শারমীন শরীফ : সে আর চিঠি লেখেনি, যোগাযোগ করারও কোন চেস্টা করেনি। সে যখন সকল যোগাযোগ বন্ধ করল তখন আমার কেমন ফাঁকা লাগতে শুরু করল। স্কুলে যাবার পথে আমার চোখ দু’টো তাকে খুঁজে ফিরতে লাগল কিন্তু সে কোথাও নেই। এই ঘটনার পরে থেকে আমার একা স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মেজদা সকালে আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে কাজে চলে যেত আর মা আসার পথে গিয়ে নিয়ে আসত। আমি কেমন ৪ দেয়ালে বন্দী হয়ে গেলাম। আমি তখন একা একা কাকে যেন খুঁজে ফিরি কিন্তু সে কোথাও নেই। আমার মাদার এই বিষয়ে একেবারে চুপচাপ ছিলেন তা কিন্তু নয় তিনি নীরবে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। মেজদার সাথে কোন একটা গোপন ষড়যন্ত্র হয়েছিল তাই একদিন রাতে বাড়ি ফিরে খেয়ে দেয়ে মেজদা আমাকে ডাকল বলল বাংলা লেখা একটা খাতা নিয়ে আসতে। আমিও হেলতে দুলতে আমার বাংলা খাতা নিয়ে মেজদার কাছে হাজির হলাম। এবার মেজদার পকেট থেকে একগাদা চিঠি বেরল। মেজদা ওগুলোকে বিছানার উপরে রেখে একটা একটা করে খুলতে লাগল আর আমার হাতের লেখার সাথে মেলাতে শুরু করল। আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। হতভম্ভ হয়ে আমি মেজদার হাতের দিকে তাকিয়ে আছি, এমন কি নিঃশ্বাসও নিচ্ছি না।
মেজদা দেখছে আর বলছে যে সে আজকে মনির ভাইয়ের বাড়িতে চড়াও হয়ে বলেছে ভালোয় ভালোয় সব চিঠি দিয়ে দিতে নাহলে সমস্যা হবে এবং মনির ভাই সব চিঠি দিয়ে দিয়েছে। আমাকে কেউ যেন আঠা দিয়ে আঁটকে দিয়েছে খাটের সাথে, উঠে যে দৌড়ে পালাব তাও পারছি না। কিছুক্ষণ হাতের লেখা মেলানোর পড়ে মেজদা বলল, ‘এগুলো কার হাতের লেখা? তোর সাথে তো মেলে না!’ আমি কোন মতে মিন মিন করে বললাম এটা রুনুর হাতের লেখা। মেজদা জানতে চাইল, ‘প্রেম কে করেছে? তুই না রুনু?’ এই প্রথম আমি হেসে ফেললাম, বললাম ‘আমি’। মেজদা জানতে চাইলো তাহলে সব হাতের লেখা রুনুর কেন? আমি বললাম যে ভয়ে আমি কোন চিঠি বাড়িতে আনতাম না এবং লেখারও সুযোগ হত না বলে রুনুই সব লিখত। মেজদা বলল আয় আমরা দু’জনে মিলে পড়ি কি লিখেছে রুনু। আমরা দু’ভাই-বোন মিলে আমার প্রেমের চিঠি পড়তে শুরু করলাম। মেজদা সিগারেট টানছিল, আমার দিকে সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলল ‘টানবি’? আমিও সাথে সাথে মেজদার হাত থেকে সিগারেট নিয়ে আড়ামসে কষে একটা টান দিলাম এবং খকখক করে কাশি শুরু হল। ঠিক এই সময়ে ক্যামেরার লেন্স দরজায় ঘুরলো, ওয়াইড এঙ্গেল জুম দড়জার দিকে এবং দড়জার পেছন থেকে গুটিগুটি পায়ে আমার মায়ের আবির্ভাব এবং এসেই মেজদাকে হুমকি, ‘তোর বোন তোর সামনে সিগারেট টানছে তুই দেখছিস না’? মেজদার ততোধিক নিরীহ উত্তর, ‘মা ওতো বিড়ি খাচ্ছে না, বেনসন খাচ্ছে বেনসন, কোন অসুবিধা নাই’, সিগারেট কিন্তু তখনো আমার হাতে। মা আর একটা কথাও না বলে ধুমধুম করে চলে গেলেন। মেজদা বলল যে সে টের পেয়েছিল মা দড়জার পিছনে দাঁড়িয়ে শুনছিল আমাদের চিঠি কাহিনী এবং তাকে ভাগাবার জন্য এই নাটক। বলেই ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে সিগারেট নিয়ে নিল। আমরা দু’জন মনযোগ দিয়ে চিঠি পড়তে শুরু করলাম। মেজদা পড়তে পড়তে জানতে চাইল যে এগুলো কার উর্বর মস্তিস্ক থেকে বেড়িয়েছে। আমি বললাম কিছু আমার কিছু রুনুর। চিঠি পড়তে পড়তে আমরা দু’ভাই-বোন হেসে গড়িয়ে পড়তে লাগলাম। সেই রাতে হঠাৎ করেই যেন আমার সব পাষাণ ভার যেন নেমে গেল, কেন এমন হয়েছিল আমি ঠিক বলতে পারব না।
আমার জীবনের প্রথম প্রেমের সমাপ্তি ওখানেই। এরপরে তাকে হাতেগুনে কয়েকবার মাত্র দেখেছি। আমার বিছানাটা ছিল জানলা ঘেঁসে। জানলাগুলো ছিল বিশাল এবং আড়াআড়ি মোটা রডের গরাদ দেয়া। ইচ্ছে হলেই কেউ হাত ঢুকিয়ে আমার ছুঁয়ে দিতে পারত এত কাছে ছিল খাটটা। মায়ের আদেশ জারি হল যে আর জানলা খুলে শোয়া যাবে না, ফোন ধরা যাবে না, ছাদে যাওয়া যাবে না, বাগানে একা যাওয়া যাবে না, কোথাও একা যাওয়া যাবে না। ‘না’ এর মাঝে বন্দী হয়ে গেলাম আমি। ভীষণ মন খারাপ হত আমার। আমাদের রাঁধুনি খালার মেয়ে নিরু আমার সমময়সী, তাঁকে আমার সঙ্গী করে দেয়া হল এবং সে ছায়ার মত আমার সাথে থাকত এবং ছোট আপা ছোট আপা করে আমার মাথা খারাপ করে দিত। তখন মাকে একদিন বললাম যে বই কিনব, দোকানে নিয়ে যাও। মা আমাকে বরিশাল সদর রোডে বইয়ের দোকেনে নিয়ে গেল। পাশাপাশি দু’টো বইয়ের দোকান ছিল। দোকানের নাম মনে নেই। আমি দোকানে ঢুকে মায়ের উপরে রাগ করে মনে হয় ২৫/৩০টা বই তুলে নিলাম। সেবা প্রকাশনীর অজস্র বই। সেবা প্রকাশনীর উপরে মনে হয় আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। মা সেদিন কোন প্রশ্ন না করে সব বইয়ের বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এল। রিকশায় দু’জনের পায়ের কাছে দড়ি দিয়ে বাঁধা পাইল করা বই। আমি সম্পূর্ণভাবে বইয়ের মাঝে ডুবে গেলাম। আমার বই পড়ার হাতে খড়ি হয়েছিল আমার মেজদির হাত ধরে। মনে আছে আমার যখন ৮/৯ বছর বয়স ও তখন আমাকে কিনে দিয়েছিল, রুশ দেশের উপকথা, মালাকাইটের ঝাঁপি, পেন্সিল ও সর্বকর্মার কাহিনী, চলন বিলের গল্প, তিতি-মিতি ও প্যাক-ম্যাকের গল্প এমন আরো কত মজার মজার বই। রুশ সাহিত্যের সাথে সেই আমার প্রথম পরিচয় এবং প্রেম। আমি আমার সব আনন্দ যেন বই থেকে শুষে নিতে থাকলাম। মনে আছে ড্রাকুলা পড়ে এমন ভয় পেয়েছিলাম যে বালিশের নীচে রসুন নিয়ে ঘুমাতে যেতাম।
আবার একটু ছোট বেলায় ফিরে যাই, আমি যখন ক্লাস টু বা থ্রী তে পড়ি তখন আব্বা গানের মাস্টার রেখে দিয়েছিলেন। অসিত বাবু স্যার। ৫ দিন বিকেলে পান চিবুতে চিবুতে আসতেন ৫টার দিকে। তখন বাসার সামনে মাঠে জমজমাট খেলা চলছে। আমি হারমোনিয়াম নিয়ে প্যাঁ প্যাঁ করতাম আর মাঠের দিকে চাইতাম। স্যার বুঝতে পেরে গেলেন কয়েকদিনে। বসার স্টাইল ঘুরে গেল আমি জানলার দিকে পিঠ দিয়ে বসতাম। কিন্তু মনের কি হবে? আমি যে মানসপটে দেখতে পেতাম সব। কোন মনোযোগ ছিল না গান শেখার প্রতি। স্যার পড়া দিয়ে যেতেন, পরের দিন পড়া ধরলে আমি কিচ্ছু পারতাম না। কারণ স্যার বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতাম তারপরে চোখের পলকে আমি খেলার মাঠে। হয়ত খেলা তখন মাঝ পথে এবং তখন আমাকে নেয়া যাবে না এবং আমাকে অগ্রায্য করে খেলা এগিয়ে চলছে, কিন্তু আমার তো সেই ধৈর্য্য নেই, তাই আমি কোচড় ভরে মাটির ঢেলা কুড়িয়ে জড় করতাম এরপরে ওদের দিকে ঢেলা ছুড়তে শুরু করতাম। দমাদম ওদের পিঠে গিয়ে পড়ত। বন্ধুরা তখন রণে ভঙ্গ দিয়ে মাঝ পথে খেলা বন্ধ করে দিয়ে আমাকে বকতে বকতে আবার শুরু থেকে শুরু করত খেলা।
আমার গানের চর্চা কোনমতে ১ মাসে গিয়ে ঠেকল। স্যার প্রতিদিন আব্বা কে নালিশ করতেন যে আমি কিচ্ছু পারি না। যেটা প্র্যাক্টিস করতে দিয়ে গিয়েছিলেন সেটা না পারলে খুব বকতেন, বলতেন আমি গান নিয়ে নাকি ফাজলামি করছি। আমার কাছে আজব লাগত, গান নিয়ে আবার ফাজলামি করে কি ভাবে? প্রতিদিন দেখতাম আব্বার মুখটা গম্ভীর। পরে এমন হতে শুরু কলল যে স্যার চলে যাবার ঠিক আগখানে দৃশ্যপটে আব্বার আগমন এবং স্যার বিদায় নেবার পরে আমাকে কি হোম ওয়ার্ক দিল সেটা আব্বা দেখ্তেন এবং বলতেন, ‘তুমি এটা এখনি প্র্যাক্টিস করে ফেল।’ কি যন্ত্রণা! আমি সেই আরো এক ঘন্টা হারমোনিয়মের মধ্যে আঁটকে থাকতাম এবং গানের উপরে ভীষণ রাগ করতাম। অবশ্য এমন করে আরো এক মাস যাবার পরে একদিন গুঁতাগুঁতি করে ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী,’ গানটা হারমোনিয়ামে তুলে ফেলেছিলাম। আমি যখন একাএকা একদিন গানটা গাইছিলাম আব্বা এসে জানতে চেয়েছিলেন যে এটা অসিত বাবু শিখিয়েছেন কিনা? আমি বলেছিলাম যে একা একা শিখেছি, সেদিন আব্বার কি খুশি। আব্বার উৎসাহ যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। আব্বা সেদিন আমার জন্য শশির দোকানের মিষ্টি কিনে আনলেন গিয়ে। কিন্তু বিধি বাম। অসিত স্যারের অনবরত নালিশে আব্বা একদিন রাগ করে স্যারকে পুরো মাসের বেতন দিয়ে বলেছিলেন আর আসতে হবে না এবং আমার কান মলে দিয়েছিলেন। মায়ের পিটুনিকে মনে হত মশার কামড়, মায়ের পিটুনি খেয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে ভেগে যেতাম, অবশ্য অধিকাংশ সময়ে মা আমাকে ধরতেই পারতেন না তো মারবেন কি। কিন্তু আব্বা কখনো আমাকে মার দেয়া তো দুরের কথা বকা পর্যন্ত দেননি তিনি আমার কান মলে দিয়েছেন, আমি ব্যাপারটা হজম করতে পারলাম না। আমি মেজদির রুমে গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলাম। মেজদির তখন মেডিকেল কলেজের সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। সারাক্ষণ পড়াশুনা নিয়ে ব্যাস্ত। আমার কান্নাকাটি দেখে একটু মায়া হয়েছিল হয়ত। উঠে এসে চোখ মুছিয়ে একটা অরেঞ্জ লজেন্স দিয়ে বলল আর কাঁদিস না। আমি কান্না বন্ধ করলাম বটে কিন্তু রুম থেকে আর বেরোলাম না সেদিন এবং কোনভাবেই আব্বার সামনে পড়লাম না। পরে শুনেছি আব্বা নাকি অনেক মন খারাপ করেছিলেন এবং কেঁদেছিলেন সেদিন এবং রাতে ভাত খাননি কারণ অনেক সাধ্য সাধনার পরেও আমি রাগ করে ভাত খাইনি সে রাতে। (চলবে)