শারমীন শরীফ : আমি তখন সবে ক্লাস টেনে উঠেছি, মেজদা হঠাৎ কয়েকদিনের জন্য কোথাও বেড়াতে গেল এবং ৩/৪ দিনের মধ্যে ফিরেও এল। সপ্তাহ ২/৩ পরে জানা গেল যে মেজদা লুকিয়ে তার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করতে গিয়েছিল। ব্যাপারটা এরকম ছিল, মেজদা বাড়িতে জানিয়েছিল যে সে এক জনকে পছন্দ করে এবং যথারীতি আমার মা খোঁজখবর শুরু করলেন- মেয়ে কেমন, কার মেয়ে এইসব! মেজ ভাবীর এক লতায় পেঁচানো ফুফু আমাদের বাড়ির কাছে থাকতেন।
মহা কুটনি এক মহিলা। সে এসে দুনিয়ার সব উদ্ভট কথা বলে মায়ের কান ভারী করে দিল, ব্যাস মেজদার ভবিষ্যত ঝরঝরে হয়ে গেল। মা, ভাবিকে না দেখেই সোজা বলে দিলেন এই মেয়ে তাঁর পছন্দ না। এদিকে মেজদা তো ভাবির প্রেমে পাগল। বেচারা মেজদা অনেকদিন অপেক্ষা করল মায়ের মতের যদি পরিবর্তন হয়, কিছুই হল না। এদিকে ভাবির বাড়িতে তখন তাঁর বিয়ের তোরজোড় এবং ভাবিও বিয়ে আর ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না তখন মেজদা বাধ্য হয়ে একদিন আলতাফ ভাইকে নিয়ে গিয়ে একা একা বিয়ে করে ফেলল। মেজদা ভেবেছিল যে বিয়ে করে ফেললে একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক হয়েছিল বটে তবে সেটা অনেক অনেক পরে। যাই হোক সেই কুটিনি ফুফু এসে মায়ের কানে খবর দিয়ে দিল। তারপরে আমাদের বাড়িতে যে কি হয়েছিল সেটা এখনো ধোঁয়াশা। মা খুব রেগে গিয়েছিলেন এবং পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে বউ এই বাড়িতে আনা যাবে না। আব্বা অনেক করে বুঝালেন মাকে, আব্বা বললেন- যে জীবনটা যেহেতু আবুর সেহেতু সে কাকে বিয়ে করবে সে বিষয়ে তাকে পূর্ণ অধিকার দেয়া উচিৎ। কে শোনে কার কথা মায়ের এক জেদ, যেহেতু মেজদা এই কান্ড একা একা করেছে সেহেতু কিছুতেই সে ওদের ক্ষমা করবেন না এবং বউ বাড়িতে আসবে না। ঘরের মধ্যে সারাক্ষণ সেই এক প্যাঁচাল চলতে থাকল।
খবর পেয়ে বড় ভাই, বোনেরা ছুটে এল মাকে বোঝানোর জন্য কিন্তু সব বিফলে গেল। হঠাৎ করে সব কিছু কেমন থমথমে হয়ে গেল। মেজদা সেই আগের মত রোজ বাড়ি ফেরে কিন্তু সব সময় মন খারাপ করে থাকে, মা আর আগের মত মেজদার কাছে গিয়ে গল্প করে না। সব কেমন এলোমেলো হয়ে সুরটা কোথায় ছিঁড়ে গেল। একদিন বিকেলে সেই কুটিনি ফুফু এল আমাদের বাড়িতে এবং মায়ের কানের কাছে বসে গুটগুট করে কি সব বলল এরপরে মা খুব অস্থির হয়ে কান্নাকাটি শুরু করলেন। কিছুতেই আর থামে না আর এদিকে আমি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যাস্ত কিন্তু বাসায় মেজদার বিয়ে নিয়ে সারাক্ষণ একটা অস্থিরতা। সেদিন আমার কি হয়েছিল কে জানে আমি ভীষণ রেগে গিয়ে আমার সব বই খাতা ছুঁড়ে উঠানে ফেলে দিলাম। বললাম আর পড়াশুনা করবো না, বলে আমি ছাদে চলে গেলাম। আব্বা বাবুলকে বললেন বই খাতা সব তুলে এনে আমার টেবিলে রাখতে, মায়ের দিকে একবার তাকালেন শান্ত ভাবে আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেলেন এবং মা তখনি চুপ মেরে গেলেন। সেদিন রাতে আব্বা জেগে বসেছিলেন মেজদার সাথে কথা বলবেন বলে। মেজদা এসে খেয়ে দেয়ে যথারীতি সিগারেট ধরিয়েছে আর এদিকে আব্বা আস্তে আস্তে মেজদার রুমের দিকে যাচ্ছেন। আমি জানতাম আব্বা মেজদার সাথে কথা বলতে এদিকে আসবেন আর তাই যেই পায়ের আওয়াজ পেলাম আমি মেজদার মুখ থেকে সিগারেট টেনে নিয়ে ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দিলাম। মেজদা হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ঠিক সে সময় আব্বার আগমন। আব্বাকে দেখেই মেজদা দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, ‘আব্বা কিছু বলবেন’? আব্বা বললেন, ‘আবু তুমি বৌমা কে নিয়ে আলাদা বাসা করে উঠে যাও, বৌমা আর কতদিন তার বাবার বাড়িতে থাকবে’? মেজদা একটু চুপ থেকে বলল, ‘না আব্বা, আমি এখন মনিকে একা ফেলে যাবো না, আপনার বউমা আর কিছুদিন থাকুক তার বাপের বাড়িতে। মনিকে ঢাকা পৌঁছে দিয়ে এসে তবে বাসা নেব’। আব্বা মেজদার মুখের দিয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ তারপরে মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেলেন।
আমার চোখে তখন পানি, আমি ঢোক গিলে মেজদাকে বললাম, থ্যাঙ্কিউ। মেজদা আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে একটা টান দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিল, আমি নিয়ে জোড়ছে একটা টান দিয়ে খকখক করতে করতে চোখ মুছলাম। মেজদা গেল না তবে আগে যেমন দুপুরে বাড়িতে খেতে আসত এবং বিকেলে মেজদা আবার ক্লিনিকে চলে যাবার আগে আমাদের যে একটা বারান্দা সেশন হত সেটা বন্ধ হয়ে গেল। মেজদা দুপুরে শ্বশুর বাড়িতে যেতে শুরু করল আর ভাবিদের বাসা মেজদার ক্লিনিক থেকে ৫ মিনিট দূরে ছিল বলে সুবিধাও হত কিন্তু দিনের শেষে মেজদা ঠিক ঠিক বাড়িতে ফিরে আসত। আর তাই আব্বার এত তাড়া ছিল আমাকে ঢাকা পাঠিয়ে দেবার জন্য।
পেটে প্রচন্ড ব্যাথা ওঠায় মেজদা আমাকে বরিশাল মেডিকেল কলেজে নিয়ে গেলে সাথে সাথে ডাক্তাররা আমাকে এটেন্ড করল; ভাইয়া, মেজদি এবং মেজ দুলাভাইয়ের ব্যাচমেট বা টিচার এরা সবাই, সেই সুবাদে আলাদা খাতির পেয়েছি। ওরা মেজদাকে বলল যে আমার এ্যপেন্ডিক্স বার্স্ট করেছে এবং তখনি অপারেশন করতে হবে, এক মুহূর্ত দেরি করা যাবে না। যেহেতু আমাকে ফুল এনেস্থেশিয়া দেয়া হবে তাই মেজদাকে বলল বন্ড সই করে দিতে । মেজদা অনুরোধ করল একটু অপেক্ষা করতে কারণ আব্বা তখন হয়ত হসপিটালের পথে। ওরা বলল যে অপেক্ষা করলে আমার বিপদ হতে পারে তখন মেজদা কাঁপা কাঁপা হাতে সই করে দিল। ওরা আমাকে নিয়ে অপারেশন রুমে ঢুকে গেল। আমাকে অপারেশন টেবিলে শোয়ানোর পরে ভাইয়ার বন্ধু এসে আমাকে বলল, ‘মনি এক থেকে দশ গোন তো’, মনে আছে আমি চার গোণার পরে সব কেমন ঝাপসা হয়ে এল। এর পরে যখন জ্ঞান ফিরে এল আমি তখন পোস্ট অপারেটিভ রুমে, আমার পাশে আমেনা খালা বসা। কাউকে ঢুকতে দেবার কথা না কিন্তু আব্বা নাছোড়বান্দা ছিলেন তখন বাধ্য হয়ে হসপিটাল কতৃপক্ষ একজন কে ঢুকতে দিতে এবং সারারাত আমার কাছে থাকার অনুমতি দিল। আব্বা সাথে সাথে বাসায় গিয়ে আমাদের রাঁধুনি আমেনা খালাকে নিয়ে এলেন। আমি পানি খেতে চাইলে খালা একটুকরো বরফ আমার ঠোঁঠে ঘষে দিয়ে বলল ওই পানিটা শুষে নিতে। খালা উঠে দৌড়ে বাইরে গিয়ে আব্বা কে বলে এল যে আমার জ্ঞান ফিরেছে এবং আমি ভাল আছি। পড়ে শুনেছি আব্বা এসে যখন দেখলেন যে আমাকে এরমধ্যে অপারেশনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং সে আমাকে দেখতে পারেনি তখন থেকে আব্বার কান্না শুরু হয়েছিল এবং যতক্ষণ না আমেনা খালা গিয়ে আমার জ্ঞান ফেরার কথা বলেছে ততক্ষণ নাকি কেঁদেছেন। আব্বা কিছুতেই বাসায় যাবেন না, মেজদা জোড় করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আব্বাকে। মেজদা কোন একসময় গিয়ে ভাবিকে নিয়ে এসেছিল এবং দু’জন মিলে সারারাত বাইরে বসে ছিল। সকাল বেলায় আমাকে কেবিনে নিয়ে এল, দু’টো বিছানার একটা রুম নিল মেজদা যাতে সে আর ভাবি আমার সাথে সর্বক্ষণ থাকতে পারে।
আব্বা মনে হয় সূর্য ওঠার সাথে সাথে হসপিটালে এসে হাজির হয়েছিলেন। আমাকে কেবিনে নেবার সাথে সাথে এসে আমার পাশে বসে আমার হাত ধরে বসে থাকলেন আধাদিন আর থেকে থেকে চোখ মুছলেন। আমি যতই বলি, আব্বা আমি ভাল আছি, ততই তাঁর কান্না বেড়ে যায়। আব্বা দুপুরে যাবার জন্য প্রস্তুত হলে মেজদা আব্বাকে জানিয়ে দিল যে সে আর ভাবি সারাক্ষণ আমার সাথে আছে এবং আব্বা যেন কোন চিন্তা না করে। আব্বা নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। বাসা থেকে টিফিন ক্যারিয়ারে করে দু’বেলা খাবার নিয়ে আসত বাবুল। যেহেতু ভাবি আমার কাছে ছিল মা আর দেখতে এলেন না আমাকে, আব্বার কাছ থেকে শুনে নিতেন আমার খবরাখবর। অপারেশনের প্রথম দিন রাত্র তখন ১টা হবে। আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, মনে হল কিছু একটা দলা আমার নিচের দিকে নেমে গেল। বুঝলাম বাথরুমে যেতে হবে। পাশের বিছানায় তাকিয়ে দেখি মেজদা-ভাবি পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। আমার মায়া হল তাই ওদের না জাগিয়ে আমি হাত থেকে স্যালাইনের সুঁচ খুলে একা একা বিছানা থেকে বাথরুমে গেলাম এবং গিয়েই দেখি আমার ভীষণ বিøডিং হচ্ছে। আমার সব কেমন গুলিয়ে গেল আমি ধপাস করে অজ্ঞান হয়ে গেলাম, এত জোরে পড়েছি যে দরজা খুলে আমার অর্ধেক শরীর বাথরুমের বাইরে। শব্দ শুনে ভাবি দৌড়ে এসে আমাকে এ অবস্থায় দেখে চীৎকার করল। অনেক রক্ত চারিদিকে। পড়ে যাওয়াতে সেলাইও ছুটে গিয়েছিল। মেজদা দৌড়ে গেল ডাক্তার ডাকতে। সরোয়ার ভাই তখন ডিউটিতে, সে ভাবির বড় ভাইয়ের বন্ধু। আমাকে নিয়ে গিয়ে আবার সেলাই দেয়া হল, রক্ত বন্ধ করতে করতে আমাকে সমানে বকলেন সরোয়ার ভাই। আমি রুমে ফিরে মেজদাকে অনুরোধ করলাম যে এগুলোর কিছুই যেন আব্বাকে না বলা হয়, মনে হয় মেজদারও একই মত ছিল, কারণ বকাটা সেই বেশি খেত এবং ভাবির সামনে আব্বার বকা খাবার কোন ইচ্ছাই মেজদার ছিল না। বিকেলে এক জুনিয়র ডাক্তারের আগমন হল আমার সব ভাইটাল চেক করবার জন্য, সে তখন তাঁর ইন্টার্নশিপ করছে। এরপরে দেখলাম সে ঘনঘন আসছে, ডিউটি ছাড়াও আসছে। ভাবি মজা করে বলল যে নতুন ডাক্তার মশাই আমার প্রেমে পড়েছে। মেজদাও মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। আমি জোরে হেসে উঠতেই ব্যাথা পেয়ে কঁকিয়ে উঠলাম। মেজদা ভয় পেলে আমি আশ্বস্ত করলাম কিছুই হয়নি। মেজদা বলল যে আমি এরকম করলে ওই নব্য ডাক্তার কে ডেকে এখানেই থাকতে বলবে সারাক্ষণ। আমি আবারো হাসলাম এবং আবারো ব্যাথা পেলাম। (চলবে)