ইউসুফ কামাল : পাক-ভারত দেশ বিভাগের সময় মাত্র দুই বছর বয়সে পিতা মাতার সাথে ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে পুরো পরিবারসহ খালিদ খান পূর্ব পাকিস্তানের পার্বতীপুরে চলে আসেন। পার্বতিপুর তখন উত্তর বংগের মধ্যে রেলের শহর হিসাবে পরিচিত ছিলো। খালেদ খানের পিতা আব্দুল মজিদ খান রেলওয়েতে চাকরি নিয়ে পার্বতীপুর, সৈয়দপুর, খুলনা, রাজবাড়ী, আমনুরাসহ বিভিন্ন স্থানে চাকুরী করেন। পরিবারকে রাজশাহী শহরের সেরিকালচারের পাশে স্থায়ী বাড়ি তৈরী করে ওখানে স্থায়ী করে দেন। খালিদ খান তার বুদ্ধি হবার পর থেকে জানতো এটাই তাদের নিজের বাড়ি। খালিদ খান স্কুলের জীবন শেষ করে ভর্তি হন রাজশাহী সরকারি কলেজে। ওখান থেকে ভালোভাবে কলেজের পাঠ শেষ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে মাষ্টারস্ ডিগ্রী নেন। পরিবারের ইচ্ছা মতো চাকুরীতে না ঢুকে বড় চাচার সাথে রাজশাহীতেই ব্যাবসা শুরু করেন। এর এক বছর পার না হতেই দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়।
অল্প সংখ্যক অবাঙালি শুরুতেই অতিউৎসাহী হয়ে বাঙালিদের উপর অত্যাচার শুরু করে দেয় ফলশ্রুতিতে ধীরে ধীরে বাঙালি অবাঙালিদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হানাহানি শুরু হয়ে যায়। আর এর মাত্র কয়েকদিন পর বাঙালিরা খালিদ খানদের বাড়ি ঘর আক্রমণ করে। মূলত তারা কোন কিছুর মধ্যে না থাকলেও শুধুমাত্র অবাঙালি হবার কারণেই ওরা বাঙালিদের টার্গেটে পরিণত হয়। আর এর পর থেকে সর্বত্রই পাল্টাপাল্টি আক্রমণ চলতে থাকে, পরিবারের বয়স্ক সদস্যরা সম্ভাব্য আরো অনাকাংখিত আক্রমণের আশংকা করে যুবকদেরকে ওখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করে। তার ফলে, ’৭১ এর মার্চ মাসের ৩০ তারিখে খালিদ খানের সাথে ওর বোন ও বড় ভাইয়ের পরিবারসহ মোট ৭ জনকে বাবা মজিদ খান বিমানে করে এক আত্মীয় কাছে করাচী পাঠিয়ে দেন। কথা ছিলো অবস্থার উন্নতি হলে কিছুদিনের মধ্যেই আবার ফিরে আসবে রাজশাহীতে। কিন্তু নভেম্বর মাসের শুরুতে মোটামুটি সবাই বুঝতে পারলেন আর দেশে ফেরা হবে না। দেশে পিতামাতাসহ পরিবারের বাকি সবাই তখন নিকটস্থ ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে দেশ স্বাধীনের পর আন্তর্জাতিক রেড ক্রস পরিচালিত ক্যাম্প নাটোরে তাদেরকে স্থানান্তর করা হয়। ক্যাম্পে থাকা অবস্থায় খালিদ খানের অসুস্থ মা মারা যান।
ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া অবাঙালিদেরকে আন্তর্জাতিক রেড ক্রস (আইআরসি) পূর্ণ নিরপত্তার সাথে তাদের মধ্য থেকে যারা পাকিস্তান যেতে ইচ্ছুক তাদেরকে সমুদ্র পথে জাহাজে করে করাচী পাঠিয়ে দেয়। প্রায় একই সময় হায়দারাবাদ থেকে করাচীতে পুনর্বাসিত হন এক মুসলিম পরিবার, তারাও খালিদ খানদের প্রতিবেশী হিসাবে একই এলাকায় স্থায়ী হন। খালিদ খান তখন সবে করাচীতে এক প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকুরী শুরু করেছেন। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই হায়দারাবাদের ঐ মুসলিম পরিবারের কন্যা উম্মে কুলসুমের সাথে খালিদ খানের বিয়ের প্রস্তাব আসে, তারপর আলাপ আলোচনার পর পরিবারের সবার সম্মতিতেই খালিদের বিবাহ সম্পন্ন হয়।
জীবনে স্থায়ীত্ব হওয়ার ভাগ্য সবার মতো খালিদেরও হলো না, জন্ম ভারতের উত্তর প্রদেশ, কৈশোর থেকে যৌবন রাজশাহীতে আর সেখান থেকে করাচী তারপর সর্বশেষ আমেরিকার লস এন্জেলস্। খালিদ হেসে বল্লেন, আমি তো সব সময় রাজশাহীকেই আমার নিজের বাড়ি বলে মনে করি। ও খানে থাকতেই আমি পিতার হাত ধরে হাঁটতে শিখেছি। প্রাইমারী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। খালিদ খানের স্ত্রী উম্মে কুলসুমের বড় ভাই দীর্ঘদিন আমেরিকার নাগরিক হিসাবে লস এ্যান্জেলস এর স্থায়ী বাসিন্দা। বোনের জন্য তার স্পন্সরশীপের কাগজপত্র ঠিক হতে আট বছর লেগে গেলো। পরিশেষে আট বছরের মাথায় খালিদ খান স্ত্রী পুত্র কন্যাসহ চলে আসেন লসএন্জেলস্ এ।
জীবনের প্রায় ত্রিশটা বছরের বেশি লস এন্জেলস্ এ কাটিয়ে দিলেন খালিদ। এর মধ্যে ছেলেমেয়েরাও বড় হয়ে গেলো, লেখাপড়া শেষ করে সবাই এক এক করে চাকরিতে ঢুকে গেলো। সবাই প্রতিষ্ঠিতও হয়ে গেলো। ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেওয়ায় সংসার আরো বড়ো হলো। খালিদ খানের বড় ছেলে আইটির চাকুরী নিয়ে চলে এলো হিউষ্টনে, আমার নেইবার হয়ে। আর এ খানেই আমার সাথে উনার পরিচয় ও বন্ধুত্ব। জীবনের ছোট ছোট আনন্দ বেদনার ঘটনা আমাকে শেয়ার করেন। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে খালিদ খান বল্লেন, ভাই পৃথিবীর উন্নত দেশে থেকেও আমি এখনো সেই রাজশাহীকে কখনো ভুলতে পারিনি। রাজশাহী কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিকে তো মোটেই ভুলতে পারি না।
তখন রাজশাহীতে ঘোড়া গাড়ির চল ছিলো। ঐ বয়সেই বন্ধুদের নিয়ে হৈ চৈ করে কত যে ঘুরে বেড়িয়েছি সেই ঘোড়ার গাড়িতে করে তার হিসেব নেই। একটু দূরে ছিলো সেই উন্মত্ত পদ্মা নদী আর সেই পদ্মার ইলিশ মাছের স্বাদ যেন এখনো আমাকে টেনে নিয়ে যেতে চায় আমার ফেলে আসা বাল্য স্মৃতি বিজড়িত ঐ শহরে। কিন্তু এটা বুঝি, সেটা আর কখনই সম্ভব না। ইচ্ছে থাকলে কি সব কিছু করা সম্ভব? স্মৃতি বয়ে নিয়ে বেড়ানোর নামই কি তাহলে জীবন? জীবনের খেড়ো খাতা খুলে বসে চিন্তা করলে এখন মনে হয়, জীবনটাই তো এক যাযাবর এর জীবন যাত্রা, আজ এখানে কাল ওখানে করতে করতেই একদিন হারিয়ে যাবো আমার পূর্ব পুরুষদের মতো, এই নশ্বর পৃথিবী থেকে। কে কোথায় আছে আমরা কতজন তাদের হিসেব রাখি। আমরা কতজনই বা পিছন ফিরে তাকাই? কেউ বাঙালি কেউ পাকিস্তানী কেউ ভারতীয় কেউ জর্ডানি কেউ আলজিরিয়ান কেউ সিরিয়ান সবাই আমরা এই গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা। সবাই আমরা যাযাবর বৈ কিছু তো নয়!
এখানে আমার স্থায়ী ঠিকানাই বা কোথায়?
ইউসুফ কামাল : লেখক, কেটি, হিউষ্টন, ইউএসএ