সাজ্জাদ আলী : কেউ মস্ত কোনো কাজ করলে তাকে আমরা কীভাবে পুরস্কৃত করব? সোনার মেডেল, রুপার থালা, হীরার মালা, প্রশংসা, কৃতজ্ঞতা ইত্যাদি ইত্যাদি? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! এসব পুরস্কার তো দেওয়া যেতেই পারে। তবে আমি বলবো কোন কীর্তিমানের জন্য সব থেকে বড় পুরস্কারটি হবে তার কাঁধে “আরো বড়সড় কোনো কাজের দায়িত্ব” চাপিয়ে দেওয়া। এই জগৎসংসারে কথার ফুলঝুরি ফোটাবার লোকের অভাব নেই, কিন্তু কর্মবীর হাতে গোণা দুএকজন মাত্র। কোনো সমাজে বা দেশে যখন দক্ষ নেতার আবির্ভাব হয়, তখন জরুরি কাজগুলো তাকে দিয়ে করিয়ে নিতে হয়। কথায় বলে, সময়ের এক ফোঁড়, আর অসময়ের দশ ফোঁড়!

কত শত বাঁধা ডিঙ্গিয়ে যে পদ্মার উপরে সেতুটি দৃশ্যমান হলো, সে তো আর আমাদের অজানা নয়। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা, এক শ্রেণীর সুশীল-বুদ্ধির ঢেঁকিদের চক্রান্ত, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, সর্বোপরি বিশ্বব্যাংকের প্রতিশ্রæত ঋণ স্থগিত, ইত্যাদি সব মহাসংকট দেখা দিয়েছিল। এই সব চক্রান্তকারীদের সবারই এমন বিশ্বাস ছিল, বিশ্ব ব্যাংকের টাকা না পেলে পদ্মা সেতু হবে না। ওদের তেমন বিশ্বাস তো অমুলকও নয়। এখনও তো প্রতি বছরই বাংলাদেশের বাজেটে ঘাটতি থেকে যায়। আর ছোট বড় মাঝারী প্রায় সব প্রকল্পই বিদেশী ঋণে বাস্তবায়ন হয়। বিশ্বব্যাংক ছাড়া পদ্মাসেতুর মতো বিশাল ব্যয়ের প্রকল্পে অর্থায়নের সামর্থ্য অন্য কোনো ঋণদান সংস্থার তো নেইও।

ওদের ষড়যন্ত্রে দমে না গিয়ে বরং শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিলেন “পদ্মার উপর সেতু হবেই”। আর তা নিজেদের টাকায়ই বানাবেন তিনি, হাত পাতবেন না কারো কাছে। এমন চিন্তা তো অসম্ভব রকমের দু:সাহস! যে দেশের সরকারকে এখনও বিদেশি ঋণের টাকায় চলতে হয়, সে দেশ কিনা নিজের টাকায় সুবিশাল এই পদ্মাযজ্ঞ করবে? এ যেন চাঁদের আলো ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দেওয়ার মতো অসম্ভব চেষ্টা! সরকারের অর্থমন্ত্রক, আমলা, অর্থনীতিবিদ, মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই চোখে যেন সরষের ফুুল দেখলেন! “নিজেদের টাকায় পদ্মাসেতু!” সে কী করে সম্ভব? কিন্তু সেই অসম্ভবই মাত্র ক’বছরের ব্যবধানে অপার সম্ভাবনার রূপ নিয়েছে। জয়তু শেখ হাসিনা!

দেশের রাজনৈতিক অপশক্তিগুলো, তথাকথিত সুশীল বুদ্ধি-ব্যবসায়িরা এবং বিশ্ব ব্যাংক, এরা সবাই সেদিন একাট্টা হয়েছিলো। দেশের সম্মান যায় যাক, তবু পদ্মা সেতু যেন না হয়। শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ালেন হাসিনা। ব্রিজ বানিয়েই ছাড়বো বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন প্রতিপক্ষকে। শেখের বেটির কাছে এ তো শুধু সেতু নয়, এটা দেশের মানুষের মর্জাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই! শেখ হাসিনা যে দূরদৃষ্টি এবং দৃঢ়তা সেদিন দেখিয়েছিলেন, তা কেবল ৭১-এর সেই বজ্র কন্ঠের সাথেই তুলনীয় “এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম”!
ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থ কেলেঙ্কারী, স্বজনপ্রীতি, দলবাজী, ইত্যাদি বিষয়গুলো একটি দেশের উন্নয়নের মুখে চুনকালি মেখে দেয়। দলকানারা ছাড়া দেশের সবাই এ সত্য মানেন যে সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের মুখখানা এখন কুচকুচে কালো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্রষ্টা। আর শেখ হাসিনা দেশের অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে যাচ্ছেন। আজকের বাংলাদেশের উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে সাবান-সোডা দিয়ে ভালো করে বাংলার মুখখানা ধুয়ে সাফসুতরো করতে হবে। আর সেই কাজের উপযুক্ত মানুষ শেখ হাসিনাই বটে। তাঁর “সক্ষমতা” আজ প্রমাণিত সত্য। শুধুমাত্র রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে আগে বাড়লেই তিনি দেশে “সুশাসন” প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। এ তাঁর অসাধ্য নয়।

স্মরণ করি, ১৯৯৬ সালে ভারতের সাথে শেখ হাসিনা ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার জল বন্টন চুক্তি করলেন। ফারাক্কা বাঁধের রাহুগ্রাস থেকে দেশ অন্তত ৩০ বছরের জন্য বেঁচে গেল। ১৯৯৭ সালে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধে ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি করলেন। রক্তে-রাঙা পাহাড়ে সবুজ রং ফিরে আসার পথ সুগম হলো। ২০১৪ সালে বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ সমুদ্র সীমানা নিয়ে শেখ হাসিনার সরকার আন্তর্জাতিক আদালতে ভারত ও মায়ানমারের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিতলো। শত শত মাইল বাড়তি সমুদ্রসীমা বাংলাদেশের দখলে এল। এসব বৃহৎ কাজে শেখ হাসিনার প্রেরণা ছিল বাংলাদেশের জনগণ, আর সহযোদ্ধা তাঁর আওয়ামী টিম।

আরো স্মরণ করি, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সেই ২৩ জুন ১৯৪৯ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের মহান কীর্তিকে। যা পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশের সংযোজন করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় আজকে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। দেশের উন্নয়নের প্রশ্নে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, “সংকল্পের কাছে কোনো বিকল্প আবশ্যক নয়”। কিন্তু তাই বলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার দায় তিনি কিছুতেই এড়াতে পারেন না। আমার বিশ্বাস তিনি এড়াতে চানও না।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দুটো সত্য আমাদের স্বীকার করতেই হবে। প্রথমত: দেশে দ্রæততার সাথে উন্নয়ন হচ্ছে, আর দ্বিতীয়ত: সে উন্নয়নকে ঘিরে দুর্নীতি, দলবাজির মহোৎসবও চলছে। এ সত্য যারা মানেন না, বলতেই হবে যে তাদের দল-নিরপেক্ষ চিন্তা করার সঙ্গতির ঘাটতি আছে। “অমুক আমলের থেকে আমাদের সরকারের আমলে দুর্নীতি অনেক কম” এসব বাজে তর্ক কেউ শুনতে চায় না। নিজেদের অপকর্মকে জাস্টিফাই করার জন্য অপরাধীরাই এমন কথা বলে থাকে। দুষ্ট লোকে সমাজ ছেয়ে গেছে বলে আমি শিষ্ট হবো না, এ কেমনতর যুক্তি?

১৯৭১ এ স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু দেশ গড়ার সময় পাননি! তবে শেখ হাসিনাকে কিন্তু দেশের মানুষ যথেষ্ট সময় দিয়েছে। কোনো এক্সকিউজ নেই তাঁর। উন্নয়নের সুফল মানুষের দরজায় পৌঁছুতে শৃঙ্খলার আজ বড়ই প্রয়োজন। দেখুন, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে একদিন পদ্মা সেতুর শক্ত ভীতও ভেঙে পড়বে।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)