শারমীন শরীফ : আব্বা একদিন জিজ্ঞেস করলেন আমি নিয়মিত চিঠি লিখি না কেন, কারণ আমি সপ্তাহে আব্বার একটা চিঠি পেতাম আর বিনিময়ে আমি ২ মাসে একটা চিঠি পাঠাতাম। আমি আব্বা কে পালটা প্রশ্নম করলাম, ‘কোথায় খাম পাব, স্ট্যাম্প পাবো, তারপরে ঠিকানা লিখতে হবে। অনেক কাজ আব্বা।’ আব্বা আর কিছু বললেন না।

আমার কাছে আব্বার গ্রামের বাড়ি যাবার সিদ্ধান্তটা সব থেকে ভাল সিদ্ধান্ত মনে হয়েছিল। চাচাদের সাথে আমার তেমন পরিচয়ই ছিল না। বাড়িতে আসার পরে আমার চাচাদের সাথে নতুন করে পরিচয় হল। বড় চাচার বয়স তখন নব্বইএর উপরে কিন্তু তখনও তিনি সালিশি করতেন, তখনো তাঁর মগজ ছুরির ফলার মত চকচকে ছিল। গ্রামের পঞ্চায়েতি এবং চেয়ারম্যানি ছিল আমার চাচাদের একচেটিয়া। বড় চাচা ইস্তেফা দেবার পরে সেজ চাচা দায়িত্ব নেন। মাঝাখান থেকে মেজ চাচা এসবেরম মধ্যে জড়াননি। ভীষণ এক রাশগম্ভীর মানুষ ছিলেম মেজ চাচা, ভীষণ ভয় পেতাম। একমাত্র এই চাচার সাথেই আমার বন্ধুত্ব হয়নি। যাই হোক আমি বড় চাচার পাশে বসে দেখতাম তিনি কি করে বিচার-আচার করেন। অবাক হয়ে দেখতাম তাঁর সুক্ষ বুদ্ধির কাড়িগরি।

আব্বা বাড়িতে যাবার পরে আমাদের দরজায়ও আব্বার কাছে লোক আসতে শুরু করেছিল বিচারের জন্য। আব্বা মৃদু হেসে তাঁদের কে বলতেন, ‘বড়মিঞাঁর কাছে যাও’। বড় চাচাজান আব্বাকে বলেছিলেন মাঝে মধ্যে সালিশি করতে কারণ সেটা আব্বাকে ব্যাস্ত রাখবে আব্বা হেসে বলেছিলেন, ‘ম্যাবাই ওয়ালির মা’কেই কোনদিন আমার বুদ্ধি নিতে দেখলাম না, তো গ্রামবাসী! বরং আপনে ওলির মায়েরে বলেন সালিশি করতে। সে যদি ওকালতি পড়ত তাইলে আর কারোর ভাত জুটত না।’ মায়ের জন্য গর্বে আমার বুক ভরে গিয়েছিল, আব্বার জন্যও গর্ব হয়েছিল। সেইযুগে নিজের স্ত্রীকে এতবড় কমপ্লিমেন্ট দেবার জন্য বুকের পাটা লাগত।

আমার মায়ের মত সাহসী মহিলা আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। কোনকিছু ভয় পেতেন না তিনি। আমি তখন আরো অনেক ছোট। একবার গ্রীস্মের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছি মায়ের সাথে, জমিজিমা বর্গার হিসেব, নিকেশের জন্য। বাড়ির ধান, চাল, নারকেল, সুপারি, জমি বর্গা দেয়া এগুলো সব মা করতেন। আব্বা এসবের ধারে কাছেও ছিলেন না। আমাদের বাড়িটি মানে দাদাজানের ভিটা তখনো নতুন করে তৈরি হয়নি। সোবাহান ভাই (বাড়ির কেয়ারটেকার) তাঁর পরিবার নিয়ে থাকতেন ওই বাড়িতে আর সব কিছু দেখাশোনা করতেন। আমরা গেলে নজরুল দাদুর বাড়িতে থাকতাম।

ওই বাড়িতে বলতে গেলে একটা রুম প্রায় আমাদের জন্য বরাদ্দ ছিল। একদিন রাতে মা আর আমি ঘুমাচ্ছি, হঠাৎ জেগে উঠলাম মায়ের ধাক্কানিতে। ফিসফিস করে বললেন বাইরে তাকাতে। অন্ধকারে দেখি কালো মিশমিশে দুইটা পা আমাদের খাটের পাশের জানলা বেয়ে দোতলায় ওঠার চেস্টা করছে। মা বললেন, ‘মনু আমি এক, দুই, তিন বলার সাথে সাথে একটা ঠ্যাং চেপে ধরবি’। আমরা মশারির ভেতর থেকে বাইরে এলাম। মায়ের তিন গোনা শেষ হলেই আমরা দুজনে চোরের দুটো পা শক্ত করে জানলার সাথে চেপে ধরে একসাথে চেঁচাতে শুরু করলাম, চোর চোর চোর। বেচারা চোর অনেক কষ্টে আমাদের হাত ছাড়িয়ে ধপাস করে মাটিতে পড়ে উঠে চোঁ চোঁ করে দৌড়।

আমাদের চিৎকারে পুরো বাড়ি জেগে উঠল। ভাবি বার বার জিজ্ঞেস করলেন, ‘চাচিআম্মা আপনার ভয় করল না?’ মা বললেন এই কাহিনী নতুন কিছু নয়। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। এমন ভুরিভুরি গল্প আছে মাকে নিয়ে। এই বয়সে এসে মা কিছুতেই গ্রামে থাকতে চাইতেন না। সন্ধ্যার পরে নিষঙ্গ লাগত তাঁর। আব্বার সাথে কত আর গল্প করবেন? গ্রামের মানুষ সন্ধ্যা আটটার মধ্যে ঘুমিয়ে যেত। মা মিস করতেন টিভিতে নাটক, সিনেমা এইসব। তাই রাত হলেই মায়ের ‘Sundown syndrome’ শুরু হত, অস্থির হয়ে যেতেন। অনেক পাওয়ারের একটা টর্চলাইট সব সময় মায়ের হাতে থাকত। মা প্রায়শই আব্বাকে বলতেন তিনি গ্রামে থাকতে চান না। আব্বা বলতেন ছেলে, মেয়েদের সাথে গিয়ে থাকবার জন্য, মা যেতেনও কিন্তু মা এও জানতেন যে তিনি অনেক লম্বা সময় ধরে বাড়িতে না থাকলে আব্বার কষ্ট হয় তাই ফিরে আসতেন তাড়াতাড়ি। তখন বুঝিনি কিন্তু এখন বুঝি যে আমার মায়ের কত কষ্ট হয়েছে তখন পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে। বেচারা মা আমার!

আমার ফিরে যাবার সময় ঘনিয়ে এল। যাবার আগেরদিন আব্বা এক বান্ডিল ছোট্ট হলুদ রঙয়ের একগাদা খাম রাবারব্যান্ড দিয়ে আটকানো আমার হাতে দিলেন। হাতে নিয়ে দেখি প্রায় পঞ্চাশটার মত খাম এবং সব খামে টু অ্যান্ড ফ্রম ঠিকানা লেখা সাথে স্ট্যাম্প লাগানো। আব্বা বললেন, ‘মনু এবার কষ্ট করে এক লাইনে তুমি ভাল আছ লিখে প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি আমাকে পাঠিও। খাম শেষ হয়ে গেলে আমাকে জানাবে, আমি আবার খাম পাঠিয়ে দেব।’

আমার চোখে পানি চলে এল, আমি আব্বাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। এমন ভালবাসা আর কোথায় পাওয়া যায়? যায় না, যায় না! আমি আর পাইনি! মা, বাবাকে হারানোর পর থেকে ভালোবাসা খুঁজতে খুঁজতে একটা জীবন শেষ হয়ে গেল, পেলাম না! যাবার দিন আব্বা সকাল থেকে অস্থির থাকতেন, আমার আব্বার সৌম্য প্রশান্ত চেহারায় ঘোর অমাবশ্যা দেখা যেত। রিকশা চলতে শুরু করলে প্রতিবার আমার হাত ধরে রিকশার সাথে হাঁটতে শুরু করতেন, রিকশার গতি বেড়ে গেলে হাত ছেড়ে দিতেন। আমার বুকের মধ্যেটা তখন মোচড়াতো আব্বার জন্য, কিন্তু চোখের আড়াল হলে আমি কত সহজেই না স্বার্থপরের মত ভুলে যেতাম সেসব। আব্বা চাইলে সহজেই ঢাকায় বাড়ি নিয়ে আমি, আব্বা আর মা থাকতে পারতাম কিন্তু কেন যে আব্বা কিছুতেই ঢাকায় থাকতে চাইতেন না বুঝতাম না। এই নিয়ে আমার যথেস্ট রাগ ছিল আব্বার উপরে।

ফিরে গিয়ে ইডেনে ক্লাস শুরু করলাম। মেজদিরা ততদিনে ওই পাঁচতলা বিন্ডিং ছেড়ে সাত নং সেক্টরের একটু অন্যদিকে চলে এল। আমার আফসোস ছিল যে জাফর ইকবালকে রোজ আর দেখতে পাবো না। পার্টনারের সাথে সমস্যা হচ্ছিল বিধায় ওরা সিদ্ধান্ত নেয় যে নিজেরাই হসপিটাল করবে।

উত্তরার বড় রাস্তার পাশে একটা বিশাল দোতলা বিল্ডিং নিল ওরা। দোতলায় আমরা থাকি আর নীচতলা পুরোটা হসপিটাল, বিশাল সাইনবোর্ড “উওরা মেডিকেল সেন্টার।” একদিন দুপুরে আমরা ভাত খাচ্ছি, হঠাৎ আনিস ভাইয়ের আগমন। হৈ হৈ করে সে বাসায় ঢুকল। ঢুকেই ডাইনিং টেবিলে একটা চেয়ার টেনে বসে ঘোষণা দিল, ‘মনি তো ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে, মিষ্টি খাওয়ান’। ঘরের মধ্যে যেন বোমা পড়ল। পিনপতন নিঃস্তব্ধতা! আমি শ্বাস নিতেও ভুলে গিয়েছিলাম, ওই মূহুর্তে মনে হয়েছিল ‘ধরণী তুমি দ্বিধা হও’। একসময় মেজদি আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এর মানে কি?’ আর রাগের চোটে আমারও মনে হয়েছিল আমি আনিস ভাইকে জিজ্ঞেস করি, ‘দুপুরবেলা এসে এসবের মানে কি’? বরং আমি মিনমিন করে আনিস ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম তিনি ঠিক দেখেছেন কিনা। আনিস ভাই বললেন যে রোল নাম্বার যদি ঠিক দিয়ে থাকি তবে ২০০% নিশ্চিত।

মেজদি রেগে গিয়ে বলল যে সে এসবের কিছুই জানে না অতএব এই নিয়ে কোন কথা হবে না, বলে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে চলে গেল। বেচারা আনিস ভাই মিষ্টি খেতে চেয়েছিলেন কিন্তু দুপুরের ভাতও জোটেনি। পরিস্থিতি জটিল বুঝে সাথে সাথে কেটে পড়লেন। আমার ভীষণ খারাপ লাগল এই ভেবে যে , ক্যাম্পাস থেকে উত্তরা এতটা পথ এসে না খেয়ে চলে গেলেন। আমি খেয়ে যেতে জোড় করলাম না কারণ তাহলে মেজদি নিশ্চিত করে ফেলত যে আনিস ভাইয়ের সাথে আমার প্রেম চলছে এবং এই জন্যই আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চাই। আমি এই মুহূর্তে এইসব ঝামেলায় জড়াতে চাইলাম না, অন্য সময় হলে হয়ত ইচ্ছা করে ওদের রাগানোর জন্য আনিস ভাইকে তোয়াজ করতাম, খেতে বলতাম কিন্তু কে যেন আমার কানে কানে বলতে লাগল, সাবধান, ধীরে খুব ধীরে সব কিছু; মনে রেখ দিঘী তোমাকে ডেকেছে। একটা ভূল পদক্ষেপ সব বানচাল করে দিতে পারে। আমি মুখে কুলূপ এঁটে ফেললাম আর ভেতরে আমার আনন্দের জোয়ার। (চলবে)