সোনা কান্তি বড়ুয়া : ধ্যানী সম্রাট অশোকের জনহিতকর কাজ ছিল “অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ’ সর্বজীবে দয়া, অহিংসার যে বাণী তিনি প্রচার করেছিলেন তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য তিনি অক্লান্ত প্রচেষ্টা করেছিলেন। শুধু ধর্মীয় ব্যাপারেই নয় জীবজগতের সার্বিক কল্যাণ সাধনেও সম্রাট অশোকের দৃষ্টি ছিল প্রখর। যাগ যজ্ঞে এবং রাজপরিবারে আহারের জন্য পশুবধ তিনি বন্ধ করেন। শুধু মানুষের জন্যই নয় জীবজন্তুর চিকিৎসার জন্যেও তিনি দেশময় দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। প্রয়োজনীয় ওষুধ যাতে সহজলভ্য হয় সেজন্য তিনি সহজলভ্য নয় এমন সব গাছপালা সংগ্রহ করে বিভিন্ন স্থানে চাষাবাদের ব্যবস্থাও করেছিলেন। পথিকদের সুবিধার জন্য রাজপথ নির্মাণ করে তার দুই পাশে গাছপালা রোপণ করেছিলেন। ক‚প ও দীঘি খনন করিয়েছিলেন, বিশ্রামাগার ও পান্থশালা ইত্যাদি নির্মাণ করিয়েছিলেন। দীন দুঃখীদের ভিক্ষা দানের ব্যবস্থাও করেছিলেন; আর এই সমস্ত কাজে যথাযথ দৃষ্টি রাখার জন্য বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিযুক্ত করেছিলেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়:
“তোমার কীর্তির চেযে তুমি যে মহৎ,
তাই তব জীবনের রথ,
পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমারে,
বারম্বার। / তাই চিহ্ন তব পড়ে আছে, / তুমি হেথা নাই।”
২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট অশোকের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। সম্রাট অশোকের রজত্বকাল ২৭৩-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ (B.C. before Christ) পর্যন্ত ব্যাপ্ত ছিল। মৌর্যসম্রাট অশোক ‘দেবানাং প্রিয়’ উপাধি ধারণ করেন। ‘দেবানাং প্রিয়’ শব্দের অর্থ হল দেবতাদের প্রিয়। সম্রাট অশোকের পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রা সিংহলে ধর্ম প্রচার করতে গিয়েছিলেন।
কলিঙ্গ অনুশাসনে (১৩ নং রক এডিক্ট) সম্রাট অশোক লিখেছিলেন, “সকল মানুষই আমার পুত্রতুল্য। আমার পুত্রেরা সকল মঙ্গল ও সুখের অধিকারী হোক। মানুষ ও পশুর জন্য দাতব্য চিকিৎসালয়, বিশ্রাম গৃহ, ঔষধি ফলমূল, লতাগুল্ম রোপণ, পানীয় জল ও কৃষিকার্যের জন্য সরোবর খনন শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ এবং এগুলিকে সুচারু রূপে পরিচালনার জন্য তৈরি করলেন বুদ্ধবিহার। তিনি ৮৪ হাজার জনকল্যাণকারী প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সমস্ত জীব জগতের জন্য উৎসর্গ করলেন। কালজয়ী ধম্ম প্রচারকদের প্রেরিত করলেন সমগ্র বিশ্বে। মানব মনে প্রেম, ভক্তি, দয়া, করুণা স্থাপন করে সিঞ্চিত করলেন ভগবান বুদ্ধের চিরন্তন বাণী বসুধৈবকুটুম্বকম।
দ্বিতীয় গিরিলিপিতে সমস্ত সত্তার সার্বিক কল্যাণের জন্য উৎকীর্ণ করলেন তার ধম্মানুভূতি। যদি বিজয় করতে হয় তা হবে ধম্মবিজয় কলিঙ্গ অনুশাসনে তিনি লিখেছিলেন! ধ্যানী সম্রাট অশোকের জনহিতকর কাজ অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ!
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়: “অশোক তাঁর বীরত্বের অভিমান, রাজত্বের অভিমান দিয়েছিলেন ধূলায় লুটিয়ে। এতবড় রাজা কখনও পৃথিবীতে এসেছেন কি? কিন্তু সেই রাজাকে রাজাধিরাজ করল কে? সেই গুরু। জাতিতে জাতিতে ভেদ, বিসম্বাদ পূর্ণ, হিংসায় ভরপুর ও পঙ্কিল এই জাতিকে কি শুধু রাষ্ট্রনীতি দ্বারা রক্ষা করা যাবে? যিনি এসেছিলেন, তিনি আবার আসুন, উপনিষদের সেই বাণী নিয়ে। উপনিষদ বলছে, “কো ধর্ম্মভূতে দয়া, সমস্ত জীবের প্রতি দয়া, শ্রদ্ধও দয়া। শ্রদ্ধয়া দেয়ম, ধিয়া দেয়ম।
অশ্রদ্ধা করে দান করলে সে দান কলুষিত হয়। যেখানে মানুষ মানুষকে অপমান করে, সেখানে কি মানুষ রাষ্ট্রনীতিতে সিদ্ধিলাভ করতে পারে? দীনতম দীনের দুঃখ বিমোচনের জন্য তিনি সর্বত্যাগ করেছিলেন। সমস্ত মানুষকে একান্তভাবে জেনেছিলেন বলেই তিনি সত্য।”
মহামতি সম্রাট অশোকের পিতা বিন্দুসারের মৃত্যু পরবর্তীকালে সম্রাট অশোক সিংহাসন আরোহণ করে এবং ২৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে (B, C.) সম্রাট অশোকের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল! দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ ছাড়া ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চলই তাঁর সুবিশাল সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শারদীয় বুদ্ধ পূজা ঐতিহ্যে-সৃজনে সম্রাট অশোক! পরবর্তীকালে সম্রাট অশোকের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ এইসব অঞ্চলগুলিতে এবং দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অংশগুলির সাংস্কৃতিক চেতনাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট অশোক ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট হিসেবে বিবেচিত। মৌর্য সাম্রাজ্যের FIRST সম্রাট ছিলেন CHANDRA GUPTA – THE GREAT!
বৌদ্ধ দার্শনিকতত্তে¡র মর্মভেদী দেবদূত এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু উপগুপ্তের কাছে সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। ভূপালে সাঁচীর তোরনদ্বারের দক্ষিণ তোরণের পশ্চিমের স্তম্ভের মাঝের দুটো প্যানেলে সেই মহামতি সম্রাট অশোকের তীর্থভূমি বুদ্ধগয়ায় মহাবোধিবৃক্ষে বুদ্ধ বন্দনার অমর এ্যালবাম আজও অম্লান হয়ে আছে। তাই অশোক প্রচারিত ধর্মে আর্যসত্য, অষ্টাঙ্গিক মার্গ নির্বাণ লাভ প্রভৃতি বৌদ্ধধর্মের মূল লক্ষ্যে সুস্পষ্ট অনুপস্থিতি সত্তে¡ও সকল জীবের প্রতি দয়া, অহিংসা, পরধর্মসহিষ্ণুতা, সত্য কথা বলা নিজেকে সত্য রাখা, সৎ রাখা, দান, পিতামাতা গুরুজন এবং সাধু সজ্জনদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা, নিষ্ঠুর আমোদ প্রমোদ থেকে বিরত থাকা ইত্যাদি প্রধান আচরণবিধি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। অর্থাৎ ইহজগতের সঙ্গে সঙ্গে প্রজাদের পারলৌকিক উন্নতি বিধান ছিল অশোকের ধর্মের মূল লক্ষ্য। অশোক নিজেকে “দেবানমপ্রিয় প্রিয়দর্শী” হিসেবে অর্থাৎ দেবতাদের প্রিয় রাজা ‘প্রিয়দর্শী’ হিসেবেই পরিচয় দিতেন।
বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে সম্রাট অশোকের হৃদয় স্পন্দনে শারদীয় বুদ্ধ পূজা প্রকৃতির অপরুপ রুপ নিয়ে বিজয়া দশমী বা শান্তির আনন্দধারায় এই জাগরণী ছুঁইয়ে দিল! ধম্মবিজয় বেদাতীত কাল থেকেই চলে আসছে এই শারদ উৎসব। সম্রাট অশোক এই ধারাকে বজায় রেখেই আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমীর দিনে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন! ঘোষনষ করেছিলেন জীবপ্রেমের অমর বাণী। শারদোৎসব অনাদিকাল ধরে চলে আসা এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতেই সূচনা হল ২৬১ খ্রিষ্টপূর্বে কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে সম্রাট অশোকের জীবনে এক আমূল পরিবর্তন সূচীত হয়। সমস্ত ধর্মের মধ্যে যে অন্তর্নিহিত নীতিবোধ আছে সেই নীতিবোধকে জাগ্রত করাই ছিল সম্রাট অশোকের ধর্মের উদ্দেশ্য; সম্রাট অশোকের ধর্ম! এক কথায় তাঁর ধর্ম ছিল মানবতার প্রতি আবেদন সারা বিশ্ব জনে। অশোক ব্যক্তিগত জীবনে গোঁড়া বৌদ্ধ ছিলেন কিন্তু প্রজাসাধারণের কাছে তিনি যে উপদেশগুলি প্রচার করেন তা যে কেবলমাত্র বৌদ্ধধর্মেরই প্রচারপত্র ছিল তা বলা যায় না। সকল ধর্মের প্রতি উদার ও শ্রদ্ধাশীল অশোক সমস্ত ধর্মের মূল নীতিগুলোকেই গ্রহণ করেছিলেন এবং তার ধর্মের মূল কথা হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। বিদেশে বৌদ্ধধর্মে প্রচারের এ ব্যবস্থাকে সম্রাট অশোক নাম দিয়েছিলেন ‘ধর্ম বিজয়’। এর ফলে শুধু ধর্মীয় যোগাযোগই নয়, ওই সব দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিকটতর হয়েছিল!
বিহারের (মগধের) পাটলিপুত্র (বর্তমান পাটনা) প্রাচীন ভারতের রাজধানী ছিল! এই মগধ হল ষোড়শ মহাজনপদের একটি মহাজনপদ। মৌর্যসম্রাট বিন্দুসারপুত্র অশোক মগধের সিংহাসনে বসেন খ্রিস্ট-পূর্ব ২৭৩ অব্দে। ২৩২ খ্রিস্ট-পূর্ব পর্যন্ত ৪০ / ৪১ বছর রাজত্ব করেন। সিংহাসনে বসার ১২ বছর পরে তিনি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দ্বারা উড়িষ্যার কলিঙ্গ জয় করেন। তখন যুদ্ধই ছিল রাজ্য জয়ের প্রধান ব্যবস্থা। সেই যুদ্ধে প্রচুর লোক নিহত হয়। বিন্দুসারের সাতাশ বছর রাজত্বকালের পর এবং তাঁর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তাঁর পুত্রদের মধ্যে ‘অশোক’ , “প্রিয়দর্শী” উপাধি নিয়ে খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩ অব্দে মগধের সিংহাসনে বসেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর রাজ্য অভিষেক হয় চার বছর পরে অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৯ অব্দে। ইতিহাসের বিস্ময় পৃথিবীর সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট অশোক! শারদোৎসব অনাদিকাল ধরে চলে আসা এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতেই সূচনা হল ২৬১ খ্রিষ্টপূর্বে কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে সম্রাট অশোকের জীবনে এক আমূল পরিবর্তন সূচীত হয়।
সম্রাট অশোকের প্রার্থনা ছিল, “বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি।” ভারত সরকার কর্তৃক স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকায় সারনাথের অশোকচক্র এবং জাতীয় রাষ্ট্রীয় স্মারক চিহ্নে প্রতীক (EMBLEM) অশোক চক্রে বুদ্ধের উপদেশ সম্বলিত পরম পূজনীয় গৌতমবুদ্ধের দর্শন (প্রতীত্যসমূৎপাদ বা সমগ্র কার্যকারণ প্রবাহৃ) বিরাজমান। সম্রাট অশোকের শিলালিপির স্মৃতির সাগরে তীরে বৌদ্ধ ভারতের অতীত আজ ও দিল্লিস্থ ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনের দরবার প্রাঙ্গনে এখন সুদীর্ঘ ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ বিরাজমান যিনি ভারতের জনগণ ও শাসকবৃন্দকে আশির্বাদ করছেন। এর পাশে আছে সম্রাট অশোক হল, এখানে ভারতীয় মন্ত্রীরা শপথ নেন এবং বিদেশী রাষ্ট্রদূতগণ মাননীয় রাষ্ট্রপতির নিকট তাঁদের পরিচয় পত্র পেশ করেন। ভারত সরকার PALI & HINDI Buddhist Tripitaka (in 1957), ইংরেজি ভাষায় মূল্যবান গ্রন্থ ২৫০০ Years of Buddhism এবং “দি ওয়ে ওব দি বুদ্ধ” শীর্ষক গ্রন্থে গৌতমবুদ্ধের আগের (১) কনকমুনি বুদ্ধ এবং (২) কাশ্যপবুদ্ধের নাম সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে সগৌরবে বিরাজমান।
সম্রাট অশোকের নেতৃত্বে এবং তার গুরু ভন্তে মোগলীপুত্ত তিসস’র (Third Buddhist Sanghyana) সভাপতিত্বে এই প্রচলিত শারদ উৎসবের সময় পাটলিপুত্রে সংঘটিত হয় তৃতীয় বুদ্ধধম্ম সম্মেলন “ধম্মবিজয়”। কথিত আছে, সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতির শেষদিকে সম্মেলনের সভাপতি মো¹ণিপুত্ত তিস্স স্তবির বিভজ্জবাদ বা থেরবাদ প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে কথাবত্থু প্রন্থ রচনা করেন। কথাবত্থু (৫) বৌদ্ধ দর্শন সম্পর্কীয় তর্কশাস্ত্র বিশেষ বলা যায়। খৃষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে বুদ্ধগোষ ২৩টি অধ্যায়ে কথাবত্থুর উপর ভাষ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। প্রত্যেক অধ্যায়ে ৮ হতে ১২টি প্রশ্ন এবয় উত্তর দেওয়া হয়েছে। প্রশ্নগুলো সাধারণত বিধি প্রকার জটিল মিথ্যাদৃষ্টি সম্পর্কীয়।
সম্রাট অশোকের বিজয়া দশমী বা ধম্মবিজয় বেদাতীত কাল থেকেই চলে আসছে এই শারদ উৎসব। ২৬১ খ্রিষ্টপূর্বে কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে সম্রাট অশোকের জীবনে এক আমূল পরিবর্তন সূচীত হয়। সম্রাট অশোকের নেতৃত্বে এবং তার গুরু ভন্তে বিশ্বদার্শনিকতত্তে¡র মর্মভেদী দেবদূত এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু মোগলীপুত্ত তিসস’র সভাপতিত্বে এই প্রচলিত শারদ উৎসবের সময় পাটলিপুত্রে সংঘটিত হয় তৃতীয় বুদ্ধধম্ম সম্মেলন “ধম্মবিজয়”। শোকাতুর রাজা ঘোষণা করেন, “’অসুপুত্ত পপৌত্ত মে নবম্ বিজয়ম বিজিতব্যম”। আমার পুত্র এবং প্রপৌত্ররাও কোন নতুন রাজ্য যুদ্ধবিজয় করবে না।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “জগতের মধ্যে শ্রেষ্ট সম্রাট অশোক আপনার যে কথাগুলিকে চিরকালের শ্রুতিগোচর করিতে চাহিয়া ছিলেন, তাহাদিগকে পাহাড়ের গায়ে খুদিয়া দিয়াছিলেন। ভাবিয়া ছিলেন, পাহাড় কোনকালে মরিবে না, সরিবে না, অনন্তকালের পথের ধারে অচল হইয়া দাঁড়াইয়া নব নব যুগের পথিকদের কাছে এক কথা প্রতিদিন ধরিয়া আবৃত্তি করিতেই থাকিবে।
পাহাড়কে তিনি কথা কইবার ভার দিয়াছিলেন। “১৯৫৬ সালের ১৪ অক্টবর ঠিক ওই দশমী তিথিতে বাবাসাহেব আম্বেদকর নাগপুরে ৫ লাখ লোক নিয়ে (BUDDHIST MOVEMENT IN INDIA) প্রকাশ্য মাঠে এই বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করে ধমমে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। যুদ্ধের দ্বারা জয় নয়। অহিংসার দ্বারা জয়। এটাকেই বলা হয় অশোকের ধম্মবিজয় দিনকেই বেছে গ্রহণ করলেন বুদ্ধের পঞ্চশীল এবং অষ্টাঙ্গিক মার্গ। আজ শারদ শুক্লা দশমী। এক মানবিক ধম্ম দিশার অমলিন দিন। ১৯৫৬ সালের এই দিনে বাবা সাহেব ডঃ বি. আর আম্বেদকর নিপীড়িত, নিষ্পেষিত লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে স্বধম্মে পাবত্তন করেছিলেন। এই দিনে তার প্রতি রইল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। ভারতের প্রাচীন ধম্ম দেশনার এই মঙ্গলময় ও কল্যাণকারী শারদ উৎসবের শেষ দিনে আপনাদের সকলকে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করছি। স্বধম্ম পাবত্তনের জন্য। দলিত, নিপিড়িত, লাঞ্ছিত, শোষিত বহুজন মানুষকে সাংবিধানিক রক্ষা কবচের মাধ্যমে সুরক্ষিত করে ন্যায়, সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্ব প্রেমের উচ্চ মার্গে উন্নীত করলেন।
বহির ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ধর্ম বিজয়! রাজর্ষি অশোক কেবলমাত্র ভারতবর্ষের মধ্যেই ধর্মপ্রচার করে ক্ষান্ত হননি; বিদেশেও তিনি ধর্মপ্রচারে উদ্যোগী হন। এই উদ্দেশ্যে সিংহল, ব্রহ্মদেশ, সুমাত্রা প্রভৃতি দেশে ধর্ম দূত তিনি পাঠিয়েছিলেন। সিংহলে (Sri Lanka) অশোকের পুত্র মহেন্দ্র এবং কন্যা সংঘমিত্রাকে এবং মধ্য এশিয়ায় পুত্র কুণালকে ধর্মপ্রচারের জন্য পাঠান। সে সময় সিঙ্গল রাজ সিঙ্গল বাসীদের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হতে বিশেষ ভাবে প্রচেষ্টা নেন। শোন ও উত্তর নামে দুজন দূতকে অশোক ব্রহ্মদেশে পাঠিয়ে ফেলেন। এছাড়াও অশোক সিরিয়ার রাজা, মিশরের রাজা, GREEK মেসিডনের রাজা, এপিরাসের রাজাএবং উত্তর আফ্রিকার অন্তর্গত বিভিন্ন গ্রিক রাজন্যবর্গের রাজসভায় ধর্ম দূত এবং BUDDHIST MONKS প্রচারক পাঠিয়েছিলেন। বিদেশে ধর্ম প্রচারের এ ব্যবস্থাকে অশোক নাম দিয়েছিলেন ‘ধর্ম বিজয়’। এর ফলে শুধু ধর্মীয় যোগাযোগই নয়, ওই সব দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিকটতর হয়েছিল। এইভাবে অশোকের অক্লান্ত চেষ্টা ও কর্মকুশলতার জন্য একটি ক্ষুদ্র ধর্ম স¤প্রদায় পৃথিবীর বিশালতম ধর্ম সঙ্ঘে রূপান্তরিত হয় ।বুদ্ধ বন্দনার যে সকল ধর্মমত শুধু মগধ ও তার নিকটবর্তী স্থানে প্রচারিত করেছিলেন তা কেবলমাত্র প্রচারক হিসেবে অশোক তাকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মে পরিণত করেন ।
অশোকের সাম্রাজ্য! মৌর্য সাম্রাজ্যের সীমা অশোকের রাজত্বকালেই সবথেকে বেশি প্রসারিত হয় । উত্তর পশ্চিমে তাঁর সাম্রাজ্যের সীমা তৎকালীন সিরিয়ার রাজার সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান ও সিন্ধু দেশ তার সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। ধর্মপ্রচার সাম্রাজ্যের বাইরে: ১ শুধুমাত্র নিজের সাম্রাজ্যের মধ্যে ই নয় সাম্রাজ্যের বাইরে ও ভারতবর্ষে অন্যান্য রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে অশোক ধর্ম দূত পাঠিয়েছিলেন। তাই সুদূর দক্ষিণে চোল, পাণ্ড্য, কেরলপুত্র, সত্যপুত্র প্রভৃতি রাজ্য এবং উত্তরে হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে তিনি ধর্ম দূত পাঠিয়েছিলেন! ২৫৬৫ বছর পূর্বে শ্রীলংকার মহাবংশ এবং দ্বীপবংশ শীর্ষক ঐতিহাসিক গ্রন্থদ্বয়ের মতে রাজা বিজয় সিংহ বাঙালি ছিলেন! এবংবৌদ্ধধর্ম ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার মানসে সম্রাট অশোক ২৩০০ বছর পূর্বে ‘বৌদ্ধ ত্রিপিটক সহ সম্রাটের ভারতীয় বৌদ্ধ মিশন, সম্রাট অশোকের পুত্র বৌদ্ধভিক্ষু মহেন্দ্র (মহিন্দা) এবং কন্যা ভিক্ষুনী সংঘমিত্রা বঙ্গবীর বিজয় সিংহের সিংহল দ্বীপে (শ্রীলঙ্কা) প্রেরণ করেছিলেন!
শান্তির ললিত বাণী সম্রাট অশোকের ব্যথিত, অনুতপ্ত হৃদয়কে শান্ত করল; দিগ্বিজয় পরিণত হলো ধর্ম বিজয়ে; রণভেরি পরিবর্তিত হলো ধর্মভেরিতে। যুদ্ধপ্রিয় রাজা পরিণত হল এক পরম মানবপ্রেমিকে। শুরু হলো ধর্মপ্রচারের মধ্যে দিয়ে ‘এক ভারত ূভাতৃত্ববোধ’ নীতির প্রচার। ২৩০০ বছর পূর্বে” নানা ষড়যন্ত্রের দুর্ভেদ্য প্রাচীর বিদীর্ণ করে গৌতমবুদ্ধের অহিংস নীতিতে দীক্ষা নিয়ে সম্রাট অশোক মানবাধিকারের ঘোষণা ছিল “অহিংসা পরম ধর্ম” শিলালিপিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। সম্রাট অশোক বৈদিক প্রাণী হত্যামূলক যজ্ঞ এবং জাতিভেদ প্রথা আইন করে বন্ধ করে দিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এ ঘটনার পরবর্তীকালে সুখে, দুঃখে অনুতাপে এবং মনুষ্য জাতির প্রতি সমবেদনায় অশোক প্রতিজ্ঞা করলেন যে জীবনে আর কখনও যুদ্ধ করবেন না। হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্ঠানসহ সকল মানব সন্তান মিলে আমাদের মানবজাতি। আমাদের জাতীয় বিবেকের জবাবদিহিতার শক্তি মরে ধর্ম নামক বিভিন্নভয় ভীতির কবলে। কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ভাষায়, “গোত্র দেবতা গর্তে পুরিয়া, / এশিয়া মিলাল শাক্যমুনি (গৌতমবুদ্ধ)। কলিঙ্গ বিজয় এবং প্রতিক্রিয়া!
রাজত্বের প্রথম দিকে অশোক তার পূর্বপুরুষদের অনুসৃত যুদ্ধ দ্বারা রাজ্য বিস্তারের নীতি অনুসরণ করেন। রাজ্য অভিষেকের আট বছর পর ওড়িশার বৈতরণী নদী থেকে গোদাবরি সন্নিহিত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত পরাক্রান্ত কলিঙ্গ রাজ্যটি তিনি আক্রমণ করেন এবং জয়লাভ ও করেন। তবে জয়লাভ করলেও যুদ্ধের পরিণতি অশোককে বিশেষ ভাবে ব্যথিত করেছিল। তার ত্রয়োদশ শিলালিপিতে অশোক উল্লেখ করে গেছেন যে সেই যুদ্ধে দেড় লক্ষ সৈন্য বন্দি হয়, এক লক্ষ্য সৈন্য নিহত হয় এবং এর বহুগুণ মানুষ মারা যায়। এই যুদ্ধে বহু নগরগ্রাম ছারখার হয়ে যায়। যুদ্ধে, দুর্ভিক্ষে, মড়কে কলিঙ্গ শ্মশানে পরিণত হয়। যুদ্ধের এই ভীষণ অভিশাপে সম্রাটের মনে দুঃখের প্লাবন বয়ে যায়।জীবের দুঃখ একদিন যেমন গৌতমকে পরিণত করেছিল বুদ্ধে; তেমনি কলিঙ্গ যুদ্ধ ‘চণ্ডাশোক’ কে রূপান্তরিত করল ‘ধর্মাশোকে’ ।
বিশ্ববৌদ্ধ পুরস্কার প্রাপ্ত প্রখ্যাত মানবতাবাদী লেখক সোনা কান্তি বড়ুয়া (Bachelor of Arts, University of Toronto), সাবেক সভাপতি, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, টরন্টো, খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, কথাশিল্পী, বিবিধগ্রন্থ প্রনেতা প্রবাসী কলামিষ্ঠ, লাইব্রেরীয়ান, বিশ্ববৌদ্ধ সৌভ্রতৃত্ব পত্রিকার সহ সম্পাদক এবং জাতিসংঘে বিশ্ববৌদ্ধ প্রতিনিধি!