হিমাদ্রি রয় : নবম শ্রেণীতে বাংলা পড়াতেন বিজ্ঞানের স্যার। শিক্ষকের অভাবে মফস্বলের স্কুলগুলোতে এরকম স্যারেরা প্রক্সি দিয়েই থাকেন। যাক গল্পটা অন্য জায়গায়। স্যারের কাছে আমরা যারা আর্টস-এর ছাত্র ছিলাম তারা অনেকটাই বাগানের ডান্ডিলাইন মানে আগাছার মতো। আমাদের প্রতি সম্ভাষণে বিজ্ঞানের স্যারদের দরদ দেখতাম না। অবশ্য সব বিজ্ঞানের স্যার একই মানসিকতা রাখেন এই দাবি করছি না।

একে আর্টস তার উপর সিলেবাসে অমনোযোগী, ক্লাস জুড়ে দুরন্তপনা, হোমওয়ার্ক এ ফাঁকিবাজি অতঃপর স্যারের প্রহারেন ধনঞ্জয়, টেবিলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে ডাস্টার দিয়ে উত্তম-মধ্যম প্রয়োগ। আমরা ৯০-তে যারা বেড়ে উঠেছি তখনও পর্যন্ত এই সংস্কারটি ছিল যে শিক্ষককে নিয়ে পরিবারে অভিযোগ মানে উত্তম-মধ্যম আরো দ্বিগুণ হয়ে সুদ সমেত ফিরে আসতো। তবে স্যারের রিডিং পড়া তন্ময় হয়ে শুনতাম, মার সয়েছি, গায়ে মাখিনি কখনোই। আর ডিসক্রিমিনেশন কিংবা ডিপ্রেশান এই শব্দগুলোর সাথে পরিচিত হইনি তখনও।

স্যারের ক্লাসে একটু মনমড়া হয়েই থাকতাম। কচি মন একটু আশ্রয় চাইতো, ঠিক কোথায় কার কাছে তাও বুঝতাম না। কতবার ভেবেছি কারো অন্তর জগতের ভাবনা লোকে, ব্যাক বেঞ্চারদের জন্য এতটুকু দরদ কি নেই। হঠাৎ একদিন কবিতার নেশায় আবিষ্কার করলাম এক দরদিয়াকে যিনি আমাকে দুষ্ট বলে দেখেন, দোষী মানেন না। যে রাগ করেন আমার উপর আবার ভালোও যে লাগে এটা মিথ্যে করে বলতে পারেন না।

যিনি বলেন বিদ্যা দেয়ার আর নেয়ার মধ্যে যদি ভক্তিরসের মিলন না ঘটে তবে যে নিচ্ছে সে আমার মতই অভাগা আর যিনি দিচ্ছেন তিনিও হতভাগ্য।

দুঃখিত হই এই ভেবে যে, আমি আমার সেই শিক্ষককে রেজাল্টের চমকে অভিভূত করতে পারিনি, হয়তো তার বিজ্ঞানের ছাত্ররা করেছে তা দেখে তাঁর ছাতিও ফুলে উঠেছে। আমার সাধ্যমতোই ছিলাম আমি অন্যের সাধ্যের প্রতি লোভ ছিলো না হয়তো হোনারও ছিল না।
আমার বাড়ন্ত সময়ের সাথে সাথে দরদিয়া মানুষটির সঙ্গে আমার সখ্যও বেড়ে উঠতে থাকে। তাকে দেখা যায় না, অনুভূতিতে চাইলেই পাওয়া যায় তবে ধরে রাখা যায় না। মৌড়ি গাছের ডগায় শিশিরবিন্দুর উপর লাজুক রোদ্দুরকে যেমন শিশির ধরে রাখতে পারে না ঠিক তেমন। তবে সূর্যদেব যেমন নিরাশ করেন না কখনোই, প্রতিশ্রুতি রেখে পরের দিন আবার উদয় হন পূবের আকাশে, মৌড়ির পাতায় শিশিরের সাথে করেন আলোর নাচন। ঠিক তেমনি অনন্ত অন্তরিক্ষ থেকে নেমে এসে সেই দরদিয়া ঠাঁই নেয় আমার নিভৃত প্রাণে পাঠ করে শোনান ‘আমি বিপুল কিরণে ভুবন করি যে আলো, তবু শিশিরবিন্দুরে ধরা দিতে পারি বাসিতে পারি যে ভালো।’

আমি সেই শিশির বিন্দু আর সকালের সূর্যটি আমার রবি ঠাকুর। সূর্য যেমন সকালের নরম আলোয় শিশিরকে ধরা দেন তেমনি রবিঠাকুরও আমাদের প্রত্যহ দিনে ধরা দেন, আমার প্রেমে-অপ্রেমে, আনন্দ-বেদনায়, সুখে এবং শোকে তিনিই আমার নিভৃত প্রাণের দেবতা। অন্ধকারে ঝড়ের খেয়ায় দাঁড়িয়ে যিনি অভয় দিতে পারেন ‘নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রæবতারা মনরে মোর পাথারে হোসনা দিশে হারা’।

শুক্রবার আমার ছেলে জশের স্কুল থেকে ফোন আসলো, যেতে হবে। জশ স্প্যাশাল নিড ক্লাসে ওরা মাত্র তিনজন। সে হঠাৎ হাইপার হয়ে যাওয়ায় ক্লাস রুমে একটি ছোট একুরিয়াম ধাক্কায় ভেঙে যায়। বিব্রত হয়ে গেলাম, মিথ্যে বলবো না একটু রাগী চোখেই তাকিয়েছিলাম তার দিকে, টিচারের দৃষ্টি এড়ায়নি সেটি। টিচার বললেন, প্লিজ ডোন্ট গিভ হিম আই। বিয়িং হাইপার ইজ নট ক্রাইম, হি ইজ কিউট পাই।’ এগারো বছরের ছেলের স্কুলে ক্লাসরুমে আবারো আবিস্কার করলাম সেই দরদিয়াকে।

তুমি বল, তিনু প্রশ্রয় পায় আমার কাছে-
তাই রাগ কর তুমি।
ওকে ভালোবাসি,
তাই ওকে দুষ্টু বলে দেখি,
দোষী ব’লে দেখি নে-
রাগও করি ওর ’পরে
ভালোও লাগে ওকে
এ কথাটা মিছে নয় হয়তো।
এক-একজন মানুষ অমন থাকে-
সে লোক নেহাত মন্দ নয়,
সেইজন্যই সহজে তার মন্দটাই পড়ে ধরা।
সে হতভাগা রঙে মন্দ, কিন্তু মন্দ নয় রসে;
তার দোষ স্তূপে বেশি,
ভারে বেশি নয়;
তাই, দেখতে যতটা লাগে
গায়ে লাগে না তত।

রোজকার যাপনে যতভাবে যতবার তোমায় আবিষ্কার করি রবিঠাকুর, তোমার ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। আঁধার কালো ঝরের ঝাপটায় যদি সকল মন্দিরের প্রদীপ নিভিয়ে দিয়ে যায়, একটি ঠাকুরের প্রদীপ মন মন্দিরে জ্বেলে থাকবে তুমি রবিঠাকুর।
আমার নিত্য স্মরণীয়ষু। আর সেই প্রদীপের আগুনের পরশমণির ছোঁয়ার গলে পড়ুক জমাট বাঁধা অহংকারের সঞ্চয়।
বইতে তোমায় ছুঁই না ঠাকুর মনদিয়ে তোমায় ছুঁই।