ইউসুফ কামাল : বারবারার সাথে জোসেফের সংসার জীবন ছিলো মোটামুটি বাইশ বছরের মতো। বিবাহিত জীবনের পুরো সময়টা জুড়ে দুইজনের মধ্যে ছিলো সুন্দর পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভালো একটা সম্পর্ক। বড় বিষয় হোক কিম্বা ছোটখাটো বিষয় হোক, সব বিষয়েই দুই জন নিজেদের মধ্যে খোলামেলা আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতো। বারবারা বল্লো, ঐ বাইশ বছরের মধ্যে একটি বারের জন্যও উত্তপ্ত কথা বিনিময় হয়নি আমাদের দু’জনের মধ্যে। দ্বিধাহীনভাবে বলবো, জোসেফ আমাকে অনেক ভালোবাসতো। যুদ্ধে গুরুতর আহত হওয়ার পর জোসেফকে চাকুরীর সমস্ত সুযোগ সুবিধা দিয়ে রিটায়ারমেন্টে পাঠিয়ে দেয় সরকার। তার আগে পূর্ণ চিকিৎসা সম্পন্ন করে জোসেফকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা হয়। দুইজনের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রবিবার হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ওরা রবিবার গীর্জায় বিয়ের কাজটা শেষ করে স্বামীস্ত্রী হিসাবে সারা জীবন একসঙ্গে থাকার অংগীকার করে জোসেফের মেরিল্যন্ডের বাড়ীতে যেয়ে ওঠে।
দুই বছরের মাথায় বারবারা জোসেফের সন্তানের মা হয়ে সংসারটাকে আলোকিত করে তোলে। দুজনের সম্পর্কটা এত গভীর ছিলো যে, সন্তানের দেখভালের বিষয়টা নিয়ে দু’জন একটা যৌথ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলো। একজনকে তো চাকরী করতে হবে তাই বারবারা’র অফিস চলাকালীন সময়টা জোসেফ বাসায় থেকে সন্তানের দেখা শোনা করবে।
জোসেফেরও সন্তানের সাহচর্য্যে সময়টা ভালোভাবেই কাটিয়ে দিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলো। কোন অভিযোগও ছিলো না উপরন্তু বাসায় থাকার জন্যে সে নিজের শরীরের প্রতি বেশ যতœবান হয়ে উঠেছিলো। এতে বারবারা নিজেও চাকুরীতে ভালোভাবে মনোনিবেশ করতে পেরেছিলো। এলিমেন্টালী লেভেল পর্যন্তই বাচ্চাদের সব কিছু হাতে ধরে করিয়ে দিতে হয়, হায়ার গ্রেডে ওঠার পর এতটা লেগে থাকতে হয় না।
তখন বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়া আসার প্রস্তুতিতে ওরা নিজেরাই নিজেদেরকে গুছিয়ে নিতে পারে, বারবারা’র সন্তানের বেলাতেও তাই হয়েছিলো। মাঝে মধ্যে কিছু রান্নার কাজ চালিয়ে নেওয়ার কারণে বারবারা জোসেফের উপর প্রচন্ডভাবে খুশী ছিলো। জোসেফ চাইছিলো বারবারা নির্বিঘেœ অফিসের কাজে মনোনিবেশ করুক। সেনাবাহিনীর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে বের হয়ে আসার সময়েই সেনা কর্তৃপক্ষ জোসেফের কৃত্তিম পা সংযোজনের কাজটা করে দিয়েছিলো।
এতে মোটামুটি তেমন আর কোন সমস্যাও হয়নি জোসেফের। বাসার বাইরে জোসেফের তেমন কোন কাজও ছিলো না, যা ছিলো সেগুলো বারবারা’ই করে দিতো।
এলিমেন্টারীতে পড়ার সময় সন্তানের স্কুলে আনা নেওয়ার কাজটা জোসেফের বাসার বাইরে যেয়ে করতে হতো না, বাসার পাশেই স্কুলের বাস ষ্টপেজ। স্কুলের জন্য ছেলেকে রেডী করে পাঠিয়ে ও বাসার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকতো যতক্ষণ বাস ছেড়ে না যায়। আবার স্কুল ছুটির সময় দরোজা খুলে অপেক্ষা করতো স্কুল বাসের আসা পর্যন্ত। বারবারা বল্লো, জোসেফ বাসায় থাকতে থাকতে মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠতো, তাই সপ্তাহান্তে বাসার গ্রোসারী কেনার সময় ও অনেক সময় বিকেলের দিকে জোসেফ কে নিয়ে গাড়ী চালিয়ে বাইরে বেরোতাম। বাইরে আসলে ওর মেজাজটা বেশ ফুর ফুরে হয়ে যেতো। কিছু দিন পর পর বাইরে ঘুরতে চাইতো তখন বুঝতাম জোসেফের ভিতরে খুব অসাহায়ত্ব ও অস্থিরতা কাজ করছে।
শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও জোসেফ ভিতরে ভিতরে মানসিকভাবে দুর্বল হতে শুরু করে, বারবারা বুঝতে পারলেও তার পক্ষে যতটুকু সাপোর্ট দেওয়া সম্ভব তা সে করতো। যে মানুষটা ঘন্টার পর ঘন্টা নিজে গাড়ী চালিয়ে বেড়াতো, তার বর্তমানের এই অসমর্থতাকে সে সহজে মানিয়ে নিতে পারতো না। স্বাধীনচেতা মানুষটা নিজের এই অক্ষমতাকে সহজে মানিয়ে নিতে না পেরে ভিতরে গুমরে গুমরে কাঁদতো। এক ভাবে উদাস দৃষ্টিতে শূন্যের পানে তাকিয়ে থাকতো, হয়তো নিয়তির লিখনকে কোনভাবেই মেলাতে পারতো না। অনেক সময় রাতে ঘুম না আসলে বারবারা’র হাত ধরে বারান্দার চেয়ারে দু’জন বসে থাকতো ঘন্টার পর ঘন্টা। রাতের নিরবতার মাঝে ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা জোসেফের প্রিয় বিএমডবিøউ গাড়ীটা দেখে মনে হতো গাড়ীটা যেন জোসেফকে ডাকছে। আর তখনই জোসেফের বুকের ভিতরের হাহাকারের শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পেতো বারবারা, জোসেফের কাঁধে মাথা রেখে সান্তনা দিত। কিন্তু জোসেফের মনের ভিতরের ঝড় তখনও কোন মতেই থামতো না। অন্যের উপর নির্ভরশীলতা সে কখনোই পছন্দ করতো না। ভাগ্যের কি পরিহাস এমন একটা সতেজ মানুষ নিছক একটা দুর্ঘটনার পর ধীরে ধীরে কেমন হয়ে গেলো। পরের দিকে ঘরের মধ্যে হেঁটে চলে বেড়াতো কিন্তু মনে হতো একটা নিস্প্রাণ প্রাণী যেন নিতান্ত বাধ্য হয়েই চলাফেরা করছে। সমস্যাটা আরো প্রকট হলো ওদের সন্তান আইটি’র চাকরী নিয়ে নিউজার্সী চলে যাবার পর, সংসারটা আরো শুনশান নিরব হয়ে গেলো। কয়েকটা বছর এমনি করে যাওয়ার পর বারবারা চিন্তা করলো এখন ওর আর চাকরী করার দরকার নাই, না হলে জোসেফকে নিয়ে আরো সমস্যা হবে। মায়ের চেয়েও বাবার সাথে সন্তানের সম্পর্কটা খুবই গভীর ছিলো, আর সেটার ভিত গড়ে উঠেছিলো সেই ছেলেবেলার দিনগুলো থেকে। ছেলেও বাবার মতোই স্বাধীনচেতা ও স্বল্পভাষী। নিউজার্সী চলে যাবার পর কয়েকমাস প্রায় প্রতিদিন বাবা সন্তানের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ টেলিফোনে লম্বা কথা হতো। চাকুরী সংক্রান্ত, ওরা ব্যক্তিগত কিছু বিষয়েও অনেক কিছু শেয়ার করতো দু’জনে।
এক সময় সেই লম্বা কথাও ধীরে ধীরে কমে গেলো সন্তানের চাকুরীতে কাজের চাপ বাড়ার সাথে সাথে। আর সেই সাথে জোসেফের কথাবার্তাও কমে আসলো, খুব বেশী দরকার না হলে বারবারা’র সাথেও কথা বলতো না। কেমন যেন মন মরা হয়ে থাকতো। সেদিনের মতো বারবারা’র বাসা থেকে বের হয়ে আসার সময় আমাকে একটু বসতে বলে ঘরের ভিতরে গেলো, ফিরে এলো দুইটা প্যাকেট হাতে নিয়ে। আমাকে দিয়ে বল্লো, জোসেফের পক্ষ থেকে ভালোবাসার ছোট কিছু উপহার। আমি জানি জোসেফ আজ বেঁচে থাকলে আমার মতো তোমাকেও সে অনেক পছন্দ করতো। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, ডেলসিটি, ভার্জিনিয়া