নাদিম ইকবাল টরন্টোর বাঙালিদের কাছে খুব প্রিয় এক উজ্জ্বল নাম। চলচ্চিত্র ও আলোকচিত্রে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেছেন কানাডায়। অসম্ভব সুন্দর ছবি তুলেন তিনি, সেই সাথে নির্মাণ করেন সৃষ্টিশীল শৈল্পিক চলচ্চিত্র। অতি স¤প্রতি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন ৪৫ মিনিটের এক অসাধারণ প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘নওফেল নেভার ডাইজ’ বা ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’। বাংলাদেশীদের কাছে পরম আনন্দ ও বিষাদের এই বিজয়ের মাসে ‘বাংলা কাগজ’ এ নাদিম ইকবালের চলচ্চিত্রটি নিয়ে আলোচনা করেছেন ‘বাংলা কাগজ’ এর সম্পাদক মনিস রফিক।
তারপর বয়ে গেছে অজস্র জল রাশি বাংলাদেশের জালের মত ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নাম না জানা নদী দিয়ে। তারপরও হয়তো অনেক নদীই হারিয়ে ফেলেছে নিজেদের টুইটুম্বুর যৌবন। অথবা যে শিয়াল আর শকুন নিজেদের অভয়ারণ্য বানিয়েছিল এই বাংলায়, তারাও হয়তো নিজেদের লুকিয়ে ফেলেছে গোপন কোন কোঠরে বা দূর কোন বিভত্স্য বধ্যভূমিতে। সে অনেক দিন আগের কথা, পাঁচ দশক পেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যে। ঋতুর পর ঋতুর পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের সামাজিক মানসিক মনোচেতনার পরিবর্তন হয়েছে স্বাভাবিক নিয়মের আবর্তেই।
এত এত সব অতীত হয়ে যাওয়ার মধ্যে যারা গেয়ে গেছেন মায়ের গান, মাটির গান আর মানবিক মুক্তির গান তাঁরা চির জাগরুক হয়ে জেগে আছেন আমাদের মাঝে। তাইতো নওফেল’রা কখনও ফুরিয়ে যায় না, হারিয়ে যায় না, শেষ হয় না। উনিশ’শ একাত্তর সালের নয়ই ডিসেম্বর যে নওফেলের বয়স ছিল আঠারো। সে এখনও সেই আঠারো’তেই আছে। আগুন জ্বলা মুক্তির দ্যুতি ঝলসানো চোখ নিয়ে সে এখনও তাকিয়ে আছে নিজের মায়ের দিকে, মাতৃভূমির দিকে আর বাংলার আকাশে বাতাসে। নওফেলদের মত অসংখ্য মুক্তিকামী প্রাণ যে মানবিক মুক্তির গানের সুর শুনেছিল, সেই গান তাদের জানিয়ে দিয়েছিল, জীবনের মানে কী? আর জীবনের পরম পাওয়াটাই বা কী? নওফেলদের সেই অনুধাবিত প্রাকৃতিক জ্ঞান আর শৌর্য আমাদের বারবার এনে দেয় এক অনাবিল মুক্তির স্বাদ আর আলোকিত এক আলোর স্বাধীনতা।
চলচ্চিত্র নির্মাতা নাদিম ইকবাল এর প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘নওফেল নেভার ডাইজ’ বা ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ আমাদেরকে নিয়ে যায় অসম্ভব সুন্দর প্রাণোচ্ছ¡ল এক মাটির সন্তানের কাছে যে দেশ মাতৃকার ভীষণ অন্ধকার সময়ে আলো হাতে এগিয়ে এসেছিল। তার সামনে তখন ছিল সমরাস্ত্রে সজ্জিত আর রণ কৌশলে প্রশিক্ষিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। আর আশপাশে ছিল মাটির পরীক্ষিত শত্রু রাজাকারের দল। নাদিম ইকবালের প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি আবর্তিত হয়েছে সেই ফরিদপুরের কমলাপুরের মেসবাউদ্দিন নওফেল’কে নিয়ে। ফরিদপুরের সরকারী রাজেন্দ্র কলেজের বিজ্ঞানের অসম্ভব মেধাবী ছাত্র নওফেল চিন্তা-ভাবনা এবং স্বপ্ন দেখায় তাঁর বয়সী অন্যদের চেয়ে অনেকটা আলাদা ছিল। তাঁর নিজের ক্যামেরায় চমত্কার ছবি তুলতো সে, তারপর সেই ছবি প্রক্ষেপণ নিয়ে ছোট বোনের সাথে নিরীক্ষাধর্মী কাজ করতো। বিজ্ঞানমনষ্ক মস্তিষ্কে সব সময় তাঁর চিন্তায় চলতো আবিষ্কারের নেশা। সেই জন্য আমরা পরবর্তীতে দেখি, কিভাবে সে ডামী রাইফেলকে সহজেই যুদ্ধাস্ত্র বানিয়ে ফেলে বা সহযোদ্ধাদের কিভাবে গ্রেনেড এর সু² ব্যবহার অবলীলায় শিখিয়ে দিতে পারে। কলেজের ন্যাশনাল ক্যাডেট কোরের সদস্য নওফেলের রক্তে সতত বয়ে চলতো আবহমান বাংলার মানবিক মুক্তির গান।
নওফেল ফরিদপুরের গোয়ালন্দ পাড়ের ছেলে। মাঝে মধ্যেই সে মাটির ঘ্রাণ নিতো প্রাণ ভরে। মনে হতো নবজাত শিশু তুলতুলে হাতে মায়ের স্তন আঁকড়ে জীবনের প্রথম গন্ধ নিচ্ছে কোন এক পরম ভালোবাসার। সেই নওফেল অন্য রকম উদ্বেলিত হয়ে পড়েছিল সাতই মার্চে। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই তেজোদীপ্ত যৌক্তিক আর মানবিক শব্দগুলো নওফেল’কে চিনিয়ে দেয় কোন পথে তাকে চলতে হবে। সেই সাথে দৃঢ় দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্ভাসিত গর্ভধারিনী মা তাকে এগিয়ে দেন সময়ের প্রয়োজনে কিভাবে সামনে এগুতে হয়। এই মা নির্দ্ধিধায় নিজ সন্তান এবং তাঁর বন্ধুদের উজ্জীবিত করেন মাতৃভূমির জন্য লড়াই করতে।
উনিশ ’শ একাত্তর সালের একুশে এপ্রিল থেকে ফরিদপুরের গোয়ালন্দ এলাকায় পাকিস্তানী সেনারা প্রচুর অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অবস্থান নেয়। তারপর থেকে যুদ্ধ শেষ না পর্যন্ত খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ হয় নওফেল আর তাঁর সহযোদ্ধাদের সাথে। সব যুদ্ধেই নওফেল সব সময় থাকতো সামনের সারিতে। মন থেকেই সে সব সময় চায়তো, তার কোন সহযোদ্ধার শরীরে গুলি লাগার আগে সেটা যেন তার শরীরে লাগে। একটার পর একটা সফল যুদ্ধে অংশ নিয়ে সেই যুদ্ধের সময়েই প্রশিক্ষণ দিয়েছে সে অনেককে, যারা তার মত দেশকে রক্ষা করতে অতন্ত্র প্রহরী হয়ে গড়ে উঠেছিল। যুদ্ধের ময়দানে নওফেলের নেতৃত্বের ক্ষমতা, তড়িত গতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার দক্ষতা, আর সহযোদ্ধাদের প্রতি প্রচণ্ড ভালোবাসা তাকে বানিয়েছিল তার দলের উপ-কমান্ডার।
নয়ই ডিসেম্বর ছিল তার জীবনের শেষ যুদ্ধ। করিমপুর ব্রীজের কাছে নদীর তীরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই প্রচণ্ড যুদ্ধে দলের কমান্ডার কাজী সালাউদ্দিন গুলিবিদ্ধ হলে আহত সহযোদ্ধাকে নিজ কাঁধে নিয়ে নওফেল এবং তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা আশ্রয় নেয় পাশের একটি গ্রামে। স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় সেই গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানী সেনারা ঘিরে ফেলে তাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করে। শুধু হত্যা করেই তারা ক্ষান্ত হয় নি, বরং তাঁদের সেই অবস্থায় সেখানে ফেলে রাখে কয়েক দিন। হানাদার বাহিনীর উপস্থিতির কারণে সেখানে কেউ দেশের সবচেয়ে সুন্দর সন্তানদের করব দিতে বা দাহ করতে পারে নি। বর্বরচিতভাবে হত্যা হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের লাশগুলো নিয়ে তখন খাদ্য উল্লাসে মেতে উঠে শিয়াল, কুকুর আর শুকুনেরা। খুবলিয়ে খুবলিয়ে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলে তাঁদের অস্থি মজ্জা আর দেহ।
‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে যায়। এই চলচ্চিত্রের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে নিটোল বুনন চলচ্চিত্র নির্মাতা করেছেন, তা আমাদের মুগ্ধ করে এবং খুব সহজেই মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপ আমাদের মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে ছড়িয়ে পড়ে। চলচ্চিত্রটির একেবারে শুরুতে বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য কবি আসাদ চৌধুরী যে আবেগ ও ভালোবাসা নিয়ে নওফেল আর তাঁর মা সম্পর্কে আমাদের অসাধারণ কিছু কথা বলেন সেটা আমাদের খুব সহজেই এমন এক চলচ্চিত্র দেখার জন্য মনোযোগী করে তুলে। নির্মাতা নাদিম ইকবালের এই উপস্থাপনা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। একেবারে শুরুর সাথে সম্পর্ক রেখে একেবারে শেষে তিনি আবার বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও আবৃত্তিশিল্পী এবং নওফেলের পারিবারিক বন্ধু লুত্ফুন নাহার লতার মুখ দিয়ে বলিয়ে নেন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের কথা। পয়তাল্লিশ মিনিটের এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের এই কাঠামোর মধ্যে নাদিম ইকবাল খুবই দক্ষ ও সচেতনভাবে বুনেছেন তাঁর পরিচালনা, ক্যামেরার কাজ, সম্পাদনা আর সঙ্গীতের ক্যানভাস। আর এই বুননটা এত বেশী মিহি যে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক যুবকের কথা শুনতে শুনতে ডুকরিয়ে কেঁদে উঠি।
একেবারে শুরুর কবি আসাদ চৌধুরীর সেই প্রাণভেদী শব্দগুলোর পর ড্রোন শট এ নওফেলদের সেই ফরিদপুরের যে চিত্র চলচ্চিত্র নির্মাতা পর্দায় তুলে ধরেন এবং ক্যামেরার যে ধীর গতি আমরা দেখতে পাই, তা নিমিষেই আমাদেরকে এক মুক্তিকামী গতির মধ্যে প্রবেশ করায়। ছবি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের তিনি সেই গতির মধ্যেই রাখেন। এই গতির মধ্যে নির্মাতা নিয়ে আনেন নওফেলের জীবনের গল্প আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প। নাদিম ইকবাল এই গল্প বলতে গিয়ে আমাদের সামনে হাজির করান এই কাহিনীর সাথে অতি প্রাসঙ্গিক সব ব্যক্তি আর তথ্য উপাত্তকে। আমরা দেখি তাঁর ছোট বোন নাজমুন নাহার খান আর সহযোদ্ধা ও আপনজন আবুল বাসার মিয়া, ইমরান মজুমদার রুনু, পীযুষ বন্দোপাধ্যায়, খসরু চৌধুরী, শামসুদ্দীন আহমেদ, আব্দুর রহমান, ওমর ফারুক, জারিফ আশরাফ, দুলাল শেখ, আতাহার খান, মহিউদ্দিন আহমেদ, আলিমুন এবং আইয়ুব হোসেনকে। এঁদের মুখ দিয়ে নাদিম আমাদের শুনিয়ে দেন নওফেল সম্পর্কে আর সেই যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্পর্কে। আমরা জানতে পারি সেই যুদ্ধের সময়েই কিভাবে নওফেল এক হিন্দু পরিবারকে আসন্ন অত্যাচার থেকে রক্ষা করেন। সেই পরিবারের সেদিনের দশ বছরের বালিকা শুক্লা গাঙ্গুলী যখন সেই দিনের কথা বলেন, তখন আমাদের বার বার মনে হয়, কত বেশী এক মানবিক মানুষ ছিলেন আমাদের নওফেল। শুক্লা গাঙ্গুলীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশে নাদিম যে তাঁর অসাধারণ আবেগীয় কবিতা আবৃত্তিতে উপস্থাপন করেন তা গোটা চলচ্চিত্রে এক করুণ রস নিয়ে আসে। সেই করুণ রস আমাদের আরও করুণতর মমতায় মিলেমিশে একাকার করে দেয় যখন নওফেলের মায়ের লেখা বইয়ের পাতা পর্দায় ভেসে উঠে। মায়ের লেখাগুলো আমাদের সত্যিই কাঁদায়। সত্যিই মায়ের কথাগুলো আমাদের চেতনায় সপাত করে আঘাত করে, কেনো আমরা ভুলে যায় সেই না ফেরা আলোর যাত্রীদের কথা। ভাবতেই অবাক লাগে, কি এক অসাধারণ মায়ের জন্ম দিয়েছে আমাদের ‘বাংলা মা’!
চলচ্চিত্র নির্মাতা নাদিম ইকবাল একজন ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’। তিনি একেধারে এই চলচ্চিত্রের পরিচালক, ক্যামেরাম্যান, সম্পাদক এবং প্রযোজক। তাঁর খুব সাধারণ ক্যামেরার কাজে চরিত্রকে ফ্রেমের মধ্যে আনার এক অসাধারণ মুন্সিয়ানা আছে। তিনি নিজে একজন ভালো আলোকচিত্রী বলেই হয়তো এই বিষয়ে তাঁর ক্ষমতা অসাধারণ। ড্রোন থেকে যে চিত্র তিনি গ্রহণ করেছেন, তা নিছক একটি জনপদকে তুলে ধরার নয়, বরং যে গতিতে এবং যে উচ্চতায় তিনি বাংলার সবুজ অথবা বাংলার নদীকে তুলে এনেছেন তা আমাদের চিরন্তন বাংলার এক অপরূপ চিত্র ফুটে উঠেছে, যে বাংলায় নওফেলদের মত সন্তান জন্ম নেওয়ায় স্বাভাবিক। আর এই অপরূপ দেশটির সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য এই সন্তানরা জীবন বাজি রাখতেই পারে। চলচ্চিত্রটির প্রয়োজনে অনেক চরিত্রের কাছে নাদিমের যাওয়া সম্ভব হয় নি, কিন্তু তিনি যে প্রক্রিয়ায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তাঁদেরকে পর্দায় উপস্থাপন করেছেন, তা অপূর্ব। প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে তাঁর এই শৈলী নিঃসন্দেহে অন্যদের কাছে অনুসরণীয় হয়ে থাকবে।
‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ এ নাদিম ইকবাল তাঁর সম্পাদনার যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তা দর্শকদের সমীহ আদায় করে নেয়। তিনি এমন একজনের কথা আমাদের শুনিয়েছেন, যার কোন ফুটেজ নেই, বক্তব্য নেই, এমন কি নিজের স্মৃতির তেমন কিছুই নেয়। শুধু আমরা দেখি তাঁর ব্যবহৃত ক্যামেরা, তাঁর পড়ার ঘর আর তার ছয়টি স্থির চিত্র। কত দক্ষ একজন চলচ্চিত্র সম্পাদক হলে এই কয়েকটি সামান্য জিনিসকে সম্বল করে তিনি আশপাশ আর তাঁর প্রিয়জনদের কথা এবং বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে ব্যবহৃত যুদ্ধের কিছু স্থির চিত্র আর ভিডিও ফুটেজ দিয়ে সাজিয়ে ফেলেছেন তাঁর এই চলচ্চিত্রটি। তাঁর এই সম্পাদনার সূ²তা এত মোহনীয় যে তিনি দর্শকদের তন্ময় হয়ে তাঁর চলচ্চিত্রটি দেখার ক্ষেত্র তৈরি করে দেন, আর নওফেলকে করে তোলেন আমাদের চির চেনা এক আপনজন।
‘নওফেল নেভার ডাইজ’ চলচ্চিত্রে সংগীতের ব্যবহার ক্যামেরার কাজ আর সম্পাদনার সাথে এক লয়ে চলেছে। এমন এক চলচ্চিত্রে সংগীত খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। নাদিম ইকবাল এখানেও তাঁর সেই উপাদান ব্যবহারে সম্পূর্ণভাবে সফল। সাখওয়াত হোসেন সাগর এর আবহ সংগীত আমাদের খুব সহজেই নিয়ে যায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের কাছে। বিশেষ করে একেবারে শেষের দিকে আমরা যখন জেনে যাই নওফেলের শেষ পরিণতির কথা, সেই সময় জানালার পাশে দাঁড়ানো তাঁর বোনের ব্যাক শট এবং সামনে অবারিত মাঠের দৃশ্য পর্দায় আসার সাথে সাথে যখন তানিয়া নাহিদের কণ্ঠে বেজে উঠে নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা এবং আলাউদ্দিন আলীর সুর করা ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো একটি পলাশ ফুলের মালা’ গানটি। নাদিম ইকবাল এই গানটি প্রথম থেকে শুরু করেন নি, বরং শুরু করেছেন অন্তরা থেকে। এখানেই তাঁর দর্শকদের কাছে অসাধারণ কিছু উপস্থাপনের মুন্সিয়ানা। আমাদের কানে যখন ভেসে আসে ‘আসি বলে আমায় ফেলে সেই যে গেল ভাই……’ । তখন আমরা সবাই অশ্রু সংবরণ করতে একেবারেই ব্যর্থ হয়ে যাই। সেই সাথে সব শেষে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মার্কিন সংগীত শিল্পী জোয়ান বেইজ এর সেই বিখ্যাত ‘বাংলাদেশ’ গানটি নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশী কানাডিয়ান ময়ূখ সাইদ এর কণ্ঠে আমরা যখন শুনি, তখন আমাদের সত্যি সত্যিই মনে হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেয়া আমাদের এক আপনজনকে নিয়ে আর আমাদের মাতৃভূমিকে নিয়ে কে কোন কালে এমন করে গান গেয়েছেন!
নাদিম ইকবাল তাঁর প্রথম প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘মাদার টাং’ নির্মাণ করেন ২০১৬ সালে। অপূর্ব সুন্দরভাবে মাতৃভাষার বিষয়টি তিনি তুলে ধরেছেন এ ছবিতে। মাত্র এগার মিনিটের সেই স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রটি দেখলে সবারই মনে হবে কোন পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র দেখার স্বাদ আস্বাদন করলো। প্রথম ছবিতেই নাদিম তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণের সেই দক্ষতায় হতবাক করেছিলেন দেশ বিদেশের অগণিত দর্শককে। ছয় বছর পর নির্মিত নাদিম ইকবালের এই চলচ্চিত্রটি দেখে বারবার মনে হয়েছে ক্যামেরা, সম্পাদনা, সংগীতের ব্যবহার সর্বোপরি পরিচালনায় নাদিম দিন দিন সুন্দর উত্কর্ষের দিকে এগুচ্ছে। সেই সাথে সেই ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো কাজ করেছেন তার সবগুলোর বিষয় নির্বাচন দেখে মনে হয় তিনি কত বেশী মানবিক ও সংবেদনশীল। নাদিম ইকবালের সামনে এখন এক প্রশস্ত পথ। দৃঢ় বিশ্বাস, এই সংবেদনশীল চলচ্চিত্র নির্মাতা এই পথ দিয়ে হেঁটে যাবেন দীপ্ত পায়ে আজীবন।
নাদিম ইকবাল প্রায় এক দশক ধরে বাস করছেন কানাডার টরন্টোতে। গতানুগতিক অন্যদের মত তিনি প্রবাস জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন নি, বরং ক্ষণে ক্ষণেই তিনি ছুটে যান বাংলাদেশে। ক্যামেরায় তুলে আনেন মানুষের কথা, জীবনের কথা। তাঁর ছুটে চলার মধ্যে এক প্রাণের তাগিদ আছে, যা তাঁকে বার বার স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছেন বা যারা মুক্তিযুদ্ধকে কাছ থেকে দেখেছেন তাঁদের এখন যাবার সময় হয়ে গেলো। দেশের ইতিহাসের স্বার্থে তাঁদের সেই অভিজ্ঞতা আর দেখা ক্যামেরায় ধারণ করা অতি বেশী জরুরী। তাইতো নাদিম হৃদয় থেকেই উপলব্ধি করেন, এখনই সময় মা, মাটি আর মানবিক মুক্তির গান যারা গেয়ে গেলেন তাঁদের সম্মান জানানো, তাঁদের ভালোবাসা দেখানো। নাহলে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বড় বেশী মলিন হয়ে যাবে।