শারমীন শরীফ : গ্রীষ্মের ছুটিতে আমাদের পিকনিকের দিন ধার্য্য হয়েছিল। কি অপূর্ব মিষ্টি একটা সকাল ছিল সেদিন। ঝকঝকে রোদ চারিদিকে, মনে হচ্ছিল একবাটি রোদ চামচ দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাই। অকারণেই মনে সে কি অস্থিরতা, ভয়। একা একাই প্রেমে পড়ে মরে যাচ্ছিলাম অবস্থা। আমাকে বলা হয়েছিল ৪টা ডিম, আলু, পিয়াজ আর ১ কেজি চাল নেবার জন্য। আমেনা খালা আমাদের রাঁধুনি সে সুন্দর করে ঘুছিয়ে সব একটা ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিল, বাকি রইল শাড়ি। আমি যেহেতু স্কুলে যাবার আগে বান্ধবীর বাড়িতে প্রথম যাব এবং বড় ভাই ছুটির দিন বলে নিশ্চিত বাড়িতে থাকবেন বলে আমার ধারণা তাই তার চোখে পড়ার সাধ হল। আমি সালোয়ার, কামিজ ছেড়ে শাড়ি পড়ে ফেললাম, আর কামিজ ব্যাগে নিয়ে নিলাম। সাজুগুজু করে সব নিয়ে বান্ধবীর বাসায় যাবার জন্য প্রস্তুত। ফুরফুরে মেজাজে, হাওয়া খেতে খেতে আমি বান্ধবীর বাড়ির দরজায়। আমাকে দেখেই সে এক বিকট চীত্কার আর বকা, ‘তুই কি কানের মাথা খেয়েছিলি যে শাড়ি পড়ে এসেছিল? কি বলেছিলাম তোকে, শাড়ি পড়ে কেন এসেছিস তুই’? বান্ধবী তো চেঁচিয়ে যাচ্ছে আর আমি কান বন্ধ করে ছোট ছোট চোখ দু’টোকে বড় বড় করে ভাইকে খুঁজছি, এদিকে সেদিকে কিন্তু সে কোথাও নেই। বান্ধবী আমাকে বলল যা চেঞ্জ করে শাড়ি ব্যাগে ভরে নিয়ে আয়।

আমি যেতে যেতে মিন মিন করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাইয়া কই রে’? বলল, ‘ভাইয়া ছুটিতে ঢাকায় গিয়েছে, রিকশা আনতে ভাইয়াকে লাগবে না, তুই যা চেঞ্জ কর আমি রিকশা ডাকছি’। পিকনিকের উপরে আমার ঘেন্না ধরে গেল সাথে সাথে, রৌদ্রজ্জ্বল দিনটা কেমন ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেল পলকে, ধ্যাত্তেরিকা বলে আমি চেঞ্জ করতে চলে গেলাম। সারাটা দিন মন ভারি হয়ে রইলো। ফুলকপির বড়া পুড়িয়ে ফেললাম, গরম তেলের ছিটে লেগে হাত পুড়ল। সব শেষে আবার যখন শাড়ি পড়ার সময় এল তখন মেজাজ যা খারাপ হয়েছিল কি বলব। শুধু তাই নয় সক্কাল বেলা শাড়ি পড়ে গিয়েছিলাম সেটা নিয়ে সবাই আমাকে পচাল। বড় ভাই আমাকে দেখলে শাড়ি পড়া নিয়ে পচানোটা তেমন গায়ে মাখতাম না কিন্তু সবদিক থেকে ষোলআনাই লোকসান হল আমার। বড় ভাইয়ের চোখে আমার পড়া হয়নি কিন্তু অন্য একজনের চোখে পড়ে গিয়েছিলাম। আমাদের স্কুলটা ৩ মাইল দূরে ছিল। আমরা সব বান্ধবীরা হৈ হৈ করতে করতে হেঁটে স্কুলে পৌঁছে যেতাম। ফেরার পথেও তাই। রিকশা খরচের পুরো টাকাটাই চালতা আর তেতুলের আচারের পেছনে যেত। সে কখন কোথায় আমাকে দেখেছিল জানি না কিন্তু হঠাত একদিন সে আত্মপ্রকাশ করল।

আমাদের বাড়িটি একতলা ছিল, সাদা রংয়ের একটা বাড়ি। বাড়ির সামনে দেয়ালে লাগানো ‘শরীফ বাড়ি’, বাড়ির দু’পাশে বিরাট দু’টো আমড়া গাছ। সামনে অনেকটা জায়গা যেখানটায় খুব সুন্দর একটা বাগান ছিল। রজনিগন্ধা, বেলি, দোলনচাঁপা, হাসনাহেনা আরো কত ফুলের গাছ ছিল সেখানে। সব থেকে সুন্দর ছিল ঠিক গেটের কাছে দেয়াল ঘেসে একটা বড় কামিনি ফুলের গাছ। সাদা সাদা ফুলে ভরে থাকত গাছটা। রোজ সকালে উঠে দেখতাম ফুল ঝরে গেটের কাছটা সাদা হয়ে আছে যেন কোন অতিথীকে আপ্যায়নের জন্য ফুল বিছানো হয়েছে পথে। আমি খুব ভোরে উঠে খালি পায়ে সেই ফুলের উপরে হাটতাম। কিশোরী বয়সে তখন মনে হয় সব কিছুতেই ভাললাগা খুঁজে পেতাম। তেমনি এক ভোরে আমি খালি পায়ে যখন মগ্ন হয়ে ঝরা কামিনীকে ধন্য করছি তখন হঠাত পায়ের কাছে কিছু একটা এসে পড়ল।
তাকিয়ে দেখি একটা ম্যাচ বক্স। চট করে রাস্তায় তাকিয়ে দেখি একটা রিকশা চলে গেল, কেউ একজন বসা সেখানে কিন্তু তাঁর চেহারা দেখতে পেলাম না। আমি ম্যাচবক্স খুলে দেখি সেখানে সুন্দর করে ভাজ করা একটা কাগজ, খুলে দেখি একটা চিঠি। ধক করে উঠল বুকের মধ্যে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম কেউ দেখছে কিনা। চিঠিটা লুকিয়ে ফেললাম। তড়িঘড়ি রেডি হয়ে স্কুলে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে প্রিয় বান্ধবীর সাথে মজা করে চিঠি পড়লাম। শুরু ছিল ‘প্রিয়তমেষু’ দিয়ে আর শেষ ছিল ‘তোমার আমি’ এরকম কিছু একটা দিয়ে, ইতিতে কোন নাম ছিল না। প্রথমে খুব একচোট হাসলাম বান্ধবীরা মিলে। চিঠির মালিক কে তখনো জানি না কিন্তু বুঝেছিলাম সে অনেক শরত্চন্দ্র ভক্ত ছিল কারন পুরো চিঠিতে কোথাও ‘ছ’ খুঁজে পাইনি। ‘চ’য়ের অত্যাচারে ভরা ছিল চিঠিটা। যেমন খেয়েচি, গিয়েচি, করেচি এইসব। তখন আমার শরত্চন্দ্রের সব উপন্যাস পড়া সারা। সাথে সাথে বুঝলাম সেও অনেক শরত্চন্দ্র পড়ে। এরপরে শুরু হল আমাদের গোয়ান্দাগিরি, কে সে জানতে হবে! অবশ্য বেশিদিন অপেক্ষা করতে হল না পায়ের তলায় আবার চিঠি।

এবার সে রিকশায় ছিল না হেটে হেটে যাচ্ছিল অতএব এবার বুঝতে পারলাম সে কে? আমার প্রতিবেশী বাড়ির এক ব্যাচ সিনিয়র বান্ধবীর ভাইয়ের বন্ধু সে এটুকু জানি। আমাদের বাড়ি ঘেঁষে পাশের যে বাড়ি সেখানে থাকত আমার আরেক বান্ধবী রুনু। ওর শোবার ঘর থেকে আমাদের বাগানটা দেখা যেত। এই চিঠি লেনদেনের নীরব চিত্রের সাক্ষী হয়ে গেল এবার সে। আমরা যখন স্কুলে যাচ্ছি ও তখন আমাকে জিজ্ঞেস করল মনির ভাই কি দিয়েছে আমাকে? আমি বললাম চিঠি, স্কুলে গিয়ে দেখাব বললাম। স্কুলে যাবার পড়ে দুইটা চিঠিই ওকে দেখালাম। বান্ধবী জিজ্ঞেস করল আমি উত্তর দিতে চাই কিনা আমি বললাম চাই এবং সে দায়িত্ব নিল ডেলিভারি দেবার। ওকে বললাম সন্ধ্যাবেলায় আমাদের বাসায় আসতে। বিকেলে সবাই যখন ভাতঘুমে ব্যাস্ত তখন আমি আর বান্ধবী খাতা কলম নিয়ে ছাদে চলে গেলাম।

দু’জনে বসে অনেক কাহিনী করে হাসাহাসি করে উত্তর লিখলাম। একবার ভাবলাম আমিও ‘গিয়েচি, এয়েছি’ এভাবে লিখব কিনা কিন্তু এই চিন্তা একেবারে ঝেড়ে ফেললাম। বান্ধবী রুনু চিঠি নিয়ে চলে গেল। শুরু হল অপেক্ষার পালা। পরেরদিনই উত্তর পেয়ে গেলাম। আমার উত্তর পেয়ে সে অনেক উদ্বেলিত। এবারে শরত্চন্দ্রের বাণে ভেসে গেল চিঠি। নিয়ম হল আমি আর রুনু চিঠি পড়ব একসাথে এরপরে উত্তর কি লিখব ঠিক করে ওকে চিঠি দিয়ে দেব এবং ও আমার হয়ে উত্তর লিখে পাঠাবে কারণ প্রথম চিঠি নিয়ে বাসায় অনেক ঝামেলা হয়েছিল। প্রথম চিঠি আমি ছিড়ে বাথরুমে ফেলে দিয়েছিলাম। তখন তো আর কমোড ছিলনা যে ফ্লাস করে দেব তাই ছেড়া টুকরোগুলো ভেসে ছিল। আমার গোয়েন্দা মা কিছু বুঝে ফেলল, আমাকে চেপে ধরল আমি ওখানে কি ফেলেছি তাই নিয়ে। আমি পৃথিবীর নিরীহতম চেহারা বানিয়ে মা’কে জানালাম যে আমি কিছু জানি না। মা এই নিয়ে বাড়ি তোলপাড় করে ফেলল। বুঝে গিয়েছিলাম এই চিঠি বাসায় রাখা যাবে না তাই সব রুনুর কাছে পাচার করে দিলাম। এরপর থেকে আর ম্যাচবক্সে চিঠি আসত না, আসত রুনুর হাতে। আমাদের সিস্টেম খুব সুন্দর চলতে লাগল। মাঝে মাঝে এমনও হত যে আমার কিছুই বলতে হত না, রুনু নিজেই গুছিয়ে উত্তর লিখে দিত আমার হয়ে। (চলবে)