ইউসুফ কামাল : মনের প্রসারতা বা উদারতা মানুষের মনের ভিতর ধীরে ধীরে স্থায়ী স্থান করে নেয় যাকে বলা যেতে পারে মানসিকতার পরিবর্তন। এটার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ, সময় ও উন্নত মানের পরিস্থিতির। এই তিনের উপর নির্ভর করেই মন বিকশিত হয় আর সেই সাথে সংস্কার মুক্ত হীনমন্যতা হীন উন্নত শ্রেণীর নতুন মানুষ গড়ে ওঠে। গতকাল সন্ধ্যায় ছোট্ট পরিসরে কয়েকটা পরিবারের কয়েক জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো আমাদের বাসায়, উপলক্ষ ছিলো আমার নতুন বন্ধু খালিদ সস্ত্রীক চলে যাবেন তার আমেরিকার সর্ব শেষ স্থায়ী নিবাস লসএ্যান্জেলস্ এ। আর সেই উপলক্ষেই সবার সাথে একত্রিত হওয়া। ওখানে খালিদের সাথে তার ছোট ছেলে থাকে তার পরিবার নিয়ে, আর কাছেই অন্য বাসায় থাকে তার একমাত্র মেয়ে পরিবারসহ। বড় ছেলে আমার নেইবার সেটা আগে বলেছি। খালিদসহ আরো কয়েক জন বন্ধু শ্রেণীর মানুষকে পারিবারিকভাবে উপস্থিত হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করা হয়েছিলো। আর ঠিক এভাবেই ঘুরে ফিরে আমরা সবাই এখানে একটা বৃহৎ পরিবারের মতোই থাকি।

সুখ দুঃখে যেন একত্রিত হয়ে পরবাসে ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভাষার মানুষের একটা বিকল্প বৃহৎ পরিবারমন্ডলির সৃষ্টি করা। যেটা বেশ ভালোই লাগে সবার কাছে। এশীয়ানরা মনের দিক থেকে এই অঞ্চলের মানুষের সাথেই মিলে মিশে থাকতে পছন্দ করে তার অন্যতম কারণ সম্ভবত ভাষাগত সাদৃশ্যতা।

তবে সবাই এক রকম না এর আবার ব্যাতিক্রমও আছে, সেটার সংখ্যা খুবই নগন্য। ভারতীয়দের হিন্দী ভাষা আর পাকিস্তানীদের উর্দু ভাষাতে প্রবাসী বাঙালিদের বেশির ভাগই অভ্যস্ত কারণ দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের কারণে। পাশাপাশি ইংরেজিতে অনেকে পারদর্শী হলেও আমেরিকানদের কৃষ্টি ও কালচারের দিক দিয়ে তারা বেশ রক্ষনশীল। হাই হ্যালো ছাড়া তারা এশীয়ানদের সাথে পারিবারিকভাবে আসা-যাওয়া বা অন্তরঙ্গ হয়েছে এটা আমার নজরে পরেছে বলে মনে হয় না। ভারতের হারিয়ানার আশফাকের পরিবারের সাথে আমাদের হিউষ্টনে থাকার সময় থেকেই পারিবারিকভাবে ভালো সম্পর্ক। ছোট দুইটি ছেলে আর হরিয়ানারই মেয়ে তার স্ত্রী দুজনই খুব ভালো মনের মানুষ। অত্যন্ত নরম স্বভাবের এবং অতিথি পরায়ণতাসহ একটি সংবেদনশীল পরিবার ওদের।

হিউষ্টন থেকে প্রায় এক ঘন্টার দূরত্ব কেটিতে আসার পর আরো অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়। ভারতের হায়দারাবাদের শায়াক (বন্ধুরা শাহরুখ বলে ডাকে) আর তার স্ত্রী মরিয়াম পাকিস্তানী, তারা দুজনেই আইটিতে চাকুরী করে। ভারতীয় আর পাকিস্তানি মিলে একটা সুখের সংসার গড়ে তুলেছে দু’জনে, এখানে কিন্তু সুখ শান্তির কোন ব্যাত্যয় ঘটেনি।
তেত্রিশ বছরের টগবগে যুবক শায়াকের প্রিয় খেলা ক্রিকেট, স্থানীয় একটা ক্রিকেট দলের সক্রিয় সদস্য সে। আর ওর স্ত্রী মরিয়ম নিজে অত্যন্ত মিশুক স্বভাবের উপরন্তু খুবই নম্র প্রকৃতির। দুজনই অল্প বয়স্ক ও অত্যন্ত পরিমার্জিত ব্যবহার সম্পন্ন। বাংলাদেশের সিলেটের আব্দুল মঈন বেশ অনেক বছর ধরে এখানে স্থায়ী। সজ্জন ব্যাক্তি আব্দুল মঈন এর পিতা ছিলেন সিএ (চার্টার্ড একাউনটেন্ট)। বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব সাইফুর রহমানের সিএ ফার্ম ‘রহমান এন্ড রহমান’ এর সাথে দীর্ঘদিন জড়িত ছিলেন তিনি।
ঐ প্রতিষ্ঠানেরই পাকিস্তানস্থ কার্যালয়ে তিনি দীর্ঘদিন কার্যরত ছিলেন। পিতার সাথেই ’৭১ এ যুদ্ধের সময় মঈন অনেক বাঙালির সাথে পাকিস্তান থেকে আফগানিস্থান- ভারত হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। সব শেষে মঈনের পিতা অবসর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হিউষ্টনে সপরিবারে স্থায়ী হন এবং বছর দুই আগে এখানেই মারা যান। তার পুত্র আব্দুল মঈন এখন এখানে নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এবং বেশ ভালো আছেন।

খালিদ খান ফিরে যাবেন তার বর্তমান স্থায়ী নিবাস লসএ্যান্জেলস এ। স্ত্রী ও পুত্র নাভিদকে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের বাসায়। দুজনের একান্ত আলাপচারিতার এক পর্যায়ে বল্লাম, আপনার কি সেই স্বপ্নের রাজশাহী যেতে ইচ্ছে করে না? একটু চুপ করে গেলেন হয়তো মনে মনে সেই হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো রোমন্থন করলেন, বড় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বল্লেন, কত স্মৃতি যে আমার বুকের ভিতর, সব কিছু তো বলে প্রকাশ করা যায় না। মনে পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার ক্যাম্পাসের কথা। কত বন্ধু ছিলো আমার ঐ রাজশাহীতে, স্কুল জীবন থেকে কলেজ তারপর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। বেশি চিন্তা করলে চোখ ভিজে আসে, কেমন একটা অস্থিরতা চলে আসে মনের মধ্যে। মনে হয় ছুটে যাই জীবনে শেষ বারের মতো ছুয়ে আসি আমার শিশু কাল থেকে বেড়ে ওঠা মধুময় জীবনের উপাখ্যান গুলি। বল্লাম, আপনার কি যেতে ইচ্ছে করে না আর এক বার ওখানে যেতে? আমার প্রশ্নে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে বল্লো, আমার বাড়িঘর সবই তো সরকার নিয়ে নিয়েছে এখন কি ওরা আমাকে ভিসা দেবে?

বল্লাম, আপনি আমেরিকান পাসপোর্ট নিয়ে ভিসা চাইলে দেবে না কেনো? তবু কেমন যেন একটা সংশয় ভরা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আমার দিকে। খালিদ এর স্ত্রীর সাথে অনেক কথা হলো, উনার পিতার জন্মস্থান হায়দারাবাদ হলেও জীবিকার কারণে কর্মস্থল ছিলো বার্মা। ওখানে দীর্ঘ দিন ছিলেন পরিবারের সাথে, ওখান থেকে ’৭১ এ করাচী চলে আসেন। তার পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন খালিদ খানের সাথে। পরবর্তিতে স্বামীর সাথে লস এ্যান্জেলস এ স্থায়ী হয়ে যান। স্বামীর সাথে দুই মাসের জন্য কেটি’তে বেড়াতে এসেছিলেন বড় ছেলের বাসায়, আবার চলে যাবেন সামনের মাসে। মন খারাপ করে বল্লেন, আমার নিজের জীবনেও শুধু এক জায়গা থেকে আরেক নতুন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে এখন মনে হয় জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি।

প্রায়ই মনে হয় এই যাযাবর জীবনের পরিসমাপ্তি না জানি কি ভাবে হয়! তারপরও ভাবি মনটা ক্লান্ত হয়ে পড়লেও নতুনত্বের একটা স্বাদ তো আছেই, এতে সাময়িকভাবে হলেও মনটা কিছুটা হলেও তো প্রফুল্লতা খুঁজে পায়। বল্লেন, মনে হয় নানা ভাষার মানুষের সাথে সবাই মিলে মিশে যেন একটা নতুন পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছি আমরা। তখন আবার ভালোই লাগে। (চলবে)

ইউসুফ কামাল : লেখক, কেটি, টেক্সাস, ইউএসএ