকে জমির আইলে ঘাস খাইয়ে ক্লান্ত শরীরে গামছায় বেঁধে হেলেঞ্চাশাক নিয়ে বাড়ি ফেরে।
পরম নির্ভরতায় গরুটি আয়েশার গা ঘেঁষে চলে, আয়েশা যা বলে তাই করে। আয়েশাও পরম আদরে লালন পালন করে এই প্রভূভক্ত নিরীহ অবলা জীবটিকে। আয়েশা কাছে আসলে গরুটি হাম্বা-আ, হাম্বা-আ স্বরে ডাকে। তার সুন্দর আর গভীর মায়ায় ভরা চোখে আয়েশার দিকে তাকায়। আয়েশা সবসময় গরুটির বিশ্রাম ও খাবারের জন্য উদ্বিগ্ন থাকে। চাড়ীর পাশে যখন আয়েশা হাঁটাহাঁটি করে, গরুটিও লেজ নাড়ে, যেন কৃতজ্ঞতা জানায়।
শুষ্ক শীত ও গ্রীষ্মের পর আষাঢ় মাসে সামান্য বৃষ্টির স্বাদ পায়। সবুজ হয়ে ওঠে এলাকার মাঠ আর শস্যভূমিগুলি। সরু জীর্ণ শীর্ণ নদীগুলি ভরে ওঠে কানায় কানায়। কিন্তু বিগত দুই বছরে প্রকৃতির এই সাদামাটা নিয়মই যেন বদলে গেছে হঠাৎ করে। বৃষ্টি নেই এক ফোঁটাও। একটানা দুটি মরশুম বৃষ্টির অপেক্ষাতেই কেটে গেছে কৃষকদের। তাই প্রমত্তা তিস্তার শাখা এই ঘাঘট নদী এখন প্রায় শুকনো, চড়া পড়ে গেছে। বেলা গড়িয়ে চারটে বেজে গেছে। তবুও রোদের তেজ যেন কমতে চায় না। এই গ্রীস্মের দিনে এখানে ঘাস কম থাকলেও গরুটিকে আর একটু ঘাস খাওয়ানোর জন্য আয়েশার আগ্রহও যেন এতটুকু কমতে চায় না। পশ্চিমে সূর্য ঢলে পড়েছে। তার রক্তিম আভায় ঘাঘটের জল যেন রক্তরঞ্জিত হয়ে গেছে। আয়েশা খুব ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে গরূটিকে নিয়ে ঘরে ফেরে। লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে মশা, মাছি তাড়াতে তাড়াতে গরুটিও তার সাথে গোধূলীবেলায় বাড়ি ফিরে আসে।
রমজান রিকশা-ভ্যান চালায়। স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিজের ভ্যানে করে গাঁয়ের পথে নিয়ে যেতে যেতে রমজান আয়েশার কথা ভাবে। আয়েশাও স্কুলে ভর্তি হয়েছে। স্কুলের আর সব ছেলেমেয়ের সাথে আয়েশাও যদি তার ভ্যানে স্কুলে যেত ও বাড়ি ফিরতো। মাটি কামড়ে লেখাপড়াটা যদি চালিয়ে যেত, তাহলে পড়াশোনা শেষে অফিসার-মাস্টার কি নিদেনপক্ষে কেরানি হতো। তাদের নিত্য অভাবের সংসারের দুঃখকষ্ট ঘুচত। ঠিকমতো লেখাপড়া করলে দরজা না হোক, জীবনে অন্তত একটা জানলা খুলে যাবে, বাইরের হাওয়া ঢুকবে, বাইরের জগৎটা দেখা যাবে। আর সত্যিই বেরোতে পারলে কোনও একটা রাস্তার সন্ধান মিলতে পারে- হয়তো উঁচুনিচু ভাঙাচোরা, তবু উত্তরণের পথ।
কিন্তু প্রায় দু-মাস ধরে আয়েশা স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। লেখাপড়ার দিকে তার মন নেই। দিনরাত সারাক্ষণ গরুটি নিয়ে ব্যস্ত। সে কারও সাথে মেলামেশা করতে চায় না, বন্ধুত্ব করতে পছন্দ করে না; সে বাড়িতে শুধু গরুটি নিয়ে একা থাকতে পছন্দ করে যেখানে কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারে না। একদিন তার মা জোর করে তাকে নিয়ে প্রতিবেশির একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। শুরুতে সে তার সাথে যেতে অস্বীকার করে কারণ সে গরুটি ছেড়ে কোথাও যেতে পছন্দ করে না কিন্তু তার মা তাকে অনেক জোর দিয়ে যেতে বললে পরে সে যেতে রাজি হয়। আয়েশার আচরণের এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে রমজানের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। তবে তার বাবা-মা তাকে এ নিয়ে বকাঝকা করেনা কারণ সে তার বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে, তার আর কোন ভাইবোন নেই।
আগের মতো এখন আর রমজানের রোজগার নেই। তারপরও এখনকার রোজগারে তার মেয়ে-বউকে নিয়ে কোনোভাবে সংসারটা চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ মেয়েটার যে কী হলো, এখন তাকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। রমজান সারা দিন পথে পথে ভ্যান চালায় ঠিকই কিন্তু তারও মন পড়ে থাকে আয়েশার লেখা পড়ার প্রতি অনীহা আর গরুকে নিয়ে তার আচ্ছন্নতার দিকে।
স্কুলে না যাওয়ার জন্য একদিন আয়েশাকে মারধর করে রমজান। আয়েশা অসুস্থ হয়ে পড়ে। আয়েশার প্রতি রমজানের এ আচরনে গরুটি কষ্ট পায়। প্রতিদিন কয়েক লিটার করে দুধ দিত গাভিটি। হঠাৎই দুধ দেওয়া বন্ধ করে দেয় অবলা জীবটি। ফলে তার ক্ষোভ গরুটির ওপরও পড়ে। সে মারপিট করে, কখনো ভয়ভীতি দেখিয়ে দুধ দোহানোর চেষ্টা করে।কিন্তূ গরুটি নাছোড়বান্দা। কোনকিছুতেই আর দুধ দেয় না।গাইটার পেছনের দিকে, লেজের গোড়ার দুই পাশে পেন্টি দিয়ে নির্দয়ভাবে পেটায় রমজান। মারের জায়গাগুলোয় লোম খাড়া হয়ে থাকে। দুই পাঁজরেও মারের দাগ। আয়েশা কাছে যেতেই মাথাটা সামান্য তুলে একবার তাকালো। সেদিনের মতোই চোখ দুটোর কোনায় পানি।
সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেলে রমজান গরুটিকে খাবার দেওয়া বন্ধ করে। গরুটির জন্য আয়েশার কাটা ঘাস একদিন বাড়ির পেছনে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসে রমজান। গরুটির ক্ষুধার্ত গভীর কালো চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে আয়েশার বেশ কষ্ট লাগে। গরুটি কিছু খেতে চায়, কিন্তু আয়েশা তা দিতে পারছে না। নিরুপায় আয়েশা বিচলিত হয়ে পড়ে। তাহলে কি গরুটি না খেয়ে মরে যাবে? তার মুখ দিয়ে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হয়ে আসে। গরুটির সারা গায়ে-গলায় মাথায় পিঠে তার হাতের স্নেহপরশ বুলিয়ে দেয় আয়েশা। নিজে না খেয়ে গরুটিকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে; ভালো জায়গায় রাখে। চোখ দিয়ে তার নীরবে জল ঝরে। গরুটি উদাস দৃষ্টিতে আশেপাশে চেয়ে থাকে আর চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে।
ক্ষুধার্ত গরুটি একদিন দড়ি ছিড়ে প্রতিবেশি মান্নান মুন্সির রসুনক্ষেতে ঢুকে রসুন গাছ খেয়ে ফেলে। রসুন গাছ খাওয়ার কারনে তার দুধও রসুনের গন্ধযুক্ত হয়। ফলে রমজান বাজারে গিয়ে দুধ বিক্রি করতে পারে না। এদিকে মান্নান মুন্সি রসুনের ক্ষেত খেয়ে ফেলার জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে রমজানকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে, দু চারটা কিল ঘুষিও মারে।
উপায়ন্তর না দেখে রমজান গরুটিকে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।বাবার এ সিদ্ধান্তের কথা শুনে আয়েশা বিমর্ষ হয়ে যায়। সামনে বকরা ঈদ। ভাল দাম পাওয়ার আশায় আয়েশার শত বিরোধিতা সত্তেও শঠিবাড়ি হাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে রমজান। মনটা ভীষণ ভারী হয়ে আসে আয়েশার। বাবাকে কোনভাবে বিরত করতে না পেরে আয়েশা অবশেষে তার মামাকে সাথে নিয়ে তার প্রিয় গরুটির সাথে হাঁটতে শুরু করল। সঙ্গে ব্যাগে করে কিছু কাঁচা ঘাস নিল, গরুটির প্রিয় খাবার। আয়েশার চোখ ভিজে আসছে।গরুটির মুখে এক বিশেষ ধরনের অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে যা হুবহু মিলে যায় কান্নার অভিব্যক্তির সঙ্গে।
গরু-হাটার কাছে এসে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক পার হওয়ার সময় ঢাকাগামী একটি দ্রæতগামী বাসের নীচে চাপা পড়ল আয়েশা। ব্যাগের ঘাসগুলি তার পিষে যাওয়া শরীর নির্গত রক্তে লাল হয়ে গেল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে আইসিইউতে ভর্তি করা হল।আয়েশার মামা হাসপাতালে তার খোঁজখবর নিতে থাকল।এদিকে আয়েশার বাবা গরুটিকে উচ্চমুল্যে বেচে দিল।পার্শ্ববর্তী কাফ্রিখাল গ্রামের জোবেদ আলি গরুটিকে কিনে বাড়িতে নিয়ে গেল। গরুটি জোবেদ আলির সাথে যেতে চায় না। শিঙ নেড়ে তাকে গুঁতো দিতে যায়। এদিওদিক তাকায়। আয়েশাকে খোঁজে। রাতে জোবেদ আলি গরুটিকে তার বাড়ির পেছনের গোহাল ঘরে রাখল। গরুটি গভীর রাতে দাঁত দিয়ে তার গলার দড়ি কেটে গোহাল ঘরের পুরনো বাঁশের বেড়া ভেঙে পালিয়ে আসে আয়েশার বাড়িতে। আয়েশার দেখা পাওয়ার আশায় তার শোয়ার ঘরের চারপাশে ঘোরাঘুরি করে গরুটি, আয়েশাকে খোঁজে। কিন্তু তার প্রিয় আয়েশার দেখা মেলে না। অবশেষে গরুটি পা দিয়ে মাটিতে বারবার সজোরে আঘাত করতে থাকে আর বিলাপের স্বরে ডাকতে থাকে হাম্বা-আ, হাম্বা-আ আ…
লেখক : কবি ও গল্পকার