ইউসুফ কামাল : বন্ধুত্ব কখনো পুরোন হয় না। বন্ধুত্ব সেটাই, যেটা বছরের পর বছর দেখা না হলে কিছুটা বিবর্ণ হয়, কিন্তু স্মৃতির পাতা থেকে মুছে যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অবসর সময়ে কত দিন কত রাত নীলক্ষেতের রাস্তা দিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি আমরা, সব শেষে দিনের শেষ পর্বের আসরটা নীলক্ষেতের বিউটি রেষ্টুরেন্টের চা দিয়ে শেষ করতাম। মানুষের পদচারণা শেষ হয়ে আসতো রিক্সার টুং টাং শব্দ কমে আসতো, দোকানের সামনের কুকুরগুলো সারাদিন খাদ্যন্বেষণে ঘুরে ঘুরে পরিশ্রান্ত হয়ে শেষে কুন্ডুলী পাকিয়ে শুয়ে থাকতো ফুটপাতের কোণায়।

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে চার পাঁচজন হেঁটে হেঁটে নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি পার হয়ে মতিন টেক্সটাইল এর সামনে দাঁড়াতাম। লিটন চলে যেতো ওর এফ রহমান হলের রুমে (অস্থায়ী ভিত্তিতে ছাত্রদের বাসস্থান সংকুলানের জন্য ইটের দেওয়াল আর উপরে টিন শেড দিয়ে অনেকগুলো কক্ষ তৈরী করা হয়েছিলো, ছাত্ররা তৎকালীন ভিসি স্যারের নামে এটাকে “মতিন টেক্সটাইল” এই নামে নামকরণ করছিলো)। একটু সামনে এগিয়ে জহুরুল হক হল সামনে এলে ডানের রাস্তা ধরে আলম চলে যেতো জহুরুল হক হলে, আর সেকান্দার আলমের পিছু পিছু সোজা জহুরুল হক হলের ভবন পার হয়ে রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে বাম দিকে সলিমুল্লাহ্ হলের পিছনের গেট দিয়ে চলে যেতো ওর হলে। আর সব শেষে বাকী থাকতাম আমি আর বিদ্যুৎ। শেষে আমার কমন ডায়লগ ছিলো, চলো আমার বাসায় যাই। এত রাতে বাসাবো যাওয়ার চেয়ে আমার ওখানে থাকাই ভালো, সকালে তো আবার ক্লাসে আসতেই হবে। ঘড়ির কাটা প্রায়ই এগারোর ঘর ছুঁই ছুঁই করতো, আমরা দুইজন রিক্সা নিয়ে বাসায় চলে আসতাম।

পরদিন সকালে মেডিকেল কলেজ হোষ্টেলের সামনের পপুলার এ ব্রেকফাষ্ট সেরে দু’জনে চলে যেতাম ডিপার্টমেন্টে সকাল ৮:৩০ এর ক্লাস করতে। সেই বন্ধুত্বের অমলিন সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় চলে এসেছি কানাডার টরেন্টোতে, ১০ মেসির সুউচ্চ ভবনের সাত তলায় ওর বাসায়। সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে রাতে শুরু হতো আমার আর বিদ্যুৎ এর ম্যারাথন গল্প, কখন যে শেষ হবে তার কোন ধরা বাঁধা সময় ছিলো না। রাতে শোবার পর প্রথম রাতে শুনলাম বাঁশীর মতো একটা তীক্ষ্ণ শব্দ, উঠানামা ছন্দে ভেসে আসছে জানালার দিক থেকে। বুঝলাম বাইরে বাতাসের প্রচন্ড চাপ, সম্ভবত জানালার কোন ছিদ্র দিয়ে বাতাস ঢুকার কারণে শব্দ হচ্ছে। এমনিতে সাত তলা তার উপর চার পাশটা ফাঁকা সম্ভবত তাই বাতাসের চাপটা বড় ভবনে বেশি লাগছে। বল্লাম, ভালোই তো বিনামূল্যে হরি প্রাসাদ চৌরাসিয়ার বৈরভী রাগের বাঁশী শোনা যাচ্ছে। বিদ্যুৎ হেসে বল্লো, বিনামূল্যে চৌরাসিয়ার বাঁশী কি বলো? ভালো কথা বলেছে তো! আর আমি এই বাঁশীর শব্দ শোনার জন্যই ছিদ্রটা বন্ধ করি নাই, ভালোই লাগে। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে, বরং ঐ শব্দ না শুনলেই যেন সহজে ঘুম আসতে চায় না। ছোট ছোট ঘটনাবলী মাঝে মাঝেই মনে ভীড় করে, মনকে সাময়িক ক্ষণের জন্য হলেও ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই ফেলে আসা দিনগুলোতে। কেমন যেন একটা নস্টালজিয়ায় পেয়ে বসলো আমাকে, মনে হলো দুইজন শুয়ে আছি আমার ঢাকার বকশিবাজারের ৩৯/১ উমেশ দত্ত রোডের বাসার দুই তলার বাম দিকের সেই রুমে। ছাত্র জীবনের পুরো সময়টা আমার এখানেই কেটে গিয়েছে। অনেক বন্ধু হলে সিট পাচ্ছে না, হলে গোন্ডগোল সোজা চলে এসেছে আমার রুমে তাও বিদ্যুৎ এর তদ্বিরে। এমনি কতো হাজারো স্মৃতি বিজড়িত সেই ৩৯/১ উমেশ দত্ত রোড়ের পনেরো বাই বিশ ফুটের রুমটা।

এদের অনেকেই হারিয়ে গেছে পৃথিবী ছেড়ে আবার অনেকে দূরে সরে গেছে প্রতিকুল পরিস্থিতির কারণে। হয়তো আমৃত্যু থেকে যাবে এ রুমের হাজারো স্মৃতি আমার মনের গহিনে, অপ্রকাশিত পান্ডুলিপির মতো কেউ মনে রাখবে আবার কেউবা ভুলে যাবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে আমার জহুরুল হক হলে থাকারই কথা ছিলো কিন্তু বাসাতেই থাকতাম, হল জীবনের হৈচৈ আমার কখনই পছন্দ ছিলো না। নিরিবিলি থাকতেই পছন্দ করতাম কিন্তু নিরিবিলি আর থাকা হতো না, প্রায় রাতেই আমার বন্ধুদের মধ্য কেউ না কেউ এসে হাজির হতো। সেই জন্যেই রাতের অতিথিদের জন্য অতিরিক্ত তোষক বালিশের ব্যবস্থা সব সময়ই প্রস্তুত করে রাখতে হতো। পরদিন সকালে পূর্বের ঠিক করা প্রোগ্রাম মতো আমরা চলে গেলাম নায়াগ্রা ফল দেখতে। বিদ্যুৎ এর বন্ধু মনিসের গাড়িতে সবাই মিলে হৈচৈ করতে করতে চলে গেলাম নায়াগ্রা ফল দেখতে। দক্ষ চালক মনিসের কল্যাণে মনে হয় একটু আগেই সকাল সকাল পৌঁছে গেলাম সবাই। তখনও লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়নি, মোটামুটি শুনশান এলাকা দু’একটা সীগ্যাল সকালের খাবারের সন্ধানে এসে হাজির হয়েছে। সেই সেন্ট মার্টিনে যাওয়ার সময় প্রথম সীগ্যালকে আমাদের জাহাজ অনুসরন করতে দেখেছিলাম আর এই নায়াগ্রায় আরেকবার খাবারের সন্ধানে আমাদেরকে অনুসরন করতে দেখলাম। আমেরিকা ও কানাডার দুই প্রান্ত থেকেই নায়াগ্রার সৌন্দর্য অবলোকন করার বিশেষ সুবিধা আছে। ভ্রমণ মানুষের চিরাচরিত এক ধরনের নেশা, সেই ভ্রমণের মধ্যে যদি থাকে কোন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যময় স্থান তাহলে তো কথাই নেই, তখন সবাই যেন প্রায় কবি হয়ে যায়। তিনটি পাশাপাশি অবস্থিত ভিন্ন জলপ্রপাত নিয়ে নায়াগ্রা জলপ্রপাত গঠিত। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় হর্সশু কানাডা ও আমেরিকার সীমান্তে নিউইয়র্ক ষ্টেটের সীমান্তে অবস্থিত। কানাডার টরেন্টো থেকে ৪৩ মাইল দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত নায়াগ্রার হর্সশু ফলস্রে উপর দিয়ে প্রবাহিত জলের ধারা সর্বোচ্চ প্রতি সেকেন্ডে ৬৪০০ মিটার, আর সেখান থেকে সেন্ট লরেন্স নদী হয়ে পর্যায়ক্রমে আটলান্টিক সাগরে যেয়ে মিশে যায়।

আন্তর্জাতিক চুক্তির কারণে নায়াগ্রার জলের প্রবাহের ধারা দিনের থেকে রাতে কমানো হয়, আর সেটা করা হয় পার্শ্ববর্তী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যে। নায়াগ্রার জলপ্রপাতের চারিদিকে ছড়িয়ে আছে এক অসাধারণ মায়াময় এক সৌন্দর্য্য। দূরের সমতল ভ‚মি থেকে ছুটে আসা অজস্র জলরাশি আছড়ে পড়ছে প্রায় একশ’ষাট ফুট নীচের গভীর খাদে। জলধারার সৌন্দর্য্য এত মনোমুগ্ধকর যা কল্পনার বাইরে, আর তাই তো সমগ্র পৃথিবীর ভ্রমণপিয়াসী মানুষের মিলন স্থল এই নায়াগ্রা জলপ্রপাত। (চলবে)

ইউসুফ কামাল : লেখক, ডেলসিটি, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ,