মুরশাদ সুবহানী : ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) ও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) এই দুই ক্ষণজন্মা ও যুগস্রষ্টা সম্পর্কে জানেন না, এমন শিক্ষিতজন খুব কমই আছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের চেয়ে বয়সে ৪ বছরের বড় ছিলেন। তাঁরা সমকালের। দু’জনের লেখনি ক্ষেত্র বিশেষ আলাদা হলেও, সমাজে ধর্মীয় কুসংষ্কার, অন্ধকার আর নারীদের অন্ত:পুর থেকে বের করে শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে আলো প্রক্ষেপণে ছিল তাদের অনেক মিল। সংষ্কৃত শাস্ত্রের বিরাট পন্ডিত ও গদ্যকার মহাশয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পাশ্চত্যের শিক্ষা গ্রহণে দ্বিধা করেননি। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত চলনে-বলনে, ছিলেন ইউরোপিয়ান।
ধর্মীয় কুসংষ্কার, অনাচারকে নির্বাসনে পাঠিয়ে আধুনিক শিক্ষা প্রসারে তাঁরা লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। বিধবা বিবাহকে আইনসিদ্ধ ও মানুষকে শিক্ষিত করতে লড়াই করেছেন মহাশয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কবি মধুসূদন দত্ত তখনও ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেননি নামের আগে মাইকেল যুক্ত হয়নি।
যৌবনের প্রারাম্ভে ১৮ বছর বয়সে মধুসূদন দত্ত ‘নয়ন প্রসারি’ দেখেছিলেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা নারীদের শুধু ভোগের সামগ্রীই মনে করে না, নারীরা পুরুষের জন্য অতিশয় দু:খের কারণ বটে।
হিন্দু সমাজে তখন নারী শিক্ষাকে ‘বৈধ্যব্যের প্রতীক’ বলে মনে করা হতো। অনেক মহিলা সেই যুগে নারী শিক্ষাকে মহা অনিষ্ট-অমঙ্গলের কারণ বলে বিশ্বাস করতেন। এর পেছনে ছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় কুসংষ্কারে আবৃত এক শ্রেণীর পুরুষ। তারা ধর্মের নামে বিভিন্ন প্রচার-প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে নারীদের মন ও মননে, এই ধারণাটি প্রোথিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন নারীরা শিক্ষিত হলে মহা অকল্যাণ হবে। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে (১৮১২-১৮৫৯) বলা হতো নারী বিদ্বেষী।
নারী শিক্ষাকে তিনি ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেননি। তিনি নারীদের নিয়ে নানা ব্যঙ্গাত্মক কবিতা লিখেছেন। তার মতো আরও অনেকেই ছিলেন সেই সময়। মহাশয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত নারী বিদ্বেষ ও কুসংষ্কারকে নির্বাসনে পাঠাতে অগ্রসর হলেন।
কবি মধুসূদন দত্ত ১৮৪২ খ্রীষ্টাব্দে হিন্দু কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নারী শিক্ষা বিষয়ে এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণের মাধ্যমে অবরুদ্ধ নারীদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য কলম ধরেন। এই বিষয়ে ইংরেজিতে প্রবন্ধ লিখে কবি মধুসূদন দত্ত স্বর্ণপদক লাভ করেন। মহাশয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন নারীমুক্তি, বিধবা বিবাহ প্রচলন ও শিক্ষা আন্দোলনের আর এক অগ্র সৈনিক। সেই সময় হিন্দু বিধবাদের প্রতি “অন্যায় অবিচার অত্যাচার তাঁকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল।”
রক্ষণশীল ও গোঁড়া মানুষদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, কটাক্ষ তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। তবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আন্দোলনকে বিদ্রুপকারীরা থামাতে পারেননি। যিনি মাতৃ আজ্ঞা পালনে ‘দামোদর নদ’ অতিক্রম করেছিলেন, সাঁতরিয়ে। তিনি তো সাহসীই হবেন। ভয়-শঙ্কা-ডঙ্কা-আশংকা কী সেই মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারে? পারে না। তিনি সফল হয়েছিলেন। তাঁর কারণেই ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়। “বৃটিশ শাসিত ভারতবর্ষে তৎকালের সকল বিচারব্যস্থায় হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ বৈধ করা হয়। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির সহায়তায় ভারতবর্ষে হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহ বৈধ করা হয়েছিল। বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় তৎকালীন বড়লাট লর্ড ক্যানিং আইন প্রণয়ন করে বিধবা বিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দেন (১৮৫৬ আইন, ২৬ জুলাই)।”
মহাশয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্যেগে ‘একাধিক বিধবার বিবাহ’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। তাঁর পুত্রও এক বিধবাকে বিবাহ করেন। বাল্যবিবাহ রোধ করতেও তিনি প্রচারে নামেন। নারী শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে শুধু কলকাতায় নয়, গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে নারী শিক্ষার আলো জ্বালাতে মহাশয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অগ্রসর হন। গড়ে তোলেন একাধিক বিদ্যালয়।
তাঁর সম্পর্কে মাইকেল মধুসূদন দত্তের ভাষায় “তাঁর মধ্যে একই সঙ্গে মিলে মিশেছিলো ইউরোপের কর্মদক্ষতা বাঙালি মায়ের কোমলতা। উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে শিক্ষিত বাঙালি মাত্র মানুষ হয়েছিলেন তাঁরই বর্ণপরিচয় ও বোধোদয় পড়ে।” (গোলাম মুরিশদ সম্পাদিত সার্ধশত- বর্ষ স্মারকগ্রন্থ)
কবি মধুসূদন দত্ত সেই সময় “তাঁর কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে সাথে নিয়ে হাতে লেখা ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন।”
এই পত্রিকায় নারী শিক্ষাসহ সমাজকে অগ্রসরমান করতে নানা বিষয়ে রচনা প্রকাশিত হয়। কবি মধুসূদন দত্ত কলেজের ছাত্র থাকাকালেই নারী শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্দি করে তাঁর প্রবন্ধে লেখেন, “On the importance of educating Hindu Females, with reference to the improvement which it may be expected to produce on the Education of Children in their early years and the happiness it would generally confer on domestic life’’.
নারীদের শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে একই সাথে কবি মধুসূদন দত্ত বলেন, “শিশুদের প্রথমে দিকের শিক্ষা তাদের মনে সুখানুভূতি সৃষ্টি করবে, তাদের পারিবারিক জীবনে সুখ-আনন্দ সঞ্চারিত হবে।”
কবি মধুসূদন দত্ত মাকে পরিচর্যাকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ বোধ করি, শিশু বয়সে তিনি তাঁর মাতা জাহ্নবী দেবীর কাছ থেকেই রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ শিক্ষা লাভ করেন।তিনি উপলব্ধি করেছেন, মা হচ্ছেন শিশুর আসল পরিচর্যাকারী।
এ কথা সবাই জানেন, শিশুর প্রথম পাঠ ও পাঠশালা হচ্ছে তার পরিবার। আর সেই পরিবারে শিশুকে সুন্দর করে প্রস্ফুটিত করার দায়িত্ব পড়ে মায়েদের উপর। মা হলেন, এই শিশু ফুল বাগানের মালিনী।একজন শিক্ষিত মা তাঁর শিশুকে কুসংস্কারমুক্ত করে, অহেতুক অলিক ভূত-প্রেত, দৈত্য দানবের বিশ্বাস ভেঙ্গে দিয়ে শিশুকে বিজ্ঞান মনস্ক শিক্ষিত মানুষ করে গড়ে তোলার প্রাথমিক কাজটি করতে পারেন।
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এটি গভীরভাবে উপলব্ধি করেই নারী শিক্ষার উপর সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মহাশয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর স্কুলের পরিদর্শক হিসেবে চাকুরীকালে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি ও কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত শিক্ষার আলোর প্রক্ষেপণ অন্ধকার কুসংস্কার আচ্ছাদিত সমাজের ভেতরে ফেলতে পেরেছিলেন। তাঁরা সফল হয়েছেন।
এইভাবে যুগে যুগে ক্ষণজন্মা মানুষের আবির্ভাব হয়েছে। সমাজ সংস্কারে তাঁরা ব্রতী হয়েছেন। সমাজ থেকে কালো মেঘ দূরীভূত করে শিক্ষার আলো প্রক্ষেপণের কাজ করেছেন। জ্বালিয়ে দিয়েছেন, শিক্ষার আলোর মশাল। ভারত বর্ষে সুফি সাধক, বিদ্বান- বিদুষীদের মাধ্যমেও শিক্ষার আলো বিস্তৃত হয়েছে। সেই মশাল পরবর্তী প্রজন্মের হাতে এসেছে। তাঁরাও শিক্ষার মশাল নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে সাহিত্যিক ও নারী জাগরণের অগ্রদূত রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামের বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন একজন। তিনি শিক্ষার মশাল হাতে এগিয়ে গেছেন। এইভাবে শিক্ষার আলো দিকে দিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন অনেকেই।এ ধারা অব্যাহত আছে। তাদের কারো নাম আমরা জানি, আবার কারো নাম জানি না। ২৫ জানুয়ারি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৯৮তম জন্ম বার্ষিকীতে তাঁর প্রতি এবং কুসংস্কার দূর করে শিক্ষার আলো জ্বালাতে যাঁরা অগ্রগামী হয়েছেন তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। #
(লেখক : সাহিত্যের সেবক, অ্যাডভোকেট, জজকোর্ট, পাবনা, বাংলাদেশ), ফ্লোরিডা, ইউএসএ প্রবাসী