ইউসুফ কামাল : স্বপ্নের দেশ, মায়াবী দেশ, প্রাচুর্য্যের দেশ, ল্যান্ড অব অপারচুনিটি-আরো কত নামে যে মানুষ আমেরিকাকে বিশেষায়িত করে তার শেষ নেই। পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ হিসেবে এ দেশে সব আছে, তবে সেটার সাথে নিজেকে উপযোগী করে নিতে হলে প্রথমতঃ এ দেশের আইন কানুন মেনে নিতে হবে। তবে সত্যিকারে খুব ভালো অবস্থায় বাস করা মানুষের সংখ্যা এ দেশে খুব একটা বেশি না। বেশি অংশ মোটামুটিভাবে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকে, ব্যাস এর বেশি নয়। তখন আমি হিউষ্টনের এলজি’স রোডের চ্যান্ডলার পার্ক এলাকার বাসিন্দা। আবু জাহিল মোহাম্মদ আমাদের তিন বিল্ডিং পরে থাকেন। প্রতিবেশীদের মধ্যে একজন মিশুক ও স্বজ্জন মানুষ হওয়ায় কারণে জাহিলের সাথে আমাকে একজন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সার্বক্ষণিক হাসি খুশী মানুষটাকে প্রথম দিন দেখেই আমার বেশ ভালো লেগেছিলো। ধীরে ধীরে দেখলাম পরিচিত সবার পারিবারিক সমস্ত অনুষ্ঠানেই তার সরব উপস্থিতি। জন্ম সূত্রে আবু জাহিল মোহম্মদ মূলতঃ আলজিরিয়ান নাগরিক হলেও বর্তমানে সে বৈধভাবেই পুরোপুরি আমেরিকান নাগরিক। ’৯০ সালের দিকে ডিভি লটারীর বদৌলতে সে এ দেশে আসার সুযোগ পেয়েছিলো।
খুব একটা শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার কারণে প্রথম দিকে তার এ দেশে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিলো। তখন বয়স ছিলো কম কিন্তু বুকে ছিলো অসীম সাহস। এক মাত্র লক্ষ্যই ছিলো এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
পরিচয়ের দু’দিন পর জাহিল আমাকে বলেছিলো, আমেরিকায় আসবার আগে অনেকের মতো আমিও শুনেছিলাম আমেরিকা স্বপ্নের দেশ, প্রাচুর্য্যের দেশ। চারিদিকেই অফুরন্ত সুযোগ কিন্তু সেই প্রাচুর্য্য পেতে হলে যে প্রচন্ড পরিশ্রম করতে হয়, আর তার জন্য যে শুরুতে অনেক মূল্য দিতে হবে প্রথমে সেটা বুঝিনি। অনেক কষ্টের পর আমি এখন অর্থনৈতিকভাবে ভালো একটা অবস্থানে পৌঁছেছি। আমেরিকা আসার পর প্রথম দিকে নিউইয়র্কে থাকতাম। জীবনের বাস্তবতা কি এবং কেমন, সেটা আমি ওখান থেকেই বুঝেতে শিখেছি। প্রাথমিক পর্যায়ে বেঁচে থাকার সুযোগ সুবিধা নিউইয়র্কে বেশি। তবে সেগুলো বেশির ভাগ অনেক কষ্টের, তবে নিজেকে টিকিয়ে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে ওগুলো করতে হয়। আর মুষ্টিমেয় ভাগ্যবান কয়েকজন ছাড়া সবাইকেই এটা করতে হয়।
প্রথম দিকে কোথাও বদলী চাকরি, কোথাও আবার পার্টটাইম সেলস্ম্যানের চাকরিও করেছি। নিউইয়র্কে শীতকালে প্রচুর বরফ পড়ে, বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশীদের বাড়িতে ঢোকার রাস্তায় জমে থাকা বরফ কেটে রাস্তা বের করে দিয়েছি, বৃদ্ধদের গাড়ি পরিস্কার করে দিয়ে তার বিনিময়ে পারিশ্রমের মূল্য হিসেবে যে যা দিয়েছে সেটা নিতে কখনোই কার্পণ্য করিনি। শখ করে দেশে নিজেদের পারিবারিক ট্রাক চালানোর শিখেছিলাম? আর শখের সেটা যে এখানে এসে এমনভাবে কাজে লেগে যাবে তা আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারিনি। তিন মাস লেগেছে হেভি ট্রাক চালানোর জন্য এ দেশের ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে। ডিএমভি থেকে ট্রেনিং শেষ করে হেভি ট্রাক চালানোর লাইসেন্স নিয়েছি খুব ভালো ভাবে। তারপর থেকে আমার আর কোথাও থেমে থাকতে হয়নি। দূর পাল্লার ট্রাকে মালামাল পৌঁছে দেওয়ার কাজটা যথেষ্ট পরিশ্রমের ও ঝুঁকিপূর্ণ হলেও বেতনের পরিমাণের কথা চিন্তা করলে আর সাহসের অভাব হয় না। কখনো দুই তিন দিন অবিরাম চলার পর মাল গন্তব্যে পৌঁছিয়ে দিয়ে তবেই মুক্তি।
ড্রাইভিং সীটের পিছনে গাড়ির কেবিন বক্সের মধ্যে লম্বা একটা বিছানা আছে। সারাদিনের পরিশ্রমের পর রাতের ঘুমের কাজটা এখানেই সেরে নেওয়া যায়। আবু জাহিল সেদিন হাসতে হাসতে বল্লো, প্রায়ই বেশি দূরের ট্রিপ হলে আমার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে যাই একাকীত্ব দূর করার জন্য। কোন সমস্যা নেই, এ দেশ ব্যাক্তি স্বাধীনতার দেশ। নিয়মের মধ্যে থেকে এ দেশে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করা যায়। নিউইয়র্ক থেকে হিউষ্টনে স্থায়ী হয়ে প্রথমেই আমি বিয়ের কাজটা শেষ করে ফেলি, কনে মেক্সিক্যান মেয়ে ডরোথী। ও খুব ভাল মেয়ে, খুবই সংবেদনশীল। আমাকে সব বিষয়েই আন্তরিকভাবে সহায়তা করে, পুরো সংসারের দিকটা ও নিজেই দেখা শোনা করে। সংসারের পুরো দায়িত্বটা ওকে দিয়ে এখন আমি অনেক খানি মুক্ত। ওর গাড়ি চালানোর লাইসেন্স আছে, ছোট গাড়ি নিয়ে ও সাংসারিক সংশ্লিষ্ট কাজ করে বেড়ায়। তবে হাই ওয়েতে সে বড় গাড়ি চালাতে চায় না। তবে নিজের কাছের একজন মানুষ দূর যাত্রায় সংগে থাকলে কথাবার্তা বলে সময়টা ভালোই কেটে যায়। তাই তো ডরোথীকে প্রায়ই যাত্রায় সংগী করে নিই। টেক্সাসের হিউষ্টন থেকে কোন মালামাল নিয়ে যখন নিউইয়র্ক যাই, তিন দিন দুই রাত্রির ট্রিপ, প্রথম দিকে একটু ভয় পেতাম কিন্তু এখন এটাই আমার ফেভারিট ট্রিপ। আসা যাওয়ায় খুব ভালো টাকা পাওয়া যায়।
রাতে কোন লোকালয়ের সুবিধাজনক স্থানে ট্রাক পার্ক করে কেবিনের ভিতরে ঘুমিয়ে পড়ি আবার পরদিন সকালে রওয়ানা দিই। আমেরিকায় দুই শ্রেণীর মানুষের জীবন খুব স্বচ্ছলভাবে কেটে যায়। প্রথমত যারা কর্পোরেট টাইপের জব করে আর দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষ যারা টেকনিকাল জব করে। জাহিলদের মতো পরিশ্রমি মানুষ আছে বলেই আমেরিকা তার গতি ধরে রাখতে পেরেছে, আর জাহিলদের মত মানুষরাও ভালো মতো বেঁচে আছে। এ যেন উভয়ই উভয়ের পরিপূরক। সত্যিকারেই তাই জাহিলরা না থাকলে এখন আমেরিকা অচল হয়ে যাবে। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, কেটি, টেক্সাস, ইউএসএ