Home কলাম নানান রঙের দিনগুলি-২০

নানান রঙের দিনগুলি-২০

শারমীন শরীফ : আমার বন্ধু আদিত্যকে,
শুরু হল আমার ঢাকা পদাতিকের সাথে পথচলা। বিষাদসিন্ধুর একটি নারী চরিত্র কোন কারণে কাজ করতে পারছিল না, সাথে সাথে মিজান ভাই আমাকে সেই চরিত্রে ঢুকিয়ে দিলেন। আমি হয়ে উঠলাম বিষাদসিন্ধুর অংশ, এই ম্যাজিকের অংশ । আহা! কি অসাধারণ ছিল সেই দিনগুলো। রোজ সন্ধ্যায় টিএসসি তে চলত আমাদের মহড়া। রোজার দিনে স্যার আমাদের একটু লম্বা বিরতি দিতেন, কেউ যদি রোজা করে থাকে এই ভেবে। আমরা একসাথে সব দৌড়াতাম মামুর দোকানে খেতে। মামু একটা বিরাট গামলা দিত আর সেই গামলায় থাকত মুড়ি, পিয়াজু, ছোলাবুট, বেগুনি। বিষাদসিন্ধুর গাতক, পার্থ সারথী রুদ্র, অসাধারণ তাঁর গানের গলা। পার্থদা যখন “প্রথমে বন্দনা করি সৃষ্টিকর্তা পরম প্রকৃতিরে,”- বলে টান দিতেন তখন মনে হয় পুরো দলের রক্ত টগবগ করে উঠত আর আমরা সবাই মিলে একটি অসাধারণ গল্প ধীরে ধীরে মেলে ধরতাম দর্শকদের সামনে। আমি বিশ্বাস করি, এটাই ছিল আমাদের “সিক্রেট টনিক”।

পার্থদা শেষ করলেই আমাদের মার্টিনদা (জন মার্টিন) শুরু করতেন গল্প বলা, তাঁর সম্মোহনী স্বরে। কি অদ্ভুত ছিল সেই গল্প বলার প্রক্রিয়া, মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মত ঢুকে যেত ঘটনার মধ্যে। বিষাদসিন্ধুর সেটটা ছিল ব্যতিক্রমী, দর্শক বসার চেয়ারগুলো গোল করে সাজান হত আর পুরো মধ্যেখানটায় চলত অভিনয়। দর্শকদের গল্প বলতে বলতে আমরা দেখতাম তাঁদের আনন্দ, দুঃখ, কান্না। সে এক অসাধারণ অনুভূতি। আমাদের পার্থদার দ্বায়িত্ব থাকত সেই গামলায়, পিয়াজ, লংকা আর সর্ষের তেল দিয়ে পুরো জিনিষটা মাখানো। আমরা ৩০/৩৫ জন মানুষ গোল হয়ে বসে সেই এক গামলা থেকে তুলে নিয়ে খেতাম। কুমকুম আপা (মাহবুবা হক কুমকুম) দুইমুঠা মুড়ি মুখে দিয়েই চেঁচাতে শুরু করতেন চায়ের জন্য, কারণ তখন চায়ে চুমুক না দিলে পরে আর চা খাবার সময় পাওয়া যাবে না এই ভেবে।
বিষাদসিন্ধু তে লাঠি খেলা ছিল একটা প্রধান অংশ জুড়ে, শুরু হল আমার লাঠিখেলা শেখা। স্বপন আমাকে লাঠি খেলা শেখাতে শুরু করল, প্রত্যেকদিন বিকেলে, রিহার্সাল শুরুর আগে আমাকে ১ ঘন্টা লাঠি খেলা প্র্যাক্টিস করতে হত পুরো টিমের সাথে। এটা কোন ফাজলামি লাঠি খেলা ছিল না, একেবারে অকৃত্রিম লাঠি খেলা। এমনভাবে সেটা সাজানো ছিল যে, শো চলাকালীন কারো হাত থেকে লাঠি পড়ে গেলে পুরো টিম বিপদে পড়ে যাবে। লাঠিয়ালদের লাঠিখেলা থেকে জামিল স্যার পুরোটা কোরিওগ্রাফ করেছিলেন। লাঠিখেলা শিখতে গিয়ে প্রায় সবাইকেই হাতে অপরপক্ষের বাড়ি খেতে হয়েছে, প্রায়ই হাত ফোলা থাকত আমাদের। প্র্যাক্টিসের সময় আমার হাত থেকে লাটি পড়ে যেত প্রায়ই, আর ভীষণ ধমক খেতাম। কিন্তু এখানে ভুল করার কোন জায়গা ছিল না।

নিখুঁতভাবে লাঠি খেলতে পারলে সে বিষাদসিন্ধুতে কাজ করবে আর না পারলে বিদায়। কিন্তু আমি জানিনা হার কি করে মানতে হয় তাই অচীরেই শিখে ফেললাম। আমি পাঁচ ফিট দুই ইঞ্চি একটা মানুষ আর আমার অপরপক্ষ হয়ত ছয় ফিট লম্বা। লাঠি খেলা যেখানে শেষ হত সেখানে এক পক্ষ সর্বশক্তি দিয়ে দু’হাতের মাঝখানে বাড়ি দেবে আর অন্য পক্ষ লাঠি মাথার উপরে তুলে বাড়ি ঠেকাবে । আমি ছিলাম বাড়ি খাওয়ার দলে আর ওপাশে ছিল বিপ্লব যে কিনা ছয়ফুটেরও বেশী লম্বা। বিপ্লব যখন আমার মাথার উপড়ে বাড়ি দিত আমার মনে হত আমি রুখতে পারব না, বাড়ি সত্যি সত্যি মাথায় পড়বে। ফেইক করলে স্যার বুঝে যেতেন যে বিপ্লব আমাকে মায়া করে জোরে মারছে না এবং শাস্তি পেত বিপ্লব, আমি না! অতএব মায়া দয়া ভুলে গিয়ে বিপ্লব সর্বশক্তি দিয়ে বাড়ি দিত। আমিও ঠেকাবার কৌশল শিখে গেলাম ধীরে ধীরে এবং লাঠি খেলায় পাঁকা হয়ে উঠলাম। এই প্রক্রিয়ার মাঝে কখন যেন আমি, দেবাদা দেবাশীষ ঘোষ, শাহরিয়ার রিন্টু, কিরিটী রঞ্জন বিশ্বাস, টিসা আর স্বপন সৈয়দ, আমরা হয়ে উঠলাম হরিহর আত্মা।

এদিকে আতিক হঠাত করে গায়েব, ওকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, পরে জানতে পারলাম সে কাউকে কিছু না বলে পুনায় চলে গিয়েছে ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য। মুনিরও ব্যাস্ত হয়ে গেল নিজের প্রিন্টিং বিজনেস নিয়ে। সেলিম ব্যাস্ত মিলিকে নিয়ে, শিমুও আশিস খন্দকারের সাথে কাজে ভিড়ে গেল। আমি ব্যস্ত হয়ে গেলাম বিষাদসিন্ধু নিয়ে। কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল সব। ওদের কাউকে আর তেমন খুঁজে পেতাম না আগের মত। নাটক নিয়ে বাসায় অনেক ঝামেলা হত, তাছাড়া রিহার্সাল শেষ হত রাত এগারোটায়, তখন একা একা উত্তরায় যাওয়াও সম্ভব ছিল না। আমি আব্বার পরামর্শে হলে উঠে গেলাম। মেজদা ঢাকায় এসে আমাকে নিয়ে গেল নীলক্ষেতে। আমরা ভাইবোন মিলে তোষক, বালিশ, চাদর, লেপ, মশারি ইত্যাদি কিনে এনে একদিন এসব কিছু নিয়ে হাজির হলাম হলে। আমি সব কিছু রুমে রেখে বাইরে এলাম মেজদার কাছে বিদায় নিতে। মেজদা কেঁদে ফেলল সাথে সাথে আমারও সব বাঁধ ভেঙ্গে গেলে আমিও কেঁদে ফেললাম। আসলে মেজদার খুব কষ্ট হচ্ছিল আমাকে একা হলে রেখে চলে যেতে। আব্বাও যে খুশি ছিলেন তা নয়। বরং সব থেকে কষ্ট পেয়েছিলেন আব্বা।

আব্বা জানতেন হলের খাবার ভাল নয়, আর আমিও কোনদিন একা এভাবে থাকিনি, এই নিয়ে আব্বা সারাক্ষণ অস্থির থাকতেন। আমি আব্বাকে বোঝাতাম যে আমার কোন কষ্ট হচ্ছে না। কেউ যখনই ঢাকায় আসত আব্বা তাঁর হাতে একগাদা খাম পাঠিয়ে দিতেন আমার জন্য এই আশায় যে আমি প্রতি সপ্তাহে একটা চিঠি পাঠাব আব্বাকে, যথারীতি ঠিকানা লেখা ও ডাকটিকিট লাগানো। আমি চেস্টা করতাম প্রাণপণ হলের পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে। যেদিন রিহার্সাল থাকত না সেদিন সন্ধ্যায় খুব কষ্ট হত, সন্ধ্যার পরে যখন হলের গেট বন্ধ হয়ে যেত তখন খুব খারাপ লাগত।

হলে এসে শুরু হল আরেক ঝামেলা। প্রায় প্রতিদিন অতরাত পর্যন্ত বাইরে থাকার অনুমতি নিতে হবে, নাহলে রাত ১১টায় আমাকে হলে ঢুকতে দেবেনা। রেবু আপা তখন শামসুন্নাহার হলের প্রভোষ্ট আর আপার বড় ছেলে আদিত্য (আদিত্য কবির) ছিল আমাদের খুব ভাল বন্ধু। আমি আদিত্যকে ধরেছিলাম আমাকে সাহায্য করবার জন্য। আদিত্য সরাসরি গিয়ে আপাকে বলল আমাকে একটা পার্মিশন স্লিপ লিখে দেবার জন্য। রেবু আপার কোন যুক্তিই ধোপে টিকল না, আদিত্যর কাছে আপা পরাজয় মেনে আমাকে পার্মিশন স্লিপ লিখে দিলেন এবং সাথে আদিত্যকেও প্রমিস করতে হল যে রিহার্সাল শেষে নিরাপদে আমাকে হলে ঢুকিয়ে দিয়ে তবে ওর মুক্তি। তাই যতক্ষণ আমি রিহার্সালে থাকতাম আদিত্য টিএসসির মাঠে বসে থাকত, শেষ হলে আমাকে হলের ভেতরে পাচার করে তবে মিলত ওর মুক্তি। ওর প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই আমার।

আমি ৯৬ তে দেশের বাইরে চলে আসার পরে সবার সাথে যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম, তেমনি আদিত্যর সাথেও আর যোগাযোগ হয়নি। আমার সেই পরম বন্ধু আর আমাদের মাঝে নেই। হঠাত কোন খেয়ালে কোন এক মাঝরাতে প্রকৃতির মনে হল যে আদিত্যকে এই জগতে তাঁর আর প্রয়োজন নেই। যেই কথা সেই কাজ, এক ম্যাসিভ স্ট্রোকে প্রকৃতি আমার বন্ধুকে তাঁর আপন করে নিলেন। আদিত্য আমাদের কাছ থেকে নেই হয়ে গেল। আমি জানি না রেবু আপা কি করে এই ধাক্কা সামলেছেন। আদিত্য চলে যাবার পরে অভীকের সাথে কথা হয়েছে, ওঁরা সবাই এলোমেলো হয়ে গিয়েছে, কি বলেছিলাম আভিকের সাথে মনে নেই, মনে আছে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম অকৃতজ্ঞতার কষ্টে। আমি মনে রাখিনি আমার বন্ধুকে, যোগাযোগ রাখিনি, সেও কোন অভিযোগ করেনি। অত্যন্ত নিরিবিলি একটা মানুষ আদিত্য নিরিবিলিতেই চলে গিয়েছে।

Exit mobile version