ফরিদ আহমেদ : বিকেল ঠিক সাড়ে তিনটায় বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করলো পদ্ম আর পলাশ, বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর প্রথম দুই যুদ্ধ জাহাজ। আজকেই প্রথম অপারেশনে যাচ্ছে তারা। নভেম্বর মাসের ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে চলেছে বঙ্গোপসাগরের বুক জুড়ে। বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানায় ঢুকে পড়তেই নৌ সেনাদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় পতাকা নামিয়ে ফেলা হলো। উড়িয়ে দেওয়া হলো স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। মাঝখানে তার হলুদ মানচিত্র। ক্যানভাস দিয়ে ঢাকা বোফর্স গানগুলোকেও উন্মুক্ত করা হলো। অপারেশনের জন্য পূর্ণ প্রস্তুত বিএনএস পদ্ম আর পলাশ।
অপারেশনের সাংকেতিক নাম অপারেশন হট প্যান্টস। কমান্ডার সামন্ত-র মস্তিষ্ক থেকে বের হয়েছ এর পুরো পরিকল্পনাটা। পশুর নদীর মোহনা এবং সমুদ্র চ্যানেলে মাইন স্থাপন করাই এর মূল কাজ। এর ফলে মংলা বন্দরকে অচল করে দেওয়া সম্ভব হবে। পাকিস্তানি বাহিনীর একটা লাইফ লাইন কেটে দেওয়া যাবে এই অপারেশন সফল হলে।
ফ্লাওয়ার রণতরী দুটো বাংলাদেশ নৌবাহিনী উপহার হিসাবে পেয়েছে কোলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের কাছ থেকে। কিছু সংস্কার করে, এর উপর বোফর্স কামান বসিয়ে গানবোটে রূপান্তরিত করা হয়েছে। পাকিস্তানি সাবমেরিন থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি সাবমেরিনার এবং অন্যান্য নাবিকদের দিয়ে চালানো হচ্ছে রণতরী দুটো। এই সাবমেরিনার এবং নাবিকেরা পলাশীতে কমান্ডো ট্রেনিং নিয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধীনে।
অপারেশনের কমান্ড স্থাপন করা হয়েছে ভারতীয় রণতরী আইএনএস কবরতীতে। কবরতী অবশ্য ভারতের সমুদ্রসীমার মধ্যেই থেমে যায়। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা তখনো ভারত এবং পাকিস্তান করে নাই। ভারতীয় রণতরীর উপস্থিতি তাই অহেতুক আন্তর্জাতিক ঝামেলাই তৈরি করতে পারে। ভারতীয় এলাকাতে থেকেই কমান্ড দিতে থাকে কবরতী। শুধু কমান্ড দেওয়াই নয়, পদ্ম এবং পলাশের নিরাপত্তার দায়িত্বও তার উপরে। কবরতীতেই শুধুমাত্র রাডার ছিলো, পদ্ম এবং পলাশ রাডারবিহীন। পাকিস্তানি কোনো যুদ্ধ জাহাজ আশেপাশে থাকলে তার সন্ধান দেওয়া হবে কবরতীর কাজ। করবতীর সাতান্ন মিলিমিটারের এন্টি এয়ারক্রাফট গান প্রস্তুত পাকিস্তানি বিমান বাহিনী আক্রমণে এলে ব্যবহারের জন্য। অগাস্ট মাস থেকে দেশের ভিতরে তিন দফায় আক্রমণ চালিয়েছে বাংলাদেশের নৌ কমান্ডোরা। ছোট-বড় অসংখ্য জাহাজকে ডুবিয়ে দিয়ে নৌ এলাকায় ত্রাসের সঞ্চার করেছে তারা। অপারেশন জ্যাকপটের কারণে বঙ্গোপসাগর বিপজ্জনক এলাকা হিসাবে ঘোষিত হয়। এখানে আসা জাহাজগুলোর ইনসুরেন্স প্রিমিয়াম বেড়ে যায়। একই সাথে জাহাজগুলো অতিরিক্ত চার্জ করতে থাকে বিপদসংকুল এই এলাকাতে পণ্য নিয়ে আসার জন্য। বঙ্গোপসাগর ছিলো পাকিস্তান বাহিনীর একমাত্র লাইফলাইন। আকাশপথে রসদ আনা যাচ্ছিলো না মাঝখানে ভারত থাকাতে। ফলে, সাগর দিয়ে রস আনায় অতিরিক্ত খরচ করতেও তাদের কোনো আপত্তি ছিলো না। এখানে আসায় জাহাজ কোম্পানিগুলোর জন্য যেমন ঝুঁকির ছিলো, আবার একই সাথে অধিক মুনাফারও ছিলো। যে কারণে অপারেশন জ্যাকপট ভীতির সঞ্চার করলেও জাহাজের আগমণকে একেবারে বন্ধ করতে পারে নাই।
সন্ধ্যার পরই সমস্ত আলো নিভিয়ে দেওয়া হলো পদ্ম এবং পলাশের। গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে ভুতের মতো এগিয়ে যেতে থাকে তারা পশুর নদীর মোহনার দিকে। সাড়ে নয়টার দিকে আনোয়ার ফেয়ারওয়ে বয়ার কাছে চলে আসে তারা। এখান থেকেই বন্দরের যাবার জন্য জাহাজদের প্রতি নির্দেশনা দেওয়া আছে। আরো আধা ঘণ্টা পরে বন্দরের আলো চোখে পড়ে তাদের। এখানেই মার্ক সেভেন ইনফ্লুয়েন্স মাইন পোতার জন্য প্রস্তুতি নেয় তারা। দুইটা লাইনে চারটা চারটা করে মোট আটটা মাইন পোতে পদ্ম আর পলাশ। এই মাইনের জাল ভেদ করে কোনো জাহাজের পক্ষে মংলা বন্দরে যাওয়া সম্ভব হবে না। মাইন পোতার কাজ সফলভাবে শেষ করে রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ফিরতি পথে যাত্রা শুরু করে তারা।
ঠিক মধ্যরাতে কবরতী থেকে সিগন্যাল আসে। পদ্ম এবং পলাশের কাছ থেকে পনেরো নটিক্যাল মাইল দূরে ব্রিটিশ বাণিজ্য পোত এমভি সিটি অব সেইন্ট আলবানস এগিয়ে চলেছে খুলনার দিকে। বন্দরকে অচল করে দিতেই এই অপারেশন, কাজেই এই জাহাজকে আক্রমণ করাটা মন্দের কী? এটা বরং আরো বেশি আতংক ছড়াবে। এই বিবেচনা থেকে ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এমভি সিটি অব সেইন্ট আলবানসের দিকে ছুটে যেতে থাকে পদ্ম আর পলাশ প্রবল উল্লাসে। প্রথম শিকারের স্বাদ নিতে ছুটে যাচ্ছে স্বাধীনতাকামী নৌ মুক্তি সেনারা।
বারোটা পঞ্চাশ মিনিটে সিটি অব সেইন্ট আলবানসের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে পদ্ম এবং পলাশ। চল্লিশ মিলিমিটারের গোলা গিয়ে পড়তে থাকে জাহাজের গায়ে। ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রেস ফ্রিকোয়েন্সিতে মেসেজ পাঠাতে থাকে আতংকিত জাহাজটা। “দিজ ইজ এ ব্রিটিশ মার্চেন্টম্যান। উই আর আন্ডার এটাক।” পদ্ম আর পলাশের তখন চলছে আনন্দ উল্লাস। কোনো লক্ষ্য বস্তুর উপর বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম আক্রমণ এটা। ইতিহাস রচিত হয়েছে অন্ধকার রাতে বঙ্গোপসাগরের কালো জলে।
খুলনা চ্যানেল থেকে বের হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য কোলকাতার দিকে পালাতে থাকে এমভি সিটি অব সেইন্ট আলবানস। তার পিছনে নিঃশব্দে ছায়া হয়ে একই গন্তব্যে এগিয়ে যেতে থাকে পদ্ম আর পলাশ। আক্রান্ত জাহাজ আর আক্রান্তকারী জাহাজের একই গন্তব্যে নিরাপদ আশ্রয় নিতে যাবার এ এক বিরল ঘটনা।
ঠিক দুই ঘণ্টা পরে ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রেস সিগন্যাল সচল হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর পোতা মাইনে আক্রান্ত হয়েছে এমভি বারলিয়ান। সাহায্যের করুণ আর্তি ভেসে আসে তার রেডিও রুম থেকে। এমভি বারলিয়ানের এসওএস ডিস্ট্রেস সিগন্যাল পেয়ে আরেক বাণিজ্য তরী এমভি মারকারা ভয় পেয়ে যায়। খুলনা চ্যানেলে ঢুকতে অস্বীকৃতি জানায় তারা। তার বদলে চট্টগ্রামের দিকে চলে যায় সেটা।
ভারতীয় জলসীমার মধ্যে প্রবেশ করার সাথে পদ্ম আর পলাশে আবার ফিরে আসে ভারতীয় পতাকা। ভারী মাইনগুলো না থাকায় দুটো বোটই হালকা হয়ে গিয়েছে। ভারতীয় তরীর অভিনয় করে পূর্ণ গতিতে ছুটে চলতে থাকে বঙ্গোপসাগরের জল কেটে।
মাইন পোতার এই অপারেশ হট প্যান্ট সফল হওয়া মংলা বন্দর কার্যত অচল হয়ে যায়। ক্যাপ্টেন সামন্ত একে দেখেছিলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাবালক হবার চিহ্ণ হিসাবে। তিনি তাঁর বই ‘অপারেশন এক্স’ এ লিখেছেন,
“The port director, Khulna Port, had suspended all ship movements with effect from 13 November. The Pakistan Navy, stretched as it was thanks to the task of patrolling the waterways, clearly lacked the resources to undertake a minesweeping operation. All shipping along the nautical channel that stretched from Akram Point to Khulna, ground to a halt. Operation Hot Pants had paralyzed another one of Niazi’s arteries. The nascent Bangla Desh Navy had come of age.”
বিএনএস পদ্মকে আমরা পদ্মা হিসাবে জেনে এসেছি সবসময়। কিন্তু, এর নাম আসলে পদ্ম। কারণ, এই ভেসেলগুলো ফ্লাওয়ার ক্লাস ভেসেল ছিলো। সবারই নাম ফুলের নামে। ইংরেজি বানানে পদ্মকে Padma লেখা হয় বলে সেখান থেকে ভুল করে পদ্মা হয়ে গিয়েছে এর নাম। সেই সাথে পদ্মা নদীর সাথে মিলে যাবার কারণে এ নিয়ে কেউ কখনোই প্রশ্ন তোলেনি।
বিএনএস পদ্ম এবং পলাশ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের দশ তারিখে পশুর নদীতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণে পদ্ম এবং পলাশ, দুটোই ডুবে যায়। ডুবে যাবার আগে মংলা বন্দর দখলে নিয়েছিলো তারা। সেখান থেকে আরো এগিয়ে গিয়ে নৌ ঘাটি তিতুমীরের দখল নেবার জন্য যাচ্ছিলো। দুর্ভাগ্যক্রমে সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
দেশ স্বাধীন হবার আগেই দেশের দুই প্রথম রণতরী ডুবে যায় নদীগর্ভে।