শওগাত আলী সাগর : কোনো মানুষ যখন পঞ্চাশ বছরে পা দেয়, সেটিকে দেখা হয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন হিসেবে। সেলিব্রেটিদের বয়স যখন ৫০ হয়, রীতিমতো কমিটি বানিয়ে ঘটা করে তা উদযাপন করা হয়। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো আজ পঞ্চাশে পা দিচ্ছেন, তাকে নিয়ে কোনো ধরনের হৈ চৈ নেই, তিনি নিজেও তেমন কিছু করছেন না। পঞ্চশে পা দেয়াটাকে যে জীবনের মাইলস্টোন বলা হয় জাস্টিন ট্রুডো সেটিকেও বলছেন ‘Arbitrary Milestone’.

২৫ ডিসেম্বর ছিলো কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর জন্মদিন। ৫০তম জন্মদিন। জাস্টিন ট্রুডোর জন্মদিনে তাঁর সম্পর্কিত কিছু চমৎকার ঘটনা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই।

জাস্টিন ট্রুডোর ৫০তম জন্মদিন কীভাবে উদযাপিত হয়েছে? না, তেমন কোনো আয়োজন নেই তার পঞ্চাশতম জন্মদিন নিয়ে। তার লিবারেল পার্টি, তার সমর্থকগোষ্ঠী কিংবা নির্বাচনী এলাকারা মানুষেরা ঢাকঢোল পিটিয়ে তার জন্মদিন পালন করেনি। গত সপ্তাহে সিটিভির এক ইন্টারভিউতে রিপোর্টার তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন- কোভিডের সংক্রমণ যদি বেড়ে যায়, তা হলে ক্রিসমাসের ছুটিটা তিনি কীভাবে কাটাবেন। জাস্টিন ট্রুডোর উত্তর ছিলো- এবার তিনি কোথাও যাচ্ছেন না। আর তার জন্মদিনও পালিত হবে সাদামাটাভাবেই।

কয়েকদিন আগে টরন্টো স্টারের সিনিয়র সাংবাদিক সুজান ডেলকোর্ট তাঁর দীর্ঘ একটি ইন্টারভিউ করেছেন। ইন্টারভিউটা আসলে ছিলো বছর শেষের সাক্ষাতকার। সেই ইন্টারভিউতে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, জন্মদিনে তাঁর পরিকল্পনা কী?
– ইটস নট অ্যা বিগ ডিল- নিস্পৃহ উত্তর ছিলো জাস্টিন ট্রুডোর।

রিপোর্টার সুজান ডেলকোর্ট আর প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর ব্যাপারটাও কিন্তু মজার। ঠিক ১০ বছর আগে ট্রুডো যখন চল্লিশে পা দেবেন, তখনো তাঁর ইন্টারভিউ করেছিলেন সুজান। সেই ইন্টারভিউতে নিজের বয়স চল্লিশ হওয়াকে ‘ভেরি মাইলস্টোন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন তিনি।
১০ বছর আগের স্মৃতিচারণ করেছেন সাংবাদিক সুজান ডেলকোর্ট। জন্মদিনের উপহার হিসেবে তিনি সবেমাত্র কাঁধে ট্টাু করেছেন। চল্লিশতম জন্মদিনে তিনি কী করতে চান?- এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রুডো যা বলেছিলেন তা সবাইকেই চমকে দিয়েছিলো।
‘সিনেটর প্যাট্টিক ব্রাজেওর সাথে প্রকাশ্যে বক্সিং লড়তে চাই’- অকপটে উত্তর দিয়েছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন, তিনি জীবনের নতুন দশক শুরু করতে চান প্যা্ট্িটক ব্রাজেওর সাথে বক্সিং লড়ে।

প্যট্টিকের সাথে বক্সিং এ ট্রুডো জিতবেন- সেটা কেউই আশা করেনি। ট্রুডোকে নিয়ে তার শুভাকাংখীদের মধ্যে তখন অন্য ভাবনা। লিবারেল পার্টি তখন নেতৃত্বের সংকটে, পিয়েরে ট্রুডোর ছেলে জাস্টিন ট্রুডো যেনো লিবারেল পার্টির নেতা হিসেবে রাজনীতিতে আসার প্রস্তুতি নেন- সেই চাপ ছিলো তার উপর। দশ বছর আগের ইন্টারভিউতে তিনি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন লিবারেল পার্টির নেতা নির্বাচনের সামনের (২০১১ সালের) লড়াইয়ে তিনি প্রার্থী হচ্ছেন না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সিনেটর প্যাট্টিকের সাথে বকিং এ তিনি জিতে যান। বক্সিংএর জয়টাই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় বলে অনেকে মনে করেন। বক্সিং জিতে জীবনের যে দশক তিনি শুরু করেন, সেই দশকেই তিনি রাজনীতির উজ্জল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেন।

পুরনো ইন্টারভিউ থেকে স্মৃতিচারণ করছেন সাংবাদিক সুজান ডেলকোর্ট, যেই ইন্টারভিউতে জাস্টিন ট্রুডো বলেছিলেন, চল্লিশ বছর বয়সে আমি চাইতাম, খুব করে চাইতাম সবাই আমাকে জাস্টিন ডাকুক। আমি চাইতাম আমার বাবার পরিচয় থেকে আমাকে আলাদা করে সবাই ভাবুক, সবাই আমাকে আলাদা করে দেখুক’।
এখনো কেউ যখন তাকে তার বাবা কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোর সাথে তুলনা করে তিনি তার প্রতিবাদ করেন। জাস্টিন ট্রুডোর ভাষ্য, আমি সারাক্ষণই বাবাকে ভাবি, বাবার কথা ভাবি। কিন্তু আমি চাই- মানুষ আমাকে আমার মতো করেই দেখুক’।

দশ বছর পর বয়স যখন ৬০ হবে, তখন নিজেকে কোথায় দেখতে চান?- সুজানের প্রশ্ন ছিলো এটি। জাস্টিন ট্রুডোর জবাব চল্লিশ বছর বয়সেও তো আপনার এই প্রশ্নটা ছিলো। তখন কী আমি জানতাম পঞ্চাশ বছর বয়সে আমি কোথায় যাবো? পঞ্চশে দাঁড়িয়েও আমি কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না।
৬০ বছর বয়সে ব্যক্তিগতভাবে তিনি কোথায় যাবেন- সে ব্যাপারে ঝুঁকি নিতে না চাইলে ও আগামী দশকে কিংবা তার পরবর্তী সময়ে কানাডার রাজনীতির গতির একটা ছক তিনি কষে ফেলেছেন। পশ্চিমের রাজনীতি এখন ডান আর বামে বিভাজিত হয়ে পরছে। দুইয়ের বিভাজন থেকে ছিটকে পরা সাধারন মানুষগুলোর জন্য রাজনীতিতে একটা স্পেস থাকা দরকার। সেই মিডল স্পেসটাই হচ্ছে আসলে পশ্চিমের রাজনীতির আগামী দিনের রাজনীতির চালিকা শক্তি।

আরেকটা জিনিস তিনি নিজের জন্য মন্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন- কানাডায় কিংবা রাজনীতিতে ‘ফিনিশ লাইন’ বলে কোনো কিছু নেই। প্রতিটি চ্যালেঞ্জেই নতুন সুযোগ এবং সম্ভাবনা আছে, আর এটাই রাজনীতির ভবিষ্যতের বাস্তবতা। সামনের দিনগুলোতে তিনি কেবল এই কথাটাই মনে রাখতে চান, আর কিছু না।তা হলে পয়েন্টটা কী দাঁড়ালো?- তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি, একজন রাজনীতিকের সাফল্যের কোনো চূড়া নেই, বরং সফলতার পথে যাত্রা আছে কেবল।
শুভ জন্মদিন জাস্টিন ট্রুডো।
লেখক: নতুনদেশ এর প্রধান সম্পাদক এবং ‘শওগাত আলী সাগর লাইভ’ এর সঞ্চালক।