ইউসুফ কামাল : সেটা বেশ কয়েক বছর আগের কথা সম্ভবত ২০০৪ সালের ডিসেম্বর, আমার প্রথম বার আমেরিকা যাওয়া। কত গল্প শুনেছি মানুষের মুখে – আমেরিকা স্বপ্নের দেশ। যে দিকে তাকানো যায় চোখ জুড়িয়ে যায়, পথে প্রান্তরে নানান রংয়ের ফুলের মেলা। আসলে কি তাই? তখন ভার্জিনিয়ার স্প্রীংফিল্ডে আমার মেয়ে থাকে, তার বাসাতেই উঠলাম। প্রথম বারের আমেরিকা দর্শন, নিজের কাছেও একটু অন্য রকম লাগছিলো। সব কিছুই নতুন আর অচেনা, সেই নতুন চোখ দিয়েই সব কিছু দেখি। আমার চিরদিনই ভোর বেলা উঠে হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস, ভোরে প্রায় ঘন্টা খানেক হাঁটি, এটা না করলে আমার সারা দিনটাই অসস্থিতে কাটে। মেয়ের বাসার সামনের পার্কিংলটসহ প্রশস্ত পাকা জায়গা হাঁটার জন্য খুবই উপযোগী। প্রথম দিনই ভোরে কেডস্ পরে বেরিয়ে পরলাম, মনে মনে ভাবলাম প্রথম দিন তো বেশি দূরে গেলে যদি হারিয়ে যাই, তখন সাথে ফোনও ছিলো না তাই কাছে দিয়েই হাঁটাহাঁটি করলাম।
বাসার সামনে দিয়েই হাঁটছিলাম আর দেখছিলাম কত সুন্দর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন চার দিক। কোথাও কোন ময়লা পলিথিনের টুকরা, সিগারেটের পোড়া অংশ, সিগারেটের খালি প্যাকেট কিম্বা ছেড়া কাগজও নেই। অনভিজ্ঞ দৃষ্টি নিয়ে ভাবলাম এরা কোন গ্রহের মানুষ? বাসার সামনে দিয়ে কয়েক বার হাঁটাহাঁটির সময় দেখলাম আমার মেয়ের পাশের বাসা থেকে এক ভদ্র মহিলা বেরিয়ে এলেন সম্ভবত হাঁটার উদ্দেশ্যে, বুঝলাম তার পায়ের কেডস্ দেখেই। কাছাকাছি হতেই চেহারাটা পরিস্কার দেখতে পেলাম, বয়স ষাটের একটু বেশি হবে।
হাসি দিয়ে জানতে চাইলেন, আমি নতুন নাকি এখানে? আগে তো দেখিনি? বল্লাম মেয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছি, মেয়ে তো আপনার প্রতিবেশী। হেসে বল্লেন, এখানেই থেকে যাবেন নাকি? ধীরে ধীরে আলাপ জমে উঠলো। একটু পরে আমার মেয়ে ও আমার স্ত্রী এসে যোগ দিলেন আমার সাথে। দেখলাম আমার মেয়ের সাথে আগে থেকেই উনার খুব ভালো সম্পর্ক। যথারীতি পরের দিন ভোরে হাঁটতে বের হতেই আবার দেখা হলো, বুঝলাম ভদ্র মহিলা যথেষ্ট স্বাস্থ্য সচেতন। বেশ কয়েকদিন এক সাথে হাঁটার পরে মিসেস বারবারা বেশ সহজ হয়ে এলেন আমার সাথে। কথাচ্ছলে উনি তার নিজের জীবনের কিছু দুঃখের কথা বলে গেলেন দুঃখ ভরা কন্ঠে। মিসেস বারবারার জন্ম নিউজিল্যান্ডের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে, বংশ পরম্পরায় তারা নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী। ওখানেই তার লেখাপড়া এবং বড় হয়ে ওঠা। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে চাকুরীর প্রাক অভিজ্ঞতার জন্য স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এক বছরের জন্য সাহায্য সংস্থা অক্সফামে যোগ দেন। তখন অল্প বয়স, চোখে মুখে অনেক স্বপ্ন তার।
সে সময়ে আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে মাষ্টার্স শেষ করে নিউজিল্যান্ড বেড়াতে যাওয়া আমেরিকান টগবগে যুবক রবার্ট এর সাথে পরিচয় হয় বারবারার। প্রথম দর্শনেই দু’জনে দুজনের প্রেমে পড়ে যান আর পরিণতিতে দু’জনে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। বারবারা বল্লেন, নিউজিল্যান্ড এর মানুষ বেশ রক্ষনশীল ধরনের হয়, তারা সব সময় নিজেদের মধ্যেই থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু সাবালিকা বারবারার অনড় সিদ্ধান্তের কাছে পিতা মাতার পক্ষে রাজী হওয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প ছিলো না, তাই সুষ্ঠ মতোই বিয়েটা হয়ে গেল ওদের। স্বামীর সাথে বারবারা আমেরিকা চলে আসেন আর স্বামীর বদৌলতে আমেরিকার নাগরিক হয়ে এখানেই স্থায়ী হয়ে যান। স্বামী রবার্ট আমেরিকান সরকারের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের এ্যান্টিটেরোরিজম সেক্টরের কর্মকর্তা হিসাবে চাকুরীতে যোগ দিয়ে জীবন শুরু করেন। পাশাপাশি বারবারাও আমেরিকান পোষ্টাল বিভাগের চাকুরীতে যোগ দেন। বছর দুই পরে সংসারে তাদের প্রথম পুত্র সন্তান আসে। এর পরই রবার্ট বারবারাকে নিয়ে মেরিল্যান্ডে এক একর জায়গা বিশিষ্ট বড় একটা বাড়ি কিনে সে খানেই স্থায়ী হয়ে যায়।
সব কিছু ভালোই চলছিল যথারীতি হঠাৎ করেই ওদের বিবাহিত জীবন শেষ হয়ে আসে বিয়ের ত্রিশ বছরের মাথায়। চাকুরীরত অবস্থায় একটা সড়ক দুর্ঘটনায় বারবারার স্বামী রবার্ট মারা যান। তখন ক্ষতিপুরণ বাবদ ডিপার্টমেন্ট থেকে অনেক টাকা পেয়েছিলেন বারবারা। দুঃখ করে বল্লেন, ওদেরকে বলেছিলাম আমার মানুষটাকে পারলে ফিরিয়ে দেন। আমার ভালো মানুষটাই যখন চলে গেলো, টাকা দিয়ে আমি আর কিই বা করবো? নিজে চাকুরী করতেন ওখান থেকে রিটায়ার্ড করার পর ওখান থেকেও মাসে মাসে পেনশন পান। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, লেখাপড়া শেষ করে চাকুরী নিয়ে চলে গেল ক্যালিফোর্নিয়ায়। ওখানেই পরিবারসহ থাকে, বছরে একবার বড় দিনের ছুটিতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে আসে দুই তিন দিনের জন্য, আবার চলে যায়। বল্লেন, ছেলে গত বছর সাত দিনের সমুদ্র ভ্রমণের জন্য ক্রুজারের টিকিট পাঠিয়েছিলো আমার জন্য, ভালোই লেগেছে। সাগর আমাকে বিমুগ্ধ করেছে, ভাবছি আবারো যাবো সময় করে। বারবারা বল্লেন জীবন তো থেমে থাকে না, আমি একা মানুষ অত বড় বাড়ি সামলাবো কেমন করে? বাধ্য হয়ে ঐ বড় বাড়ি বিক্রী করে এই টাউন হাউসের বাড়িটা কিনে নিয়ে এখানে থাকি। এই বাড়ির মেইট্যান্সের কোন ঝামেলা নেই তাই এটাই আমার জন্য ভালো। এখন আমার একমাত্র বিশ্বস্ত সাথী হাউন্ড জিমি। বিশ্বস্ত বন্ধুর মতোই সর্বদা আমার সাথে সাথে থাকে। প্রতি রবিবার গাড়ি চালিয়ে গীর্জায় যাই আর ফিরতি পথে গ্রোসারী কিনে, লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে বাসায় ফিরে আসি। আমার তো কোন সমস্যা নাই, ভালোই আছি। রাতে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাই। এই এখন আমার জীবন। জানতে চাইলাম নিজের দেশে যাননি? বল্লেন বাবা মা নাই তাই বাড়ি যাওয়া হয়ে উঠে নাই, প্রথম দিকে গিয়েছিলাম কয়েকবার। বাবা মা মারা যাওয়ার পর আর যাওয়া হয়নি। মনটা ইদানীং ছুটে যায়। জন্ম হলো নিউজিল্যান্ডে পরে স্থায়ী হলাম স্বামীর দেশ আমেরিকায়।
এখনও বুঝি না, পুরোপুরিভাবে আমার দেশ কোনটা? বাবা মা ঘুমিয়ে আছে আমার আপন দেশ নিউজিল্যান্ডে পরম শান্তিতে, মাঝে মাঝে ভাবি আমি কি করবো? যাকে ভালোবেসে, যার হাত ধরে আমার সব আত্মীয় স্বজন ছেড়ে চলে এসেছিলাম এ দেশে, সেই তো আগে চলে গেছে আমাকে কিছু না বলে। ভালো মানুষটা সকালে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল আর বিকেলে ফিরল নিস্প্রাণ নিথর দেহে। মাঝে মাঝে মনে হয় চলে যাই সেই সবুজ পাহাড় আর উপত্যাকায় ভরা দেশটায়। এখন আমার পিছুটান স্বামীর কবর আর একমাত্র ছেলেটা। সবই তো আমার এখানে এই আমেরিকাতে, আমি চলে গেলে তো ওদের সাথে সহজে দেখা হবে না। এখন এই দু’টাই আমার পিছুটান।
সবুজের গালিচায় আচ্ছাদিত উপত্যকায় ঘেরা ছোট্ট শহরের মায়াবী ঘর বাড়িগুলো যে এখনো আমাকে ডাকে। ওটাই তো আমার নিজের মাতৃভুমি, আমার নিজের দেশ।
(বিঃ দ্রষ্টব্য : মিসেস বারবারার সাথে আমার একটি ছবি ছিলো অনেক খুঁজেও পেলাম না, অনেক দিনের কথা তো হয়তো হারিয়েই গেছে।) (চলবে)
ইউসুফ কামাল : কেটি, টেক্সাস, ইউএসএ