Home কলাম নীরব নায়কেরা

নীরব নায়কেরা

ফরিদ আহমেদ : বাংলাদেশের মানচিত্রটাকে যদি খেয়াল করেন, দেখবেন দু’টো প্রধান নদী যমুনা আর পদ্মা এটাকে তিনটে আলাদা টুকরোয় পরিণত করেছে। যমুনা উত্তরবঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করেছে, আর পদ্মা দক্ষিণ বঙ্গকে। দক্ষিণ বঙ্গের কোনো জেলা থেকে সরাসরি সড়কপথে ঢাকা আসার কোনো উপায় নেই। মাঝে আপনাকে লঞ্চ কিংবা ফেরি ব্যবহার করতেই হবে। একই কথা প্রযোজ্য ছিলো উত্তর বঙ্গের ক্ষেত্রেও। সেখান থেকেও সড়কপথে সরাসরি ঢাকাতে আসা যেতো না। নদী অতিক্রম করতে হতো অন্য কোনো উপায়ে।

১৯৯৮ সালে যমুনা সেতু তৈরি করে উত্তর বঙ্গকে সংযুক্ত করা হয়। উত্তর বঙ্গের মানুষের দীর্ঘদিনের দুর্দশার অবসান ঘটে। বগুড়া, রংপুর কিংবা দিনাজপুর থেকে সরাসরি ঢাকায় চলে আসতে পারে তারা দ্রুতগতিতে। দক্ষিণ বঙ্গকে সংযুক্ত করতে সময় লেগে যায় আরো চব্বিশ বছর। পদ্মার সেতু করার মাধ্যমে এখন সেটা সড়কপথে যুক্ত হয়ে গিয়েছে দেশের মুল অংশ ঢাকা অঞ্চলের সাথে।

পদ্মা সেতু নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল অর্জন। এই সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণ বঙ্গের একুশটা জেলা সংযুক্ত হয়ে গিয়েছে দেশের মধ্য অঞ্চলের সাথে। এই সংযুক্তি অনাগত দিনে এক নতুন অর্থনীতির সূচনা করবে। এই বিপুল সম্ভাবনা এবং বিশাল কর্মযজ্ঞের কারণে পদ্মা সেতুকে নিয়ে মানুষের আবেগটা ছিলো চরম পর্যায়ে। প্রমত্তার পদ্মার উপরে সেতু করা যেতে সেই ভাবনা এবং সাহস দীর্ঘদিন বাংলাদেশের করতে পারে নাই। স্বপ্ন ছিলো, কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নের সামর্থ্য আর সাহস ছিলো না। পদ্মা সেতু যখন বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে, তখন আর আবেগের বাধ মানেনি। দেশের মানুষ তীব্র আবেগপ্রবন হয়ে পড়েছে। সেই আবেগের কারণে অনেক উদ্ভট ঘটনা ঘটেছে সেতু উদ্বোধনের পর থেকে।
এর মধ্যে একটা ছিলো পদ্মা সেতুতে কে প্রথম কোন কাজ করলো, সেটা নিয়ে গর্ব করা। এই গর্বকে উসকে দিয়েছিলো মিডিয়াও। তারা ধারাবাহিকভাবে কে প্রথম পদ্মা সেতুতে বমি করলো, কে প্রথম জল বিয়োগ করলো, কোন নারী প্রথম বাইক নিয়ে সেতুতে গেলো, কে প্রথম নাচলো সেতুর উপরে, কে সেতু নিয়ে প্রথম গান গাইলো, কোন গাড়ির ধাক্কায় প্রথম টোলের ব্যারিয়ার ভাঙলো, তার নিয়মিত খতিয়ান দেওয়া শুরু করে। মিডিয়ার কারণেই হোক কিংবা সামাজিক মাধ্যমে প্রচারের কারণেই হোক, মানুষের মধ্যে এই সেতুতে নানা কাজে প্রথম হবার একটা তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।

এই প্রথম কাজগুলোর মধ্যে এক ভদ্রলোক এমন একটা কাজ করেছেন, যেটা আর কেউ করেনি। ইনি পদ্মা সেতুর পুরোটা হেঁটে পাড়ি দিয়েছেন। পদ্মা সেতু দৈর্ঘ্যে ছয় কিলোমিটারের বেশি। কাজেই, কাজটা সহজ কোনো কাজ নয়। এই কঠিন কাজটা অবশ্য তিনি প্রথম হিসাবে পত্রিকার পাতায় নাম লেখাবার জন্য করেন নাই, করেছেন বাধ্য হয়ে।

যাঁর কথা বলছি, তাঁর নাম হচ্ছে এমদাদুল হক। পেশায় তিনি একজন রাজমিস্ত্রি। থাকেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়াতে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সময়ে তিনি ছিলেন শিবচরে। সেই সময়ে খবর পান যে তাঁর কন্যা সন্তানটা অসুস্থ। ভর্তি করা হয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দুইদিন পরে বাচ্চাটার অপারেশন হবে। সব রিপোর্ট নিয়ে তাঁকে হাসপাতালে যেতে হবে। ফলে, তিনি তড়িঘড়ি করে রওনা দেন সেখান থেকে। শুনেছিলেন পদ্মা ব্রিজের কাছে এলে গাড়ি পাবেন। কিন্তু, তাঁর সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। কোনো গাড়িতেই তিনি জায়গা পাননি। গাড়ি না পেয়ে সেতু ধরে হাঁটা শুরু করেন তিনি। সেতু পার হয়ে ওই পারে গেলে ঢাকায় যাবার কোনো গাড়ি পাবেন, সেই আশাতেই সেতু ধরে হাঁটা শুরু করেন তিনি। ওই পার থেকে গাড়ি ধরে ঢাকায় যাবেন। তারপর সেখান থেকে ময়মনসিংহ। যেখানে তাঁর আদরের মেয়েটা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে শুয়ে আছে। প্রতীক্ষা করছে কখন বাবা আসবে।

কেন হেঁটে পার হলেন, সাংবাদিকরা এমন প্রশ্ন করাতে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মেয়েটা অসুস্থ। হাসপাতালে আছে। এপারে কাজের জন্য আসছিলাম। কিন্তু মেয়ের কথা শুনে আর থাকতে পারছি না। বউ ছাড়া কেউ নেই ওকে দেখার। তাই সকালে রওয়ানা হওয়ার পর দেখলাম কোনো বাসে নিচ্ছে না। তাই হাঁটা শুরু করলাম। যতক্ষণ লাগে হাঁটতেই থাকবো।’ এই এমদাদুল হকরা হচ্ছেন আমাদের আনসাং হিরো বা নীরব নায়ক। এঁরা অনেক কিছুতেই রেকর্ড করে ফেলেন, কিন্তু সেটা রেকর্ড করার জন্য করেন না। করেন জীবনের প্রয়োজনে, প্রিয় মানুষের প্রতি ভালবাসায়। আয়েস করে যারা রেকর্ড করতে যায় এখানে সেখানে, তারা যায় মুলতঃ নিজেদের প্রয়োজনে, নিজেদের প্রচার করার তাগিদে। ফলে, অশ্লীল ধরনের নর্তন-কুর্দনই সেখানে দেখা যায় বেশি। আর, এই মানুষগুলো নিঃশব্দে পাড়ি দেন পাহাড় পর্বত, নদী-নালা আর সাগর। এই পাড়ি দেবার কাজটা তাঁরা করেন সকলের নজর এড়িয়ে, বুকের মধ্যে প্রিয়জনের প্রতি সুগভীর ভালবাসা নিয়ে।

Exit mobile version