ফরিদ আহমেদ : আগেকার দিনে বাংলাদেশের গ্রামগুলো ছিলো নিস্তরঙ্গ। সেই নিস্তরঙ্গ সময়ে সন্ধ্যার পরে গল্পের আসর বসতো। কথাবার্তায় পটু যারা তারা আকর্ষণীয় ঢঙ্গে গল্প বলতো। অন্যেরা সেই গল্প শুনে আমোদিত হতো। এইসব গল্প মুখে মুখেই প্রচলিত ছিলো। কেউ সেগুলোকে লিখে রাখার প্রয়োজনীয়তাবোধ করেনি কখনো। একজন ব্যতিক্রম। তিনি হচ্ছেন পল্লীকবি জসিমউদ্দিন।

কবি জসিমউদ্দিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন এইসব গল্প সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। প্রায় দুইশো গল্প তিনি শুনেছিলেন বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে। সেগুলোর বেশ কয়েকটাকে তিনি তাঁর নিজের ভাষায় লিখে বই আকারে প্রকাশ করেন। বইটার নাম হচ্ছে ‘বাঙ্গালীর হাসির গল্প’। বইটা দুই খণ্ডে বের হয়েছিলো। বই দু’টো যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন কতো মজার মজার গল্প রয়েছে সেখানে।

‘বাঙ্গালীর হাসির গল্প’ বইটার প্রথম খণ্ডের চতুর্থ গল্পটার নাম হচ্ছে ‘নাপিত-ডাক্তার’। গল্পের সারসংক্ষেপ এমন। এক ছোট্ট শহরের এক নাপিত ছিলো। চুল কাটা তার আসল পেশা। কিন্তু, সেটা বাদ দিয়ে সেই নাপিত একদিন শহরের সবচেয়ে বড় ডাক্তার হয়ে পড়লো। যে কোনো রোগ হলেই রুগীরা ছুটে আসতো তার কাছে। নাপিত তাদের রোগের চিকিৎসা করতো। শুধু রোগের চিকিৎসাই না, ওই শহরের সবচেয়ে বড় শল্যচিকিৎসকও হয়ে ওঠে ওই নাপিত। ক্ষুর দিয়ে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে যে কোনো জটিল অপারেশন করে ফেলতো সে।

ডাক্তার হিসাবে নাপিতের এই উত্থানে আসল ডাক্তারদের অবস্থা হয়ে উঠলো কাহিল। কোনো রুগীই আর তাদের কাছে আসে না। সংসার আর চলে না বলে সব ডাক্তাররা গিয়ে শহরের সবচেয়ে বুড়ো আর অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে গেলো বুদ্ধি নিতে। তিনি বললেন যে, নাপিত কিছু না জেনেই চিকিৎসা করছে। এটা রুগীদের জন্য বিপদ বয়ে আনতে পারে। তোমরা বরং সবাই মিলে তাঁকে চিকিৎসাবিদ্যার নানা দিক শেখাও। বুড়ো ডাক্তারের কথা শুনে সব ডাক্তাররা নাপিতকে ডাক্তারি বিদ্যা শেখাতে লাগলো। নাপিতও মহা খুশিতে শিখে নিতে লাগলো ডাক্তারি বিদ্যা।

ডাক্তারি বিদ্যা শেখার পরেই শুরু হলো আসল সমস্যা। নাপিত আর এখন ক্ষুর দিয়ে অপারেশন করতে পারে না। অপারেশন করার আগে মনে তার নানা কথা আসে। ক্ষুরটা জীবাণুমুক্ত হয়েছে কিনা। এইখানে শিরা, ওইখানে উপশিরা, তার পাশে ধমনী। কোনটা কাটতে না কোনটা কেটে ফেলি। এই ভয়ে ভয়ে অপারেশন করার আগেই তার হাত থেকে ক্ষুর পড়ে গেলো।

যে নাপিত আগে ডাক্তারি না জেনেই চিকিৎসা করেছে, ভয়ডরহীনভাবে অপারেশন করেছে, সেই একই নাপিত ডাক্তারি বিদ্যা জানার পরে ডাক্তারি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার! তাই না?

আশ্চর্যের কিছু নেই। মানুষের জ্ঞান যখন বৃদ্ধি পায়, তখন তার ধারণা জন্মায় যে জ্ঞানের কতো কিছুই সে জানে না। জ্ঞানের একটা বিশাল অংশ না জানার কারণে তার মধ্যে তৈরি হয় নম্রতা। যে কারণে সক্রেটিস বলেন, ‘আমি শুধু এটাই জানি যে, আমি কিছুই জানি না।’ অথচ আমরা সবাই জানি, প্রাচীনকালের সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ ছিলেন তিনি। নিউটনের কথাই ধরুন। তিনি বলেছিলেন, ‘জ্ঞান সাগরের তীর থেকে তিনি নুড়ি কুড়চ্ছেন মাত্র।’ অন্যদিকে অজ্ঞানতা মানুষকে তার নিজের অজ্ঞানতা দেখতেই বাধা দেয়। তার যে জ্ঞান সীমিত, সেটা বোঝার সামর্থ্যই তার থাকে না। ফলে, বিদ্বানদের মতো বিনম্র এবং বিভোল হয় না সে। তার মধ্যে কাজ করে ঔদ্ধত্য এবং অহংকার। অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে জন্ম নেয় অপরিমেয় আত্মবিশ্বাস। ডারউইন বলেছেন, “Ignorance more frequently begets confidence than does knowledge.”

স্বল্প-জ্ঞানী বা স্বল্প মেধাবী মানুষদের এই আত্মবিশ্বাসকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ডানিং-ক্রুগার এফেক্ট বলে। এই নামটা এসেছে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন মনোবিজ্ঞানীর নামে। এঁদের একজন হচ্ছেন ডেভিড ডানিং এবং অন্যজন হচ্ছেন জাস্টিন ক্রগার। ১৯৯৯ সালে একটা তাঁরা দুজনে একটা পেপার পাবলিশ করেন। সেই পেপারে ডানিং-ক্রুগার এফেক্ট নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

দুই মনোবিজ্ঞানী তাদের গবেষণায় অংশ নেওয়াদের গ্রামার, হিউমার এবং লজিকের উপরে কিছু পরীক্ষা নেন। সেই ফলাফল প্রকাশ না করে তারা আবার অংশগ্রহণকারীদের নিজেদের মূল্যায়নই জানতে চান। সেই মূল্যায়নকে তারা আসল রেজাল্টের সাথে তুলনা করেন। বিষয়টাকে সহজভাবে বললে বলা যায়, আপনি এইচএসসি পরীক্ষা দেবে এমন একদল ছাত্র-ছাত্রীকে পরীক্ষার আগেই জিজ্ঞেস করতে পারেন যে তারা কেমন ফলাফল হবে বলে আশা করছে। তাদের সেই নিজস্ব মূল্যায়নকে পরে আপনি পরীক্ষার আসল ফলাফলের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারেন।

ডেভিড ডানিং এবং জাস্টিন ক্রুগার তাঁদের পরীক্ষার ফলাফলে কী পেলেন, সেই বিষয়ে আসি। হিউমার পরীক্ষাতে তাঁরা অংশগ্রহণকারীদের বেশ কিছু কৌতুক দিলেন এবং সেগুলোকে ১ থেকে ১১ এর মধ্যে রেটিং করতে বললেন। এই জোকগুলোকে তাঁরা আবার আটজন প্রফেশনাল কমেডিয়ানের কাছে পাঠালেন। কারণ, তাঁরাই সবচেয়ে ভালো করে জানেন কোন কৌতুকের কেমন মান। প্রফেশনাল কমেডিয়ানদের সেই স্কোরকে তারা পরে তুলনা করলেন অংশগ্রহণকারীদের রেটিং এর সাথে। তবে, তার আগে শেষ যে কাজটা তাঁরা করলেন, সেটা হচ্ছে অংশগ্রহণকারীদের নিজেদের সেন্স অব হিউমার কেমন সেটার রেটিং করতে বললেন।

ফলাফলে দেখা গেলো যারা নিজেদের বিষয়ে উচ্চ রেটিং দিয়েছে, তারা কম স্কোর করেছে, অন্যদিকে যারা নিজেদের কম রেটিং করেছে, তারাই উচ্চ নম্বর পেয়েছে। এটা ডানিং-ক্রুগার এফেক্ট বা সংক্ষেপে ডিকেই। এর সারমর্ম হচ্ছে, একজন ব্যক্তি যে বিষয়ে সামাজিক বা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে কম দক্ষ, সেই বিষয়ে তারা বেশি মাত্রায় আত্মবিশ্বাসী থাকে। সেদিন এক ভিডিওতে দেখলাম চট্টগ্রামের মেয়র মহোদয় ইঞ্জিনিয়ারদের প্রকৌশল বিদ্যা শেখাচ্ছেন রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে। আমাদের ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট কাজী সালাহউদ্দিনকেও উদাহরণ হিসাবে এখানে আনতে পারি আমরা। তিনি একবার খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছিলেন ২০২২ সালে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলবে। তাঁর ওই অতি আত্মবিশ্বাস নিশ্চিতভাবেই অদক্ষতা এবং অজ্ঞানতা থেকে উদ্ভূত। অন্যদিকে, যাঁর কিছুটা দক্ষতা আছে, তিনি জানেন ভুল হবার সম্ভাবনা আছে। ফলে, সেখানে তাঁর আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয়।

এই ধরনের অদক্ষ এবং অশিক্ষিত মানুষজনকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এড়িয়ে যাওয়াটাই হচ্ছে কল্যাণকর। সমস্যা হচ্ছে, এদের অনেকেই আবার বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদে জায়গা করে নেয়। সেই জায়গায় বসে মহা আত্মবিশ্বাসের সাথে তারা সর্বনাশা সব সিদ্ধান্ত নিতে থাকে। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে বলে তাঁদের বিষয়ে কোনো সঠিক ফিডব্যাক কেউ দিতে সাহস করে না। বরং উল্টোটাই ঘটে। একদল মানুষ নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য এদেরকে প্রশংসা করে ভাসিয়ে দেয়।

ডানিং-ক্রুগার আরেকটা সাইকোলজিক্যাল এফেক্টকে সাপোর্ট করে। সেটা হচ্ছে, বেশিভাগ মানুষই তার নিজের সম্পর্কে অতিরিক্ত ধারণা পোষণ করে। এটাকে বিল প্লাস টুয়েন্টি পার্সেন্ট এফেক্ট বলে। রেস্টুরেন্ট খেতে গেলে যেমন বিলের সাথে টিপসও যুক্ত করতে হয়, অধিকাংশ মানুষ তেমনি নিজেকে একটু বাড়িয়ে দেখতে পছন্দ করে।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকোলাস এপলি এবং এরিন হুইটচার্চ এ নিয়ে একটা গবেষণা করেছিলেন। তাঁরা কিছু মানুষকে ল্যাবে নিয়ে আসেন। এনে তাদের ছবি তোলেন। সেই ছবিগুলোর আসলের সাথে সাথে কিছু ছবিকেও এডিট করে তাতে সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়। কয়েক সপ্তাহ পরে এদেরকে আবার ল্যাবে নিয়ে আসা হয়। সেখানে একেকজনকে তাদের নিজেদের অসংখ্য ছবি দেওয়া হয়। সেগুলোর বেশ কিছু ছিলো তাদের আসল ছবি, আর অল্প কিছু সৌন্দর্যবর্ধন করা ছবি। দেখা গেলো যে ছবিগুলোতে দশ বা বিশ শতাংশ সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে, সেগুলোকেই তারা তুলে নিচ্ছে তাদের আসল ছবি হিসাবে।
আরেকটা পরীক্ষায় তাদেরকে অন্যদের ছবির বান্ডিল দেওয়া হয়। প্রত্যেকের ছবির বান্ডিলের মধ্যে তার ছবি সেখানে ছিলো মাত্র একটা। তাদের কাজ হয় সেই বান্ডিলের মধ্য থেকে নিজের ছবিটা খুঁজে বের করা। গবেষকদ্বয় দেখতে পান না, এই ছবিটার যদি আকর্ষণীয়ভাবে সৌন্দর্যবর্ধন করা থাকে তবে, অংশগ্রহণকারীরা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে নিজেদের ছবিকে খুঁজে পাচ্ছে। আর ছবি ছবিকে না বদলানো হয় বা সৌন্দর্যহানি করে অনাকর্ষণীয় করা হয়, সেক্ষেত্রে তাদের নিজের ছবিকে খুঁজে পেতেই দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে।

এপলি এবং হুইটচার্চের গবেষণাটা শুধুমাত্র ছবি বা সৌন্দর্য নিয়ে হলেও এর সার্বজনীন আবেদন রয়েছে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই নিজের সম্পর্কে কিছুটা বাড়িয়ে দেখার প্রবণতা থাকে।
আমাদের সেই নাপিতের গল্পে আবার ফিরে যাই। আত্মবিশ্বাস থাকাটা দোষের কিছু না। তবে, সেই আত্মবিশ্বাস আসা উচিত উপযুক্ত জ্ঞান এবং পর্যাপ্ত দক্ষতা থেকে। আমাদের গল্পের নাপিতের এগুলো কিছুই ছিলো না। না থাকার কারণে সে নিজেও জানতো না তার ঘাটতিটা আসলে ঠিক কোন জায়গাতে। ফলে, সব জায়গাতেই সে তার ক্ষুর চালিয়ে দিয়েছে। এতে কিছু কিছু অপারেশনে সে সফল হয়েছে, অনেক অপারেশন বিফলে গিয়েছে। মানুষ তার সাফল্যকে মনে রেখেছে, বিফলতাকে ভুলে গিয়েছে। আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেও এমন নাপিতের কোনো অভাব নেই। এরা প্রতিনিয়তই অদক্ষ সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে অতি আত্মবিশ্বাস নিয়ে। সেগুলোর কিছু কাজ করছে, বেশিরভাগই ব্যর্থ হচ্ছে। সেই সফলগুলো নিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, বিফলতাগুলোকে ঢেকে রাখা হচ্ছে।
এই কৌশল হয়তো স্বল্প সময়ের জন্য কার্যকরী, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা দেশের জন্য ধ্বংসাত্মক।