ইউসুফ কামাল : হিউষ্টনের এলরিজ রোডের চেঞ্জলার পার্ক এর এপার্টমেন্টে আমার প্রতিবেশী ছিলো ভারতের হরিয়ানার অধিবাসী আশফাক, এক নম্র স্বভাবের অমায়িক ভদ্রলোক। ছোট দুই পুত্র সন্তান আবির আর এডাম সংগে স্ত্রী নূজহাতকে নিয়ে ওর ছোট্ট পরিবার। আশফাক একজন আইটি বিশেষজ্ঞ হিসাবে হিউষ্টনের এক তেল কোম্পানীতে ভালো বেতনের চাকুরী করেন। আশফাকের জন্ম ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের ফরিদাবাদ জেলায়। কয়েক পুরুষ ধরেই ওরা বল্লভগড় শহরের আটালী গ্রামের বাসিন্দা। দাদার আমল থেকেই ওরা প্রচুর জমি জমার মালিক, ওর কথায় আমার মনে হয়েছে জন্মের পর থেকেই সে পরিবারের স্বচ্ছলতা দেখে এসেছে।
আশফাকের স্ত্রী নূজহাত পাশের জেলা শহর গূড়গাও এর বাসিন্দা। স্বামী স্ত্রী দুজনের মধ্যেই দেখেছি প্রতিবেশীদের সাথে তাদের মেলামেশার বিষয়ে কোন রকম জড়তা নাই। ভারতীয়দের নিয়ে এখানের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন রকমের চিন্তাধারা আছে, সেটা থাকতেই পারে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে এরা দুইজনই পরিচ্ছন্ন মনের মানুষ, জাতী ধর্ম নিয়েও ওদের মধ্যে কোন রকমের গোঁড়ামির লেশ মাত্র নেই।
প্রথম দিন ওদের বাসার দাওয়াতে যেয়ে একটু অবাকই হয়েছিলাম হাতে বানানো রুটি দেখে, যা সাধারনত আমেরিকাতে দুষ্প্রাপ্যই বলা চলে। কারণ এখানকার মানুষের রুটি তৈরী করার মতো এত পর্যাপ্ত সময় নেই, যেখানে অল্প মূল্যেই তৈরী রুটি দোকান থেকেই কিনতে পাওয়া যায়। একমাত্র ভারতীয় ও পাকিস্তানিরাই এটা পারে। ঘরে বাইরে দুইজন মানুষ, হাতে তৈরী রুটি মাংস দিয়েই রাতের প্রধান খাবার শেষ করেন, সাথে ঘরে তৈরী করা দই ও অল্প মিষ্টি জাতীয় খাবার। আমাদেরও ওভাবেই আপ্যায়িত করলেন। রান্নার কাজে স্ত্রীকে যে সব সময়ই সহায়তা করে সেটা অল্প সময়েই বুঝে ফেল্লাম ওদের দুজনের কিচেনে ভাগাভাগি করে কাজ করা দেখে।
মোট ২২টি জেলা মিলে হরিয়ানা রাজ্য এদের প্রচলিত ভাষা হিন্দি ও পাঞ্জাবী। জনসংখ্যা হিসাবে সারা ভারতের মধ্যে হরিয়ানা ১৮তম জনবহুল রাজ্য। উত্তরে পাঞ্জাব আর হিমাচল প্রদেশ পশ্চিমে রাজস্থানের বিস্তীর্ন মরুঅঞ্চল আর পূর্ব দিক দিয়ে বয়ে চলেছে যমুনা নদী। হরিয়ানা ভৌগলিকভাবে দিল্লীকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে। যৌথভাবে হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের রাজধানী চন্দ্রিগড়। কারুকার্য্য করা রকমারী পোশাক, মৃৎ শিল্প, আর জমকালো লোক নৃত্যের জন্য হরিয়ানা এখনো সারা ভারতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। মনে পড়লো ২০০৫ সালে ভারতের আজমীর শরীফ যাওয়ার কথা। ঢাকা থেকে প্লেনে দিল্লী তারপর ওখান থেকে ‘মেটাডোর’ নিয়ে সড়ক পথে হরিয়ানা হয়ে আজমীর শরীফ এ গিয়েছিলাম। সংগী ছিলেন সদ্য প্রয়াত যুগ্ম সচিব ফরহাদ ভাই, তার স্ত্রী ও ছোট ছেলে। তার পরিবারের সদস্যের বাইরে আমি আর ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজার বন্ধু আনোয়ারসহ মোট পাঁচ জন। পথিমধ্যে খরা প্রবন হরিয়ানায় স্বল্প সময়ের যাত্রা বিরতি নিয়েছিলাম দুপুরের খাওয়ার জন্য। মহাসড়কের বিভিন্ন স্পটে প্রচুর পরিমাণে বানরের উপস্থিতি লক্ষ্য করলাম। এলাকায় এত বানরের কারণ জিজ্ঞাস করে জানতে পারলাম, বেশ কিছু দিন ধরে এই রাজ্য ব্যাপী খরা চলছে যার জন্য এবার বন জংগলের গাছে ফলমুল হয়নি।
খাবার না পেয়ে, ঐ সমস্ত লোকালয় থেকে বানরেরা খাবারের সন্ধানে মহাসড়কের আশে পাশে চলে এসেছে। মহাসড়কের পাশের দোকানে আসা মানুষ জনের সামনে ভীড় করে বসে আছে, অসংখ্য বানর খাবারের আশায়। জনতা হাতে করে কলা, বিস্কুট, বাদাম যে যা পারছে ওদেরকে খেতে দিচ্ছে, এ একটা অভিনব দৃশ্য। জীব এর প্রতি মানুষের এই দয়া না দেখলে আমার বিশ্বাসই হতো না। ক্ষুধার কাছে সবাই যে জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নও ভুলে যায় সেটার নতুন একটা চিত্রও সেদিন দেখেছিলাম ঐ প্রাণী কুলের মধ্যেও। চলন্ত গাড়ি থেকে ছুঁড়ে দেওয়া খাবার সংগ্রহ করার জন্য চলন্ত যানবাহনের মধ্য দিয়ে ওদের ছুটে যাওয়া। যার মধ্যে শতভাগ জীবনের ঝুঁকি থাকলেও সেটা ওদের ক্ষুধার কাছে হার মেনে গিয়েছিল। প্রায় দশ বছর আগে আশফাক যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৃত্তি নিয়ে টেক্সাসের এ এন্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে পড়তে আসে। লেখাপড়া শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের এইচ-১ ভিসা নিয়ে হিউষ্টনে থেকে যায়। আশফাকের কাছে সেদিন কথায় কথায় জানতে চেয়েছিলাম, চাকরি শেষে কি দেশে ফিরে যাবেন? খানিকটা বিষাদ কন্ঠে বল্লেন আগে তাইতো ভেবে রেখেছিলাম, মাতৃভূমির টান যে ভোলা যায় না। পৃথিবীর যত উন্নত স্থানেই আপনি থাকেন, মাতৃভূমি যত অনুন্নত হোক না কেন মাতৃভূমির প্রতি মায়া কিন্তু সবার মধ্যে থেকেই যায় যা আমার মধ্যেও ছিলো। চলে যাবো সেভাবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিলো কিন্তু, ২০১৫ সালে আমার জন্মস্থান বল্লভগড়সহ সমস্ত এলাকা জুড়ে হিন্দু মুসলমান দাংগার পর আমি সেই স্বপ্ন বদলে ফেলেছি। বলা চলে বদলাতে বাধ্য হয়েছি। তা ছাড়া ভেবে দেখলাম আমার সন্তানরা এ দেশে পড়ালেখা করে। ওরা কি এ দেশের পরিবেশে বাস করে, এ দেশের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমার নিজের দেশে যেয়ে থাকতে পারবে?
প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে যে মসজিদ আমরা দেখে এসেছি, আমার বাবা চাচা ওখানে নামাজ পড়তেন সেটা হঠাৎ করেই কেমন করে যেন গ্রাম পঞ্চায়েতের সম্পত্তি হয়ে গেলো! তখন ফরিদাবাদ কোর্ট সেটাকে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে মুসলিমদের পক্ষে রায় দিলেও স্থানীয় হিন্দু সমাজ যে কোন মূল্যে এটা ভাংগার পক্ষে জোরদার দাবি করে যাচ্ছে। তাদের যুক্তি, মসজিদ লাগোয়া ঐ মন্দিরই প্রমাণ করে উক্ত জমির মালিকানা তাদের। তারা এখন ঐ মসজিদ ভেংগে মন্দির স¤প্রসারণ করবে। তাদের সেই দাবির প্রক্ষিতে তারা আমার নিজের আটালী গ্রামের মুসলিমদের ঘরবাড়ি জ্বলিয়ে দেয়, যার ফলে ৪০০ মুসলিম পরিবার সরাসরি গৃহহীন হয়ে পড়ে।
আরো অনেকে জীবন বাঁচাতে ভয়ে এলাকা ত্যাগ করে বিভিন্ন জেলায় চলে যায়। দেশে আগের সেই শান্তি এখন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে? শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান এখন আর নেই, এত কালের দেখে আসা এলাকার সব শান্তি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! ভেবেছিলাম অবসর নিয়ে দেশে যেয়ে বাপ দাদার ভিটায় বাকী জীবন কাটিয়ে দেবো, কিন্তু তা তো এখন আর সম্ভব হচ্ছে না।
তিন বছর আগে আমার এক ভাইকে তারা রাতে সালিশ বিচার করার নামে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। অনেক খোঁজার পরেও তাকে আর পাওয়া যায়নি। ঐ সংবাদ পেয়ে দেশে গিয়ে যা দেখলাম তা আরো ভয়াবহ। গ্রামে এখন কোন স্বচ্ছল লোকের জন্য বাস করাটাই যেন বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোন নিরাপত্তা নেই, সর্বত্র একটা ভয়ার্ত পরিবেশ। আমার আপন জনেরাই আমার নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে যথাসম্ভব শীঘ্র আমাকে ওখান থেকে চলে আসতে বল্লো। খুঁজে পেতে কষ্ট হয়, ছোট কালে দেখা আমার সেই নিজের গ্রামকে। যেখানে লেখাপড়া করেছি, যেখানে সবার সাথে বেড়ে উঠেছিলাম হেসে খেলে সেটাই যেন আমার জন্য এখন মৃত্যুর উপত্যকা। লোকজনের আমার দিকে তাকিয়ে থাকা দেখলেই আমার ভিতরে ভয় করা শুরু করলো। আমি এক রকম পালিয়ে চলে এলাম আমার প্রিয় মাতৃভূমি থেকে ভয়ে। এতদিন এখানে থাকবো না ভেবেই কোন বাড়ি কিনি নাই, তারপরই সিদ্ধান্ত নিয়ে এখানে বাড়ি কিনেছি এই বছর।
আমার নিজের জন্য না হোক সন্তানদের জন্য তো মাথা গোঁজার ঠাঁই একটা দরকার। সম্পূর্ণ নিরাপত্তার মধ্যে এখানে থেকেও মনে হয় কি যেন নেই? কিসের যেন একটা অভাব বোধ সব সময় মনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়! জীবনের নিরাপত্তা, আর্থিক নিশ্চয়তা সব কিছু পেলেও কিসের যেন একটা অভাব। মনটা হাহুতাশ করে মাঝে মাঝে কিন্তু উপায় কি? তাই তো এখন পরবর্তি প্রজন্মের কথা ভেবেই নিজেকে ছেড়ে দিয়েছি ভবিষৎ এর হাতে। কোন কিছুই যেন আমার আর আপন বলে মনে হয় না, কেমন যেন একটা দূরত্ব থেকেই যায় মনের মধ্যে। পারিপার্শিকতাকে আপন বলে মেনে নিতেও কষ্ট হয়, মনে হয় নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে এখন উদ্বাস্তই হয়ে গেলাম।
আশরাফের কথা শুনে ওর কষ্টের চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকে নির্বাক হয়ে গেলাম, কি বলবো আমি? (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, কেটি, টেক্সাস, ইউএসএ