অনলাইন ডেস্ক : ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে মঙ্গলবার (১৭ নভেম্বর) জাতীয় সংসদে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল-২০০০’ বিল পাস হয়েছে। এতে বিদ্যমান আইনের ‘ধর্ষিতা’ শব্দটির বদলে ‘ধর্ষণের শিকার’ শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা বিলটি পাসের প্রস্তাব করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।
দেশজুড়ে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলন এবং ধর্ষণকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবির প্রেক্ষাপটে সরকার আইনটি সংশোধনের পদক্ষেপ নেয়। সংসদ অধিবেশন না থাকায় সংশোধিত আইন কার্যকর করতে গত ১৩ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০০০’ জারি করেন।
পরে ৮ নভেম্বর নিয়ম অনুযায়ী অধ্যাদেশটি সংসদে তোলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। একই দিনে সেটি বিল আকারে সংসদে তোলা হয়।
২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) উপ-ধারায় বলা ছিল—‘যদি কোনও পুরুষ কোনও নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।’
বিলে মূল আইনের খসড়ার ৯(১) উপ-ধারায় ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
আইনের ৯(৪) (ক) উপ-ধারায় ছিল—‘যদি কোনও ব্যক্তি কোনও নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।’
এই উপ-ধারা সংশোধন করে পাস হওয়া বিলে ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’-এর পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলো যোগ করা হয়েছে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ধর্ষণ ছাড়া সাধারণ জখমের ক্ষেত্রে অপরাধ আপসযোগ্য হবে। এছাড়া আগের আইনে ১৯৭৪ সালের শিশু আইনের রেফারেন্স ছিল। এখন সেখানে হবে ‘শিশু আইন-২০১৩’।
২০০০ সালের আইনের ৩২ ধারায় বলা ছিল—‘এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধের শিকার ব্যক্তির সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মেডিক্যাল পরীক্ষা সরকারি হাসপাতালে কিংবা সরকার কর্তৃক এ উদ্দেশ্যে স্বীকৃত কোনও বেসরকারি হাসপাতালে সম্পন্ন করা যাবে।’
নতুন বিলে অপরাধের শিকার ব্যক্তির পাশাপাশি ‘অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির’ মেডিক্যাল পরীক্ষা করার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া ৩২ ধারার সঙ্গে ৩২(ক) শিরোনামে নতুন একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছে বিলে।
সেখানে বলা হয়, এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং অপরাধের শিকার ব্যক্তির ধারা ৩২-এর অধীন মেডিক্যাল পরীক্ষা ছাড়াও, ওই ব্যক্তির সম্মতি থাকুক বা না থাকুক, ২০১৪ সালের ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) আইনের বিধান অনুযায়ী, তার ডিএনএ পরীক্ষা করতে হবে।
বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সামাজিক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের প্রাগ্রসরমান ধারা আজ বিশ্বব্যাপী নন্দিত ও প্রশংসিত। বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ঊর্ধ্বগামী পরিক্রমণের মধ্যে দেশে নারী ও শিশু ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটন, সামাজিক গতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব রাখাসহ সার্বিক সামাজিক উন্নয়নের ধারাকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এইরূপ হীন অপরাধ দমনে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণার্থে দণ্ডারোপের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা গ্রহণ সময় ও পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় অত্যাবশ্যক।’
বিল নিয়ে সংসদে যা বললেন আইন প্রণেতারা
বিলটি পাসের প্রক্রিয়া চলার সময় জাতীয় পার্টি (জাপা), বিএনপি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাব তুলে খসড়া আইনটির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন।
জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটের এমসি কলেজের হোস্টেলে ধর্ষণের ঘটনা, অনেক ঘটনার পর সারাদেশে ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। মানুষ ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ থেকে সমাবেশ করেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় মন্ত্রিসভায় এই আইনে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘আরেকটি বিষয় ধর্ষণকারী ও এর শিকার উভয়ের ডিএনএ টেস্ট বাধ্যতামূলক। সম্মতি ছাড়াই করা হোক। আগের আইনেও ডিএনএ পরীক্ষার সুযোগ ছিল, আদালতে চ্যালেঞ্জ করলে করা যেতো। এই যে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তা সরকারি ব্যয়ে করা হবে? না অভিযুক্ত বা অভিযোগকারী কে ব্যয় বহন করবে তা পরিষ্কার না।’
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, ‘অত্যন্ত ভালো ও জরুরি আইন। কিন্তু আইনে ব্যত্যয় ঘটেছে। অর্ডিন্যান্স যখন আইন হয়—তখন হুবহু বিলটা হতে হয়। কিন্তু কমিটি থেকে ঘুরে এসে কীভাবে সংশোধনী… সেটা মূল আইনের সংশোধনী। অর্ডিন্যান্স আইন হলে হুবহু হবে। সংশোধন আনতে হলে পরে আনতে হবে।’
বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, ‘নারীদের দুর্ভাগ্য পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশ নয়—এখন নারীবিদ্বেষী সমাজ। বলা হয়, ধর্ষণ হলে নারীর সম্ভ্রম হারিয়ে গেছে, কিন্তু হারানোর কথা পুরুষের। অনেক নারী মুখ খুলতে চান না পরিবার ও সমাজের চাপে। যে চোখে সমাজ দেখে, মামলা উঠলে যে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, সে কারণে মামলা করতে চায় না। যে কারণে মামলা কম। যেগুলো হয় সাজার হারও খুব কম। তিন শতাংশের ক্ষেত্রে সাজা হয়। ৯৭ শতাংশ ছাড়া পাচ্ছে। বর্তমানে যখন পারছি না, সাজা বাড়িয়ে কতটুকু করতে পারবো, সে প্রশ্ন করা যায়। মাদকে ২৫ গ্রামের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে, কিন্তু তাতে কি মাদক ব্যবহার কমেছে?’
জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘ধর্ষণ ঘটছিল, কিছু আন্দোলন হলো। অর্ডিন্যান্স করলেন। কোনও দরকার ছিল না। ইমিডিয়েট অ্যাকশন যখন প্রয়োজন, তখন অর্ডিনেন্স।’
তিনি বলেন, ‘এই আইন নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার দরকার ছিল। ম্যারিটাল রেপ চলে আসছে। অনেক স্ত্রী বাড়িতে শিকার হন। সেম সেক্স, পুরুষ শিশুকে ধর্ষণ করলে কী হবে কোথাও নেই। ক্রস এক্সামে নারীর দ্বিতীয়বার চরিত্র নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। সে বিষয়ে কোনও নির্দেশনা নেই।’
বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, ‘ইসলাম ব্যভিচারকে হারাম করেছে। ধর্ষণ সব অপরাধের চেয়ে গুরুতর। শাস্তি কঠোরতর। ইসলামি ফাউন্ডেশন, আলেমদের মতামত নেওয়া দরকার ছিল। আইন করতে যাচ্ছি। অর্ডিন্যান্স জারির পর আজকের পত্রিকায় আছে ধর্ষণ হচ্ছে। মৃত্যুদণ্ড বাড়িয়ে ধর্ষণ প্রতিরোধ হবে না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি—ধর্ষণের পথ বন্ধ করতে গেলে ইলিগ্যাল সেক্সুয়াল রিলেশন অপরাধের মধ্যে আনতে হবে।’
স্বতন্ত্র সদস্য রেজাউল করিম বাবলু বলেন, ‘আল্লামা আহমদ শফীকে তেঁতুল হুজুর বানানো হয়েছে। তো সেই তেঁতুল তত্ত্বের যদি প্রচলন করা যায়, তবে ধর্ষক বাড়বে না। নারীবাদীরা সবকিছু উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন। এজন্য কঠোর আইন করার আগে ধর্ষণ যাতে না বাড়ে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।’