শারমীন শরীফ : হঠাৎ মাথায় এল ড্রাইভিং শিখব। মেজদির ড্রাইভার মনসুর ভাইকে পটিয়ে ফেললাম। কথা দিল প্রতিদিন বিকেলে সে আমাকে ড্রাইভিং লেসন দেবে। মনসুর ভাই বলল যে মেজদি জানতে পারলে আস্ত রাখবে না। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম যে মেজদি জানবে না। কলেজ থেকে ফিরে ৫ তলায় ওঠার আগে আমি আর মনসুর ভাই গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে যেতাম আধা ঘন্টার জন্য। গাড়ি স্টেডি রেখে ইস্টিয়ারিং হুইল ঘোরানো শিখে ফেললাম। তখন উত্তরা একদম খালি ছিল, বিশেষ করে ৭ং সেক্টর পুরোটাই খালি ছিল। আমি আধা ঘণ্টার জন্য খালি রাস্তায় মনের সুখে গাড়ি চালাতাম। কয়েকদিন প্র্যাক্টিস করে আমার মনে হল আমি খুব ভাল গাড়ি চালাতে পারি। কনফিডেন্স লেভেল সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেল।

আমার কলেজ ফাইনালের পরে মা আব্বা বেড়াতে এসেছেন ঢাকায়, বড় আপার বাসায় থাকছ্নে কয়েকদিন, আমিও সেদিন রাতে বড় আপার বাসায় থাকলাম। বড় দুলাভাই গাড়ি পার্ক করত গ্যারাজে, বিন্ডিং থেকে একটু দুরে, অগ্রনী স্কুলের পিছনে। বড় দুলাভাই ওঁর বড় মেয়েকে গাড়ি চালানো শিখিয়েছে আর মেয়েই প্রতিদিন সকাল বেলা গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে বাসার সামনে নিয়ে আসত। আমি এতদিন পরে স্বীকার করছি যে রিমির গাড়ি চালানো দেখেই আমারও ইচ্ছে হয়েছিল গাড়ি চালানোর আর তাই শিখতে চাচ্ছিলাম চুপিচুপি। যাই হোক সেদিন সকাল বেলা দুলাভাই যথারীতি রিমিকে বললেন গাড়ি আনতে, আমি রিমির সঙ্গ নিলাম। হেটে যেতে যেতে ওকে বোঝালাম যে আমি কত ভাল গাড়ি চালাই। গ্যারেজে গিয়ে রিমিকে বললাম যে আমি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাব। রিমি বেচারা আমাকে বিশ্বাস করে চাবি দিয়ে দিল। গ্যারেজ থেকে বের হয়েই একটা বড় পুকুর ছিল। ওটা ঘুরে তবে আমাদের যেতে হত। আমি খুব সাবধানে গাড়ি গ্যারেজ থেকে বের করে আস্তে আস্তে চলতে শুরু করলাম। পুকুরের পারে বাঁক নিতে গিয়েই ঘটল যত বিপত্তি, আমি ব্রেকের বদলে এক্সেলেটরে জোরে চাপ দিয়ে দিলাম আর গাড়ি লাফিয়ে উঠে পুকুরের দিকে নেমে যেতে শুরু করল। রিমি চেচাচ্ছে, ‘মন্টি ব্রেক ব্রেক ব্রেক’। আমি মনে হয় চারিদিকে তখন কুয়াশা দেখছিলাম। ব্রেক করেছিলাম এবং পুকুর পারের আধা হাত দুরে গিয়ে একটা গাছে ধাক্কা মেরে থেমে গিয়েছিল গাড়ি। পেছনে দুনিয়ার মানুষ চীৎকার করছে- গেল গেল গেল। আমরা দু’জন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছি আর একগাদা লোক এসে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে পিছনে রাস্তায় তুলে দিল, কাঁচ ভেঙ্গে ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। আমি ড্রাইভিং সিট ছেড়ে সরে গেলাম আর রিমি ড্রাইভ করে আমাদের বাসায় নিয়ে এল। আমরা দুজন মুখ কালো করে বাসায় উঠলাম। আমি বড় দুলাভাইকে যমের মত ভয় করতাম, রিমিও তাই। আমি গিয়ে মায়ের পিছনে লুকালাম আর রিমি গিয়ে পুরো কাহিনী খুলে বলল দুলাভাইকে। আব্বা আর দুলাভাই তখন নাস্তা খাচ্ছিলেন। দু’জন উঠে নীচে চলে গেলেন গাড়ির অবস্থা দেখার জন্য। বনেট গাছে লেগে মাঝামাঝি জায়গায় ডেবে গিয়েছিল আর সব জানলা ভাঙ্গা।

আব্বা শুধু বলতে থাকলেন যে আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি তিনি তাতেই খুশি। গাড়ি সারানোর পুরো খরচ আব্বা দিয়ে দিলেন দুলাভাইকে। ঘটনা এখানে শেষ হল না কারণ মেজদি জেনে গেল যে আমি ওর গাড়ি নিয়ে মনসুর ভাইয়ের কাছে চালানো শিখছি আর সে সেটা জানেই না। আমি নিজের জন্য নয় মনসুর ভাইয়ের জন্য শংকিত হলাম, বেচারার চাকরি না যায়। আমি পুরো দায়িত্ব নিজ ঘাড়ে নিয়ে নিলাম। সবার ঠান্ডা ব্যাবহারে আমার জমে যাবার মত অবস্থা হল কিন্তু আব্বার চুপ হয়ে যাওয়া আমাকে অনেক বেশি কষ্ট দিতে লাগল। আমি কিছু ভুল করলে আব্বার সব সময় আমাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতেন কিন্তু চুপ করে থাকতেন না, তার মানে আব্বা আমার আচরণে কষ্ট পেয়েছেন। মা আব্বা তখন আজিমপুর থেকে উত্তরায় চলে এসেছেন, এক বিকেলে আব্বা বারান্দায় বসে খবর কাগজ পড়ছিলেন। আমি একটা মোড়া নিয়ে ধীরে ধীরে গিয়ে আব্বার পাশে বসে তাঁর হাত ধরলাম। আব্বা আমার দিকে তাকালেন, কিছু বললেন না। আমি একটু চুপ থেকে আব্বাকে জানালাম যে আমার ভীষণ ভুল এবং অন্যায় হয়েছে। আব্বার চোখটা আদ্র হয়ে গেল। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে একটু ধরা গলায় বললেন, ‘মামনি আমি সব সময় আতংকে থাকি তোমার নিরাপত্তা নিয়ে, তুমি এবারে আমার মনে আরো ভয় ঢুকিয়ে দিলে’, আমি আশ্বস্ত করলাম যে এমন ভুল আর হবে না। আব্বা বললেন তিনি মন ছোট করে থাকেন যে আমাকে আমার বোনদের বাসায় থাকতে হচ্ছে এবং এব্যাপারে তিনি কিছুই করতে পারছেন না এটাই তাঁর জন্য অনেক কষ্টকর, কেউ যদি আমাকে তাদের গলগ্রহ মনে করে তাহলে তিনি কিছুতেই তা সহ্য করতে পারবেন না।

এবারে আমি আব্বাকে বললাম, যে প্রতি মাসে প্রয়োজন অতিরিক্ত টাকা সে পাঠায় আমার জন্য, তাছাড়াও, নারকেল, গুড়, চাল সব ডাবল আসে মেজদির বাসায় কারণ আমি এখানে থাকি বলে, তবুও কেন সে এত মন ছোট করে থাকে? আব্বা আমার মাথায় হাত রেখে বললেন যে আমি সন্তানের মা না হওয়া পর্যন্ত তাঁর এই কষ্ট বুঝবো না। আব্বা বললেন, ‘তুমি এই বাড়ির অক্সিজেন নিচ্ছ, ওদের একটা রুম দখল করে আছ, প্রতি বেলায় ওদের টেবিলে বসে ভাত খাচ্ছ, এটাই আসল, কোত্থেকে আসছে সেটা বড় বিষয় নয়। আমার প্রয়োজনে তুমি ওদের আশ্রয়ে আছ এটা আমাকে প্রতিনিয়ত পীড়িত করে, তুমি আমার সন্তান, আমার দায়িত্ব ‘তুমি’, ওদের নও। তবুও ওঁরা খুশি হয়ে দায়িত্ব নিয়েছে এতেই আমি কৃতজ্ঞ। আশ্রয়, কৃতজ্ঞ শব্দগুলো যেন আমার মাথায় হাতুড়ি মারতে থাকল।

আব্বার কথা শুনে আমার মনে হল আমার নিজের সাথে আমি আব্বার জীবনটাকেও ভারি করে দিয়েছি। আমার অস্তিত্বটাই একটা মূর্তিমান যন্ত্রণা। মেপে হাসি, মেপে কথা, মেপে মেপে কোথাও যাওয়া, একটা রুলটানা খাতার মাঝে বন্দী আমি। কোন কথা না বলে চুপ করে আব্বার পাশে বসে থাকলাম। আমার বাবার বৃদ্ধ বয়সের সন্তান ‘আমি’ আর আমার বৃদ্ধ ‘বাবা’ সেদিন সন্ধ্যা বেলায় পাঁচ তলার ব্যালিকনিতে নিঃশব্দ দু’টি ছায়া হয়ে ঝুলে রইলাম। নীরবে দু’জন দু’জনার ব্যাথা অনুধাবণ করতে চেস্টা করছিলাম। আমি আব্বাকে কথা দিলাম যে ওদের সামনে থেকেও ‘নাই’ হয়ে থাকব যাতে আমার কারণে কার কোন কষ্ট না হয়। আব্বা বুঝতেন যে বয়সের চেয়ে বড় দায়িত্ব তিনি আমার মাথায় চাপিয়ে দিয়েছেন, সেটা আব্বার জন্যও সুখকর ছিল না। আমাদের দু’জনার কষ্ট বুকে নিয়ে আমি এক সন্ধ্যায় যেন অনেক বড় হয়ে গেলাম। শিখে গেলাম কি করে নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার গলা টিপে মারতে হয়। কিন্তু আমার ভেতরে সব সময় আগুন জ্বলত, মনে হত সব ভষ্ম করে ফেলি। আনন্দ নিয়ে হেসে, খেলে বোনেরা পিতার বাড়িতে বড় হয়েছে আর আমি? তাই আমি যতটা চেস্টা করেছি ‘নাই’ হয়ে থাকার ততটাই যেন আরো প্রকট হয়েছি প্রতিদিন। সবাই যা করে আমি তার উল্টোটা করতাম। যেমন বোনরা মিলে একসাথে যখন আড্ডা দিচ্ছে আমি তখন আমার ঘরে কোনায় বসে একা একা বই পড়ছি। বোনরা বলত আমি ঢং করছি। (চলবে)