মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
মনিস রফিক
ষাট.
২০১১ সালের নির্বাচনের পর লিবারেল পার্টি অব কানাডার অস্তিত্বের বিষয়টিই বারে বারে আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে, তখনও আমি ভাবিনি যে আমাকে কখনও এই পার্টির নেতৃত্বে আসতে হবে। সেই সময় আমাদের আসল অবস্থাকে আর কোনভাবেই ঢেকে রাখার আর কিছুই ছিল না। আমরা মানসিকভাবেই অনুধাবন করেছিলাম, আমরা পরাজিত হয়ে গেছি। ১৯৯৩ সালে প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভদের ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল সেটা কিন্তু একেবারে নাটকীয় কিছু ছিল না, যখন তারা অতি আত্মবিশ্বাসী সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস্থা থেকে মাত্র দুটি আসন পেয়েছিল, তার দীর্ঘ একটা কারণ ছিল।
সত্যি বলতে কি, বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করলে বলতে হয়, এমন খারাপ ফলাফলের পেছনে কিছু কারণ থাকে। প্রগ্রেসিভ কনজারভেটিভরা তাদের কার্যকলাপ ও পরিকল্পনার জন্যই তাদেরকে এমন এক আচমকা দূর্যোগের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। লিবারেল পার্টির ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছিল এবং বিষয়টা একটু প্রবাদের সুরে বলতে গেলে বলতে হয়, এ ছিল তেলের মধ্যে পড়ে সিদ্ধ হয়ে যাওয়া ব্যাঙ এর মত অবস্থা। ২০০০ সালে নির্বাচনে যখন ১৭২ আসন পেয়ে এ দলটি এক সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠন করেছিল, সেই দলই ২০০৪ সালে ১৩৫ এবং ২০০৬ সালে ১০৩ আসন পেয়ে বিরোধী দল হিসেবে কাজ করে। আমি যখন প্রথম নির্বাচন করি সেই ২০০৮ সালে লিবারেল পার্টি মাত্র ৭৭টি আসনে জয়ী হয়েছিল। এই ক্রমে ক্রমে পার্লামেন্টে আসন সংখ্যা কমে যাওয়া দলটি যখন ২০১১ এর নির্বাচনে মাত্র ৩৪টি আসন পেল, তখন কোনভাবেই একে নিছক এক দূর্ঘটনা বলা যাবে না। দীর্ঘদিন ধরেই দেখা যাচ্ছিল লিবারেল পার্টি ধীরে ধীরে তার আসনগুলো হারিয়ে ফেলেছে এবং এক যুগের মধ্যে তার সমর্থক সংখ্যা অর্ধেক এ নেমে এসেছে। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম, দলের কিছু মৌলিক বিষয় না পরিবর্তন করলে আমাদের অবস্থা সেই তেলে সিদ্ধ হওয়া ব্যাঙ এর মতই হবে।
২০১১ সালের সেই বিপর্যয়ের ব্যাপারে সবারই কিছু না কিছু বলার ছিল। কেউ কেউ মনে করে সেটার অন্যতম কারণ ছিল কনজারভেটিভদের নেতিবাচক প্রচারণা, কেউ হয়তো আবার তাদের মরিয়া হয়ে সাংগঠনিক কাজকর্ম করা আর তহবিল সংগ্রহের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে, অনেক আবার এমনও বলে যে এটা সম্ভব হয়েছিল মাইকেল ইগনাতিয়েফ এর ব্যর্থ নেতৃত্বের ফলে। আমি মনে করি এইসব চিন্তাভাবনা একেবারে ঠুনকো এবং ঠিক নয়। আসল সত্যটার সামনে দাঁড়ানো খুব কষ্টের এবং এর মুখোমুখি হওয়া খুব একটা সহজ একটা ব্যাপার নয় এবং সাধারণত এমনই হয়ে থাকে। আসলে কানাডিয়ানরা লিবারেল পার্টির যা প্রাপ্য সেটাই অক্ষরে অক্ষরে বুঝিয়ে দিয়েছিল। আমি জানি অধিকাংশ লিবারেলদের তখন এটা শুনতে ভালো লাগতো না, এমনকি এখনও এটা শুনতে ভালো লাগবে না। কিন্তু এটাই সত্য আর একে মনে রাখা সবারই প্রয়োজন।
এক যুগের বেশী সময় ক্ষমতায় থাকাকালীন লিবারেলরা অন্তর্কলহে ভুগেছে আর এর ফলে নিজেদের নিয়ে যত বেশী নিজেরা ব্যস্ত থেকেছে, তার সামান্যটুকুও দেশের মানুষ নিয়ে করে নি। কিন্তু এই মানুষগুলোই তাদের নির্বাচিত করেছিল এবং গভীরভাবে বিশ্বাস করেছিল। আর লিবারেলদের মধ্যে যে ধারণা আছে যে, জনগণ দেশ শাসন করার জন্য লিবারেল পার্টিকেই সব সময় পছন্দ করবে। লিবারেলদের এই আত্মতৃপ্তি কিন্তু লিবারেলদের জনগণের কাছ থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছিল। আমি মনে করি, সবার মধ্যে গেঁথে যাওয়া এই ধারণাটা একটা মারাত্মক ভুল। এই যে লিবারেলরা সব সময়ই আত্ম-অহমিকায় ভুগে এবং সব সময় বলে বেড়ায় যে, ‘লিবারেল পার্টি কানাডা সৃষ্টি করেছে।’ মনের গভীরে গেঁথে থাকা এমন ধারণা লিবারেল পার্টির পরাজয়ে অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি। আর যায় হোক, নিজেদের মধ্যে বড়াই সূলভ এমন ধারণাকে সাধারণ মানুষ কখনও ভালোভাবে নেয় না। এমন বিষয়টা উপলব্ধি করেই সাত মাস পর যখন আমি আমার নেতৃত্বের প্রচরণায় নেমেছিলাম তখন প্রথমেই বলেছিলাম, ‘লিবারেল পার্টি কানাডা সৃষ্টি করেনি, বরং কানাডায় লিবারেল পার্টিকে সৃষ্টি করেছে।’
অনেক সফল সংগঠনের মত এই দলটিও এক সময় সফলতার পথে এগিয়েছে এবং এমন এক অবস্থায় নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করেছে যে, জনগণ একে বিশ্বাস করেছে এবং এর ফলে এটা সব সময় সফল হবে এমন একটা ধারণাই লিবারেলদের মনের মধ্য গেঁথে গিয়েছিল। কিন্তু এর সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলোর প্রায় সবাই ভুলতে বসেছিল যে কিভাবে লিবারেল পার্টি তার চলার এই গতিটি অর্জন করেছিল। বিংশ শতাব্দীতে লিবারেল পার্টি ভালো করেছিল কারণ এটা কানাডার মানুষের চিন্তা চেতনা আর চাওয়া পাওয়ার সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিল। গোটা দেশের ছোট বড় সব জাতি আর স¤প্রদায়ের মানুষের চাওয়া পাওয়ার প্রতিফলন ঘটেছিল লিবারেল পার্টির কাজ কর্ম আর পদক্ষেপে। এটা ছিল তাদের চিন্তা চেতনা, আশা আর স্বপ্নের এক পরীক্ষিত প্লাটফর্ম। আস্তে আস্তে জনগণের সাথে সেই সংযোগটা আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম। সম্ভবত এটা শুরু হয়েছিল আমার বাবার শাসনকালে। তৃণমূল পর্যায়ে যে পরিমাণ কাজ করা উচিৎ ছিল বলে আমি মনে করি তিনি সে ধরনের কাজ করেন নি। এটার চরম ফলাফল দেখা যায় গত শতকে যখন সংখ্যালঘিষ্ঠ কনজারভেটিভ সরকারের বিরোধী পক্ষ হয়ে আমরা কাজ করছিলাম। সেই সময়ও আমাদের মধ্য সেই আত্ম-তৃপ্তির অহমিকাটা ছিল এবং আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, এমন ছোট খাটো অঘটন রাজনীতিতে ঘটেই থাকে এবং আমরা খুব দ্রুতই আবার ক্ষমতায় যাবো। এটা সত্য, এই সব চিন্তা ভাবনা ছিল মৌলিকগতভাবে ভুল। কিন্তু এগুলোতো আর সবাইকে অমনভাবে স্পর্শ করে না। আমি বলিষ্ঠভাবেই বলতে চাই ২০১১ সালের নির্বাচনে ভরাডুবির জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। কানাডার জনগণের সাথে লিবারেল পার্টির যে দূরত্ব তৈরী হয়েছিল, সেটাই ছিল এর প্রধানতম কারণ। আর এই দূরত্ব কখনোই জনগণ তৈরী করে নি, বরং লিবারেল পার্টিই তৈরী করেছিল।
সেই বসন্তে আমার মনে যে প্রশ্নটি ফিরে ফিরে আসছিল, তা হচ্ছে আমাদের আবার শুরু করতে হবে একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে, আর আমার দল কি এর জন্য প্রস্তুত আছে?
লিবারেল পার্টিকে যারা আকড়ে ধরে আছে, সেই ২০১১ সালের নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে তাদের কাছে ‘আবার জয়ী হওয়া’ বিষয়টি ছিল সুদূর পরাহত। আমার তখন মনে হয়েছিল, এই কঠিন সময়ে গণমাধ্যমের সামনে উপস্থিত হয়ে কথা বলাটা আমার পরম দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমি জানতাম এর জন্য আমাকে বারংবার প্রশ্নবিদ্ধ করা হবে আমি পার্টির নেতৃত্বের দিকে নিজেকে এগিয়ে দিচ্ছি কিনা, যদিও সেই সময় আমার মনের মধ্যে তেমন কোন ভাবনা ছিল না। তারপরও আমি জানতাম, আমি যদি গণমাধ্যমের সামনে কোন দূর্বোধ্য বা অযথাযথ উত্তর দিই, সেটা দলের জন্য আরো বেশী ক্ষতির কারণ হতে পারে, আর কিছু লিবারেল ভাবতেই পারে দলের এই খারাপ সময়ের সুযোগ নিয়ে আমি জনপ্রিয় হতে চাচ্ছি এবং শেষ পর্যন্ত আমি নিজেকে নেতা বানাতে চাচ্ছি। গণমাধ্যমের সামনে সেই সময় আমি যে সব কথা বলেছি সেগুলো ছিল একেবারে সহজ আর সরাসরি। আমি বলেছি এবং বারবারই বলেছি, আমরা নিজেরাই নিজেদের জন্য যে গর্ত খুড়েছি, সেখান থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হলে শুধু প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম। আমি তখন গভীরভাবে বিশ্বাস করতাম, এমনকি এখনও করি কানাডার মানুষ আমাদের কাজের মূল্যায়ন করবে আমরা আসলেই তাদের চাওয়া পাওয়াকে মূল্য দিচ্ছি কিনা আর আমরা আমাদের প্রতি তাদের সেই বিশ্বাসকে ফিরিয়ে দেবার জন্য সৎভাবে কাজ করছি কিনা।
বক্সিং রিং এ প্রায় পরাস্ত হয়ে যাওয়া বক্সারকে যেমন হঠাৎ বেজে উঠা ঘন্টা বাঁচিয়ে দেয়, ঠিক তেমনি ২০১১ এর নির্বাচনের পরের গ্রীষ্মটা আমার কাছে এক কৃপা নিয়ে এসেছিল। আমি সেই গ্রীষ্মটা প্রায় পুরোটায় সোফি এবং আমার ছেলেমেয়ের সাথে কাটিয়েছিলাম। আমার প্রাণশক্তি জাগিয়ে তোলার জন্য আমি বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের সাথে সময় কাটানোর জন্য ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় চলে গিয়েছিলাম। জাভিয়ার আর এলা-গ্রেস সেই অসম্ভব সুন্দর ওয়েস্ট কোষ্ট বীচেস এ ছুটোছুটি করে কাটিয়েছে। আর সেই সময় আমরা নির্বাচনের বেদনার ভাবনায় ডুবে না থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে প্রচুর সময় ব্যয় করেছি।
সেই গ্রীষ্মটা আমার জীবনে আরেক দিক দিয়ে ছিল খুবই গুরুত্বপুর্ণ। সেই গ্রীস্মেই আমি চল্লিশে পা দিয়েছিলাম। চল্লিশ এমন একটা বছর যখন অনেকের জীবনেই বোধিত্ব ঘটে। আমিও আমার নিজের জীবন গ্রন্থে এই সময়টা আমার জীবনের নতুন পথে এগুনোর এই চিরস্থায়ী ব্রত নিয়ে ফেললাম। আমি যখন খুবই ছোট ছিলাম, সম্ভবত আমার বয়স পাঁচ বা ছয় বছর হবে, তখন আমার বাবা আমাকে প্যাসিফিক কোস্টের হাইদা গোওয়াই’য়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই হাইদা মানুষেরা পৃথিবীর সেই অসম্ভব সুন্দর জায়গায় হাজার হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসছে। তারা তাদের সংস্কৃতির ইতিহাসকে সেই সময় থেকে বয়ে নিয়ে আসছে। তাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য আর সৌন্দর্য এত বেশী অপূর্ব ছিল যে সেটা ইউরোপ ও অন্য জায়গা থেকে আসা কানাডিয়ানদের পক্ষে কখনও অনুধাবন বা উপলব্ধি করা কখনও সম্ভব নয়। (চলবে)