শারমীন শরীফ : সারেং বউ এসেছে সিনেমা হলে। আমার মেজদি, সেজদি দু’বোনই তখন বিবাহিত, মেজদির কাবিন হয়ে গিয়েছে কিন্তু তুলে নেয়নি কারণ মেডিকেলের ফাইনালের আগে সে এই তুলে নেয়াতে রাজি না তাই আর সেজদির বিয়ে হয়ে বর তখন এ্যমেরিকায় চলে গিয়েছে। ওরা প্ল্যান করেছে সারেং বউ দেখতে যাবে। দু’জন সেজেগুজে ম্যাটিনি শো দেখতে যাবার জন্য প্রস্তুত। আমি খেলছিলাম, বাবুল এসে বলল, ‘ও ছোট্ট ফুফু,আমনেরে থুইয়া হেরা দেহি বেড়াইতে যায়’। খেলা ফেলে একছুট্টে বাসায় এসে থেকে থেকে দেখছি ওদের সাজগোজের বাহার। চুপচাপ দেখে যাচ্ছিলাম যে ব্যাপারটা কি হয় কারণ আমাকে কেউ রেডি হতে বলছিল না। এমন একটা ভাব করছিল দু’জন যে আমার কোন অস্তিত্বই নেই, এর মধ্যে এক সময় মা আমাকে হাতের কাছে পেয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে গোসল করিয়ে দিল। ওরা যেহেতু আমাকে নেবে না তাই আমাকে দেখেও না দেখার ভান করছিল আর আমি ভাবছিলাম যে নিজেদের সাজসজ্জা শেষ হলে আমাকে রেডি করবে। এমা, এক সময়ে দেখলাম দু’জন গুটগুট করে বেড়িয়ে যাচ্ছে। আমিও পেছন পেছন যাচ্ছি আর জিজ্ঞেস করছি আমাকে নিচ্ছে না কেন কিন্তু কোন উত্তর নেই, মুখ বন্ধ করে দুজন বেড়িয়ে যাচ্ছে। ব্যাস আর কই যায় আমি বাসার সামনে গেটের কাছে দিয়ে সটান শুয়ে পড়লাম এবং গড়াগড়ি দিয়ে এমাথা থেকে ওমাথা আর সাথে কাঁদতে কাঁদতে একই কথা, ‘আমাকে নিবি না কেন, আমাকে নিবি না কেন’?

মেজদির মনে একটু দয়ামায়া ছিল বলে সে সেজদি কে বলেছিল, ‘চল ওকে নিয়ে যাই,’ এটা আমার কানে যেতে মাথাটা একটু তুলেছিলাম কিন্তু পরক্ষণেই সেজদি যখন না করে দিল ব্যাস আবার গড়াগড়ি। কিছুতেই গেট থেকে বেরতে পারছিল না এদিকে তখন আবার আব্বা ছুটিতে বাড়িতে তাই এ নিয়ে ওরা আর কোন বাড়াবাড়িও করতে চাইছিল না একরকম বাধ্য হয়ে মেজদি এক ঝটকায় আমাকে তুলে নিয়ে কোনমতে জামা বদলে আর মাথায় একটা ঝুটি করে নিয়ে বেরিয়ে গেল, এমনিতেই ওদের দেরি হয়ে গিয়েছিল। আমার জন্য সেদিন ওদের টিকেট কাটতে হয়েছিল না হলে কোলে বসাতে হবে। সিনেমার মাথামুণ্ডু ধার আমি ধারিনি, আমার প্রধান লক্ষ্য ছিল বোনদের সাথে যাওয়া এবং খাওয়া। শুরু হল কোক আর পেস্ট্রি খাবার জন্য বায়না। সিনেমা শুরুর আগেই আমার মুখ বন্ধ করার জন্য মেজদি ওগুলো কিনে দিল। ওরা সিনেমা দেখছে আর দুজনের মধ্যেখানে বসে আমি মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছি। একটু পরেই শুরু হল বাথরুমে যাবার বায়না। সিনেমা বিরতির তখনো অনেক বাকি। মেজদি কয়েবার বলল চুপ করে বসার জন্য কিন্তু ওরা আমার সমস্যাটা বুঝছে না, একটা আস্ত কোক তখন আমার পেট থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত। আমি ঘ্যানঘ্যানানিতে ওস্তাদ ছিলাম। বাধ্য হয়ে মাঝ পথে আমাকে নিয়ে উঠে গেল মেজদি। ফিরে আসার সময় দেখি ঘটি গরম চানাচুর ওয়ালা বসে আছে ব্যাস খাবার বায়না ধরলাম, তাড়াতাড়ি কিনে নিয়ে ফিরে এসে বসলাম। চানাচুর খেয়ে ঝাল লাগাতে পানির জন্য ঘ্যানঘ্যান শুরু করলাম। পানি খেয়ে আবার বাথরুমে যাবার বায়না। এগুলো সব মেজদি করছিল, দিদি একেবারে নির্বিকার কিন্তু এতবার আসা যাওয়াতে হলের অন্য দর্শক বাজে মন্তব্য শুরু করল সুতরাং বিরিতির আগেই রণে ভঙ্গ দিয়ে মেজদি আর দিদি আমাকে নিয়ে সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে গেল। মেজদি কিছু বলেনি কিন্তু মুখ থমথমে ছিল আর দিদি আমাকে বকা দিয়ে আলু ভর্তা বানিয়েছিল সেদিন, মার দেয়নি বাসায় আব্বা ছিল বলে। আমার অবশ্য তাতে কিছুই যায় আসেনি কারণ আমার বেড়ানো আমি বেড়িয়েছি এবং খাওয়া দাওয়ারও কোন কমতি ছিল না, ওদের সমস্যা নিয়ে এত ভাবার সময় আমার কই? বাড়ি ফিরে এসেই খেলার মাঠে। এরপরে ওরা সিনেমা দেখতে গেলে দিদি মেজদির কাছে মেডিকেল কলেজে চলে যেত আর ওখান থেকে দু’জন মিলে চলে যেত সিনেমায়, আমি জানতেও পারতাম না।

পাড়ায় আমার একটা গ্যাং ছিল। যত ধরনের দুষ্টুমি করা যায় কিছুই বাদ যেত না। আমার বান্ধবির বড় বোন ছিল আমার সেজদির বান্ধবী। আমরা তখন সবে বুঝতে শিখেছি প্রেম বলে একটা ব্যাপার আছে এবং সেটা ভাল কিছু নয় বরং খুবই বাজে কিছু। একদিন দেখি বুলবুল আপা আর দিদি মিলে ছাদের এক কর্ণারে বসে কোন একটা বিষয়ে গল্প করছে। দিদি খুব বলছে আর বুলবুল আপা মন দিয়ে শুনছে। নার্গিস বলল যে, মনে হয় দিদি প্রেম করে এবং বিষয়টা আমাদের জানা খুবই প্রয়োজন এবং রহস্য উদ্ঘাটনের দায়িত্ব এসে আমার উপরে পড়ল। ভর বিকেলে আমি সোজা গিয়ে দিদিকে বললাম যে আমার ঘুম পেয়েছে ঘুমাবো, দিদি বলল ঘুমা গিয়ে, আমি বললাম কারেন্ট নেই গরম লাগে বাতাস কর, দিদি নিচে নেমে এসে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বাতাস করতে শুরু করল এখানে অত্যাশ্চর্য বিষয় হল যে সে আমাকে কোন ঝাড় দিল না এবং কোন প্রশ্ন করল না, তাদের গল্প চলতে থাকল। পরের দিন নার্গিস জানতে চাইল আমি কি কি উদ্ধার করেছি, শুনেতো আমি আকাশ থেকে পড়লাম কারণ বাতাস খেয়ে আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলাম অতএব প্রেমের কাহিনী কিছুই উদ্ধার হয়নি। নার্গিস গম্ভীর ভাবে আমাকে বলল, ‘তুই একটা ছাগল’ আমিও মাথা নেড়ে মেনে নিলাম সেটা।

আমার পতুলের বিয়ে, মেয়ে পুতুল আর ছেলে পুতুল দুটোই আমার। আমার বান্ধবি নার্গিস এসে আমার সাথে পুতুল খেলত। পুতুল বিয়ে দেবার ইচ্ছে হলে ওকে একদিন প্রস্তাব দিলাম যে মেয়ে পুতুলটাকে সে নিয়ে যাক এবং আমি বরযাত্রি গিয়ে বউ তুলে নিয়ে আসব। বান্ধবি সাথে সাথে রাজি, সাথে এও বলে দিলাম যে বরযাত্রি কে খাওয়াতে হবে কিন্তু। তাতেও সে রাজি। এখন আমি ভাবি কেমন মহা বদ ছিলাম, জোর করে খাওয়াও আদায় করে নিয়েছিলাম। নির্দিষ্ট দিনে বর সাজিয়ে, বউয়ের সব জিনিষপত্র গুছিয়ে নিয়ে একটা জুতার বাক্সকে গাড়ি বানিয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে আমি আর আমার আর অন্য দুই বান্ধবি মিলে বরযাত্রি চললাম। রাস্তায় দেখা আমার ছোট ভাই মানে ছোটদার সাথে, আরেকটা পাঁজি। সে বলল যে সে আমাদের সাথে বরযাত্রি যাবে আমাদের মুরুব্বি হিসেবে। আরো বলল যে সাথে বড় কেউ না গেলে বিষয়টা ভাল দেখায় না, বলে রাখা ভাল যে ছোটদা আমার থেকে ১২ বছরের বড়। আমি রাজি হয়ে গেলাম।

ছোটদা আমাদের সাথে চলল। পৌঁছে গিয়ে আমরা তিনজন ভেতর ঘরে চলে গেলাম বউ সাজাতে আর বসার ঘরে রয়ে গেল বর পুতুল আর সাথে আমার মুরুব্বি ছোটদা। বউ সাজিয়ে ফিরে এসে দেখলাম বর পুতুল গলায় দড়ি দিয়ে চেরারের হাতলের সাথে ঝুলে আছে, আমি অবাক হয়ে ছোটদার দিকে তাকাতে সে খুব গম্ভীর গলায় জানাল, ‘বউ পক্ষ এখনো কোন খাবার দিয়ে বা শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করেনি তাই বর অপমানিত হয়ে মনের দুঃখে গলায় দড়ি দিয়েছে’। আর কৈ যায়, সাথে সাথে আমি তারস্বরে চীৎকার করে কান্না আর মাটিতে গড়াগড়ি, আমার মাকে আসতে হয়েছিল সেই কান্না থামাতে। বিপদ দেখে ছোটদা কোন ফাঁকে কেটে পড়েছে। যাই হোক চোখ মুছে ভাল-মন্দ খেয়ে বর-বউ নিয়ে বিদায় নিয়েছিলাম সেদিন। ছোটদা সঙ্গ নিয়েছিল খাবার জন্য কিন্তু শয়তানি করতে গিয়ে বেচারার ভাগ্যে কিচ্ছু জোটেনি বরং মা এসে আমাদের সাথে খেয়েদেয়ে, আমার খালাম্মা তাঁর বান্ধবি মানে সাথে নার্গিসে আম্মার সাথে গল্প করে, পান খেয়ে বিদায় নিয়েছিলেন এবং যাবার সময় সবাইকে বৌভাতের দাওয়াতও করে গিয়েছিলেন। এসব ভাবনা এলে মনটা নির্মল আনন্দে ভরে যায়। সেই পিচ্চি আমি কবেই একটা আস্ত পতুলের মা হয়ে গিয়েছি অথচ তাকে আদর করার জন্য না ছিল আমার মা না ছিল আমার বাবা।

ছবি আঁকার মত অংকেও আমি লাড্ডু তাই অংকের জন্য আব্বা স্কুলের গনপতি স্যারকে রেখে দিলেন। স্যার আসেন অংক করান কিন্তু আমার মাথায় তো ঢোকে না। আমি বীজগণিতে এবং জ্যামিতিতে তুখোড় ছিলাম কিন্তু পাটিগণিত বিষয়টাই একদম ফালতু ছিল। পাটিগণিত বই শুরুর সুচীপত্র থেকে দাড়ি,কমা সহ প্রশ্ন এবং অংক সব আমার মুখস্ত ছিল। পরীক্ষার দিন টেনশনে সব ভুলে গিয়ে আমার সব অংকের এক উত্তর হয়ে যাচ্ছিল। অংকে আমি ৬৮ পেয়েছিলাম এবং সে নিশ্চিত বীজগণিত এবং জ্যামিতি থেকে।

এস,এস,সি পরীক্ষা শেষের আগেই নির্ধারিত হিয়ে গিয়েছিল যে আমি আর বরিশালে থাকব না, ঢাকায় চলে যাব এবং মেজদির কাছে থেকে পড়াশোনা করব। পরীক্ষা শেষে আব্বা জানালেন যে রেজাল্টের অপেক্ষার প্রয়োজন নেই, মেজদাকে বললেন আমাকে ঢাকায় পৌঁছে দিয়ে আসতে। সব কিছু গোছগাছ শুরু হল। হঠাৎ করে একদিন আমার পেটে প্রচন্ড ব্যাথা, অজ্ঞান হয়ে যাবার মত অবস্থা। মেজদা আমাকে নিয়ে হসপিটালে দৌড়। (চলবে)