ডঃ বাহারুল হক : উত্তর প্রদেশ ভারতের উত্তর সীমান্তে নেপালের সাথে লাগোয়া একটি প্রদেশ। উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌ একটি খ্যাতনামা প্রাচীন শহর, যে শহরের গোড়া পত্তন হয়েছিল ষোল শতকে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর। যদিও লক্ষ্ণৌ প্রথম থেকেই স্বাধীন নওয়াবদের প্রধান কর্ম এবং নিবাস স্থল ছিল, কিন্তু দিল্লীর সাথে লক্ষ্ণৌ শহরের সম্পর্ক ছিল নিবিড়। গোমতি ভারতের একটি প্রধান নদী। গোমতিই প্রাণ দিয়েছে সে কালের তিলোত্তমা লক্ষ্ণৌকে। গোমতির তীরে গোমতিকে কেন্দ্র করে তিল তিল করে গড়ে উঠেছে এই পুরী, লক্ষ্ণৌ। গোমতি হিন্দুদের কাছে অতি পবিত্র একটা অতি প্রাকৃতিক নদী। হিন্দু পুরাণ বলে- গোমতি নদী মহাজ্ঞানী ঋষী ভাশিশথার কণ্যা। হিন্দুরা তাই এক চন্দ্র মাসের একাদশিতে পাপমুক্ত হওয়ার জন্য গোমতি নদীতে স্নান করে। শুনেছি দুর্লভ গোমতি চক্র পাওয়া যায় এ নদীতে। অবশ্য গোমতি চক্র দেখতে কেমন আমি জানি না। আমি কোনদিন দেখিনি। উত্তর প্রদেশের ভৌগোলিক অবস্থান গোমতির পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ বেশ সহজ করে দিয়েছে। গোমতিতে পানি প্রবাহ না থাকায় লক্ষ্ণৌ নৌ বন্দরের পরিচিতি হারিয়েছে যেটা কলিকাতা হারায়নি। পশ্চিমবঙ্গের কলিকাতাও হুগলি নদী কেন্দ্রিক একটা শহর। হুগলি কখনো পানি স্বল্পতায় ভোগেনি। কলিকাতা পার হয়ে হুগলি গড়িয়ে পড়েছে অনতিদূরে বঙ্গোপসাগরে। হুগলি ধীরে ধীরে সাগরের দিকে ধাবিত হয়েছে। অপরদিকে গোমতি ভারতের উত্তরাংশের উচ্চ ভ‚মিতেই জন্ম নিয়ে বিকশিত হয়েছে এবং পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে পরিণত হয়েছে শ্রীহীন রুগ্ন এক নদীতে। ইটালির থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সাইন্স কর্তৃক প্রদত্ত বৃত্তি নিয়ে পোষ্ট-ডক্টোরাল ফেলো হিসেবে আমি কিছুদিন লক্ষ্ণৌ শহরে ছিলাম। লক্ষ্ণৌতে আমার কর্মস্থল ছিল ইন্ডাস্ট্রিয়াল টক্সিকোলজি রিসার্স সেন্টার (সংক্ষেপে: আই-টি-আর-সি)। আইটিআরসি’র সাত তলা বিশাল ভবনটি গোমতির দক্ষিণ পারে একেবারে গোমতির গা ঘেঁষে অবস্থিত। কর্ম দিবসগুলোতে দুপুরের খাওয়া আমি আইটিআরসি’র ক্যান্টিনেই খেয়ে নিতাম। ক্যান্টিনে ঢুকেই আমি জানালার পাশে একটা জায়গা বেছে নিতাম। তারপর চলতো যুগপত আমার খাওয়া আর গোমতি দেখা। নিঃস্ব, রিক্ত, বিবর্ণ, অসহায় এক নদী, গোমতি। লক্ষ্ণৌ শহরের মধ্যে এঁকে বেঁকে যে গোমতি বর্তমানে পড়ে আছে তার দৈর্ঘ প্রায় বার কিঃ মিঃ। গোমতির উপর কয়েকটা ব্রীজ হয়েছে। ফলে লক্ষ্ণৌ উত্তর দিকে বেশ স¤প্রসারিত হয়েছে। উত্তর পাশের লক্ষ্ণৌ আধুনিক। অভিজাত সব প্রতিষ্ঠান, অভিজাত সব বাসস্থান এখন উত্তর পাশের নতুন লক্ষ্ণৌতে। আমার বাসা ছিল নতুন লক্ষ্ণৌর আলিপুর রেসিডেন্সিয়াল এরিয়াতে। গোমতি আলিপুরের পাশেই? মাঝে মাঝে বিকালটা আমার কাটতো গোমতির পারে হেঁটে হেঁটে। আমার মনে পড়তো আমাদের গোমতির কথা। আমাদের গোমতি ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে এসে কুমিল্লার পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শেষে মেঘনার সাথে মিশেছে। আমাদের গোমতি এক সময় জলে ভরা উত্তাল এক নদী ছিল। বর্ষায় এতটাই সমস্যার সৃস্টি করতো যে গোমতিকে বলা হতো কুমিল্লার দুঃখ। লক্ষ্ণৌর গোমতিও যে এককালে উচ্ছল, উদ্দাম, উত্তাল, আর বান-ভাসির কারণ ছিল তা গোমতির দিকে তাকালেই বুঝা যায়। হয়তো গোমতি লক্ষ্ণৌর দুঃখ ছিল, কিন্তু এখন গোমতির দুঃখ লক্ষ্ণৌ। এখন গোমতি, বিবর্ণ, শ্রীহীন এক নদী । তার বুকে কিছু জল আছে, কিন্তু সে জলে কোন প্রবাহ নাই, যেন মরা এক নদী। তবে নদী পারে হেঁটে হেঁটে এটা নিশ্চিত হলাম যে কোথাও আমাদের মত নদী খেকোর কোন উপদ্রপ নাই। দুপারেই পানির উপরের অংশ খোলা এবং তা ঘাসে, তৃণে ভরা। ফলে গরু-ছাগল চরছে; ধোপারা কাপড় শুকাচ্ছে। লক্ষ্ণৌর গোমতি এখন বলা যায় ধোপাদের দখলে। নদীর পানির একটু অংশ ওয়াটার হায়াচিন্থ মুক্ত রেখে সেখানে ছোট ঘাট বানিয়ে তারা তাদের ধোয়া -ধুয়ির কাজ চালায়। একটু পর পরই দেখা যায় ঘাট আর তাদের ধৌত কর্ম। এটাও আমার কাছে খারাপ লাগেনি। নদীর পানি পুরোপুরি দুষণে ভরা ; এ পানিতে পূণ্যার্থীরা কিভাবে পূণ্যস্নান করে আমি বুঝি না। পানিতে ডিজল্বড অক্সিজেন অবিশ্বাস্য রকম কম। এত কম যে জলজ প্রানির পক্ষে এ পানিতে জীবন ধারন করা কঠিন।
লক্ষ্ণৌর গোমতি পারে হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হতো আমি যেন রাজশাহীর পদ্মার পারে হাঁটছি। তবে পদ্মার অবস্থা আরো খারাপ। গ্রীস্মকালে ধুলা-বালির উপদ্রপে পদ্মা পারের বাড়ি গুলোতে থাকা দায়। শুস্ক, উষ্ণ দমকা বাতাস পদ্মার বালি নিয়ে আছড়ে পড়ে পদ্মার পার ঘেসে থাকা সব বাড়িতে। অথচ পদ্মা পারেই রাজশাহীর ডিসি, এসপি, সিভিল সার্জনের মত প্রশাসনিক বড় বড় কর্মকর্তাদের সরকারী বাসভবন। ১৯৭৮ সনে আমার কাকা রাজশাহীর ডিসি ছিলেন। সে কারণে পদ্মা পারে ডিসির দ্বিতল বিরাট সরকারী বাস ভবনে থাকার এবং ধুলা-বালির নাচন দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। যে বাসভবনে বসে বসে এককালে জলে ভরা বিপুল প্রানাধার রুপসী পদ্মার রুপ দেখা হতো সে বাসভবনে বসে বসে এখন দেখা হয় মৃত পদ্মার বুকে শুধু প্রানহীন বালিয়াড়ি। এ বালিয়াড়ির শুকনা বালি ক্ষনে ক্ষণে আচমকা আক্রমন করে বসে এসব বাসভবন। সন্তানহারা মায়ের মত জলহারা এসব বালিয়াড়িও যেন উন্মাদ হয়ে গেছে। তাই অকারনে আশে পাশের সবকিছুকে আক্রমন।
গোমতি অবশ্য ততটা জলহীন নয়। তাই বালিয়াড়ি গা দেখাতে পারছে না। আমার আফসোস যে আমি নৌকা নিয়ে লক্ষ্ণৌর গোমতিতে বেড়াতে পারলাম না; নদীর যে রুপ – রস -গন্ধ তার কিছুই পেলাম না লক্ষ্ণৌর এই গোমতিতে। নৌকা নিয়ে গোমতির বুকে নামবো এরকম কোন ইচ্ছাই আমার মনে জাগেনি। লক্ষ্ণৌর পাশে আছে সাঁই । সাঁই একটি উপনদী যেটি গঙ্গা নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করে বহু পথ পেরিয়ে লক্ষ্ণৌর কাছে গোমতির সাথে মিশে গেছে। আমি সাঁই ও দেখেছি। চরম দুরাবস্থা। পানি তলানিতে এসে ঠেকেছে। কোন কোন জায়গা একেবারে শুকনা। সাঁইর পাশের কৃষকদেরকে তাদের কৃষি জমিতে পানি দিতে হয় ডিজেল পাম্প দিয়ে মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলন করে। জমি সেচের জন্য পর্যাপ্ত পানি আর সাঁইয়ের বুকে নাই। সাঁই অবশ্য আদি গঙ্গা নামেও পরিচিত অনেকের কাছে।
এবার দেখি অন্য মহাদেশের অন্য এক নদী। আমি ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কিছুদিন ছিলাম নরওয়ের উত্তরাঞ্চলের এক শহর ট্রন্ডহেমে। ট্রন্ডহেম থেকে মাত্র পাঁচ শত ষাট কিমি উত্তরে আর্কটিক সার্কেল যেখানে রয়েছে শুধু নরওয়ের নয় দুনিয়ার সর্বোত্তরের টাউন হ্যামারফেস্ট। মাত্র দশ হাজারের কিছু বেশি মানুষের বসবাস এই হ্যামারফেস্ট টাউনে। ট্রন্ডহেমও একটা ছোট শহর। তবে এখানে আছে একটা মস্ত বড় ইউনিভার্সিটি- নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজি। নরওয়েজিয়ান ভাষায় এর নাম হলো- নর্জেস টেকনিস্ক নেচারভিটেনস্কাপেলিজ ইউনিভার্সিটেট ,সংক্ষেপে যা এনটিএনইউ। এই এনটিএন ইউ ছিল ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে আমার কর্মস্থল। দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার নদী মাতৃক অনুন্নত ছোট্ট এক দেশ বাংলাদেশ থেকে আসা আমার কাছে ইউরোপের উন্নত দেশ নরওয়ের উত্তরাঞ্চল এক নতুন দুনিয়া। এখানে এসেও আমার প্রথমেই খোঁজা হয়েছে নদী।
মনে মনে শুধু ভাবতে ছিলাম নতুন এই দুনিয়ার নদীর নিশ্চই নতুন রুপ দেখবো যা আগে কখনো আমার দেখা হয়নি। পেয়ে গেলাম এক নদী। নদীর নাম নীদ নদী। নদীর নামটি আমার মনে নাচন ধরিয়ে দিল। নীদ নদী। মুহুর্তেই মনে পড়ে গেল নীল নদীর নাম। নীল নদী। মিসরের সেই ভুবন বিখ্যাত নীল নদী। নীদ নদীর মোহনায় গড়ে উঠেছে নয়নাভিরাম শহর ট্রন্ডহেম। নরওয়ের রাজ্ধানী অসলো থেকে প্রায় পাঁচ শত কিমি উত্তরে অবস্থান এই শহরের। নীদ নদীর উৎপত্তি হিপ্তোসেন নামক এক ওয়াটার ফল-এ। ওয়াটার ফল থেকে বের হয়ে নীদ বরাবর উত্তরদিকে বয়ে যেতে থাকে এবং এক সময় উত্তরের নরওয়েজিয়ান সাগরের ফিঅর্ড (নরওয়েজিআন ভাষায়) বা খাঁড়িতে গিয়ে পড়ে। এসব খাঁড়িকে ঘিরেই নীদ নদীর শেষ গাঁথা। নীদের শুরুটা দেখিনি তবে শেষ দেখে অমি অভিভুত। এসব দৃস্টি নন্দন খাঁড়ির পাশেই ট্রন্ডহেম সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশন। শুধু নীদ নদী দেখার জন্য আমি নরওয়েতে ভ্রমনের জন্য আকাস পথ ব্যবহার না করে রেলপথ ব্যবহার করতাম। পার্বত্য কণ্যা নীদ-এর তীর ঘেসে স্থাপিত হয়েছে পার্বত্য এলাকার উপযোগী সরু বিশেষ রেলপথ। সে রেলপথেই আমি ভ্রমন করেছি ট্রন্ডহেম থেকে অসলো। রেলে ট্রন্ডহেম থেকে অসলো যাওয়ার সময় দেখেছি নীদের কত নাম । নীদ কোথাও স্থানীয় লোকজনের কাছে নিসের, কোথাও নিডেনেস আবার কোথাও নিলগ নামে পরিচিত।
নদীর নাম ভিন্ন, কিন্তু নদী একই- নীদ নদী। স্টেশনের পাশে সাগরের অপরুপ খাঁড়ি আর সেসব খাঁড়িতে বিলিন হয়ে যাওয়া নীদ নদী দেখে দেখে আমি ট্রন্ডহেমে আমার অবসর কাটাতাম। নীদ দেখে আমার চেয়ে ঢের বেশি মুগ্ধ হয়েছিলেন নরওয়েজিয়ান কবি অস্কার হুড্ড। হুড্ড ১৯৪০ সনে নীদ নিয়ে রচনা করেছিলেন কালজয়ী কবিতা- “নীদ তুমি অপরুপা।” নীদের জল পাখির চোখের মত টলটলে আর স্বচ্ছ। নদীর জল এত স্বচ্ছ হয় তা নীদকে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না।