Home কলাম নেশার ঘোরে ওরা করে অনধিকার চর্চা

নেশার ঘোরে ওরা করে অনধিকার চর্চা

খুরশীদ শাম্মী : এবার দুর্গাপূজা উৎসব চলাকালে বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় একটি পূজামণ্ডপে কোরআন রাখাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের উপর নানানভাবে হামলা করা হয়েছে। হিন্দুদের বাড়িতে লুটপাটসহ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের বাড়িঘর, শেষ সম্বলটুকুও। গত একসপ্তাহে ভিন্ন ভিন্ন সহিংস আক্রমণে প্রায় সাতজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। অবশেষে জানা গেল, হিন্দু কিংবা অন্যধর্মের কেহ নয়- ইকবাল হোসেন নামে একজন মুসলমান নিজের ধর্মগ্রন্থ উদ্দেশ্যমূলকভাবে পূজামণ্ডপে রেখে এসেছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু স¤প্রদায়ের জনগণের উপর নির্যাতন ও ধর্মীয় উৎসব পণ্ড করার এই যে প্রচেষ্টা, মোটেও নতুন কিছু নয়। আমি মনে করি, হিন্দু মুসলমানের প্রাচীন বিবাদে নতুন আর একটি মোটা দাগ।

আমরা যদি গোড়া থেকে শুরু করি তবে স্পষ্ট দেখতে পাই যে, সকল ধর্মের সূচনা কিন্তু সেই হিংসা, কলহ, দাঙ্গা থেকে। প্রাকৃতিক জীবনসংগ্রামে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতো অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও কিন্তু একই ঈশ্বরের উপাসনা করার মধ্যেই তাদের ধর্মকে সসীম রেখেছে। তবুও বিশ্বের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন ধর্মের নামে হচ্ছে বিরোধ, কলহ, মারামারি, মৃত্যু পর্যন্ত। সৃষ্টিকর্তা যদি একজনই হয়ে থাকেন, তবে বিশ্বে এতগুলো ধর্ম উৎপত্তির কারণ কী হতে পারে? যদি একই ঈশ্বর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পয়গম্বর অর্থাৎ বার্তাবাহক পাঠিয়েই থাকবেন, তবে তো সকল বার্তাবাহকের বক্তব্য এক ও অভিন্ন হওয়ার কথা ছিল। ধর্মকে কেন্দ্র করে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও স¤প্রীতি থাকার কথা ছিল। কিন্তু ইতিহাস তো তা বলে না। বরং বার্তাবাহকেরা ধর্মের নামে নিজেদের প্রচার করেছেন, নির্বোধ মানুষগুলোকে ব্যবহার করেছেন, যুদ্ধ করেছেন। ঈশ্বরের এক ইশারায় যদি সবকিছুই করা সম্ভব হতে পারে, তবে তার পয়গম্বরদের কেন প্রাণঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছিল? এই প্রশ্নগুলোর একক উত্তর হলো, আসলে যুগে যুগে আবির্ভূত পয়গম্বর ও ধর্মপ্রচারকগণ কিছু ধর্মভীরু মানুষদের রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত ও অমর করেছিলেন, যেমনটি রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা করে থাকেন বরাবর। দলছুট নেতাদের দ্বারা নতুন নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হওয়া এর একটি বড় উদাহরণ। সুতরাং ধর্ম রাজনীতি ব্যতীত অন্য কিছু নয়।

যেহেতু ধর্মের উৎপত্তিকালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশ্ব এতটা উন্নত ছিল না, সুতরাং ধর্মপ্রচারকদের জন্য খুব সহজ ছিল মানুষদের অযৌক্তিক অলৌকিক বিষয়গুলো বোঝানো এবং অন্ধ-সমর্থক জোগানো। প্রত্যেক নবী ও রসূলের জীবনীতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে তখনকার দাঙ্গাগুলো, যেমনটি আমাদের বর্তমান বিশ্বেও হচ্ছে অহরহ। তখনকার মতো এখনও স্বার্থপর ও বোকা মানুষেরা ক্ষমতাধরদের সমর্থন করে বিভাজন সৃষ্টি করে সমাজে, তবে নতুন নতুন ধর্ম সৃষ্টি হয় না আর। সর্বশেষ রসূলের জীবনী থেকে জানা যায় যে তিনি প্রথম তিন বছর ধর্ম প্রচার করেছিলেন গোপনে, মূলত স্বল্প পরিসরে। চতুর্থ বছরে তখনকার আরবের অন্যতম বীর পুরুষ ইসলাম গ্রহণ করার পরই তারা অন্যধর্মের উপাসনালয় কাবা শরীফে দলবলসহ পৌঁছে ইসলাম ধর্ম প্রচার করা শুরু করেছিলেন, তখন উপস্থিত অমুসলিমরা বাধা দেওয়ায় সেখানে শুরু হয়েছিল বিবাদ, মানুষ হারিয়েছিল প্রাণ। সেই থেকে উপাসনালয় থেকে বের হতে পারেনি বিবাদ।

হ্যাঁ, মৌলবাদীদের সকল ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু উপাসনালয়, হোক তা কারণ ইবাদত কিংবা বিবাদ। সেইজন্যই কিছুদিন পর পর মসজিদ, মন্দির, গির্জা, সিনাগগে প্রার্থনার পাশাপাশি ভাঙচুর, হামলার খবর শোনা যায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বলে বিশ্ব এগিয়ে গেলেও মৌলবাদীরা আটক রয়েছে একই স্থানে। বিশ্বে হাজারো ভালো কাজ করার সুযোগ থাকলেও তারা নিজেদের প্রায় সবকিছু থেকে বিরত রেখে ঐ এক ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ, উপাসনালয়কে কেন্দ্র করে কিছুদিন পর পর পরস্পর পরস্পরের শক্তি ও বিশ্বাস পরীক্ষা করে। সেই যুক্তিতে মৌলবাদ একটি মারাত্মক রোগ। এই রোগে পচন ধরে প্রথমে মগজে, তারপর অন্তরে। ধর্মের ওজুহাতে তারা পুড়িয়ে দিতে পারে মানুষের আশ্রয়স্থল, জীবন্ত মানুষ, মনুষ্যত্ব, সবকিছু। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের রক্ত ও জীবন নিয়ে পরীক্ষা করে নিজেদের বিশ্বাসের মাত্রা।

যেহেতু জন্মের পর পরই পরিবার ও সমাজ থেকে ধর্মশিক্ষা একপ্রকার বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়, সুতরাং ধর্ম পালন প্রায় সকলের প্রত্যাহিক জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কোনো এক পর্যায়ে ধর্মীয় আচার-আচরণকে আমরা সংস্কৃতি হিসেবেও বিবেচনা করি, যদি না আমরা যুক্তি-পাল্টা যুক্তিতে নিজেদের মুখোমুখি করতে শিখি। তবে মানুষের মধ্যে ধর্ম বিশ্বাস থাকলেই যে মানুষ হিংস্র হবে এমন কথাও সত্যি নয়। অধিকাংশ মানুষই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ধর্মীয় রীতিনীতিকে বিশ্বাস করে ধর্মভীরু হয়ে ওঠে। আবার কিছুসংখ্যক মানুষ ধর্মের মারপ্যাঁচ বুঝেও ধর্মীয় নিয়মনীতিগুলোকে যতটুকু সম্ভব নিজেদের মতো করে যুগের সাথে পরিবর্তন করে মেনে চলেন কিংবা সমাজের শান্তি রক্ষার্থে অন্যের বিশ্বাসের প্রতি সম্মান দেখিয়ে নিজের মতো জীবনযাপন করেন। তবে ধর্ম নিয়ে হাঙ্গামা করে দুই ধরণের মানুষঃ

১ । শিক্ষিত স্বার্থপর মানুষ, যারা স্বার্থের নেশায় ধর্ম ও ধর্মান্ধদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এবং সুযোগ পেলে তাদের লেলিয়ে দেয়।

২। কুশিক্ষিত, অশিক্ষিত ও নির্বোধ মানুষ, যারা ঈশ্বরের ভয়ে ও স্বর্গের লোভে ভালোমন্দ বিচার না করেই যে যা বলে সবকিছু গোগ্রাসে গিলে ফেলে। এদের সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি বোঝার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই। এরা যুক্তিতে নয় অলৌকিক রূপকথার গল্পে নেশা করে। অতিরিক্ত সেবনের ফলে এরা নেশার চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, সুতরাং ওদের ওলাওঠা দেখা দেয়। আর তখনই তারা নোংরা করে পরিবেশ।

তবে এদের দু’দলই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৌলবাদী ও নেশাগ্রস্ত। নেশার ঘোরে ওরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের আঘাত করে, শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে, যা ওদের অনধিকারচর্চা।
খুরশীদ শাম্মী : টরন্টো, কানাডা
kjshammi@yahoo.com

Exit mobile version