মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

ছিয়াত্তর…
‘দ্য ন্যাশনাল এনার্জী প্রোগ্রাম’ এবং এর ফলে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সেখান থেকে আমাদের বেশ কিছু শিক্ষা হয়েছিল। এর মধ্যে তিনটা ছিল আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম এবং সবচেয়ে বেশী যে বিষয়টা ভাবনার ছিল, সেটা হচ্ছে, সম্পদের উন্নয়ন এবং এর সঠিক তত্ত¡াবধানের জন্য যে নিয়ম নীতি আমরা প্রণয়ন করি, সেটা অনেক বড় বড় ইস্যুর মধ্য একটা যা দেশের সাফল্যের বিষয়টা তুলে ধরে। এটা এখন আরও বেশী বিতর্কের একটা ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে, কারণ এটা হয়েছিল আমার বাবার সময়ে। এটা অবশ্যই এমন একটা বিষয় যেটা অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উভয় দিক থেকে গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু এটাতো ছিল মূলত মেলবন্ধনের একটা ব্যাপার, যেটা একটা অঞ্চলের মঙ্গলের জন্য করা। প্রকৃতি অবশ্যই এমন কিছু প্রত্যশা করে না, যে এক অঞ্চলের সম্পদ অন্য অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া হোক। ফলে যেটা হচ্ছে, এবং ভবিষ্যতেও হবে এবং যেটা অনেক বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে, কানাডার এই সম্পদের উন্নয়নে কি করা হবে। যদি একটা দেশের কিছু সমস্যা থাকে, তবে অবশ্যই এটা একটা উল্লেখ করার মত সমস্যা। এগুলো অবশ্যই এমন কিছু, যেগুলো আমাদের জন্য বাণিজ্য করা যাবে না। বলা হয়, এটা কানাডার এক অপরিবর্তনীয় সত্য, আমাদের অঞ্চলগত যে বৈচিত্র্য আছে, সেটার অবশ্যই এক সামঞ্জস্যতা বজায় রাখতে হবে। ফলে ফেডারেল সরকার যখন অন্য অঞ্চলের চেয়ে কোন বিশেষ অঞ্চলকে প্রাধান্য দেয়, বা কোন রকম পক্ষপাতিত্ব করে, তখন এই এক পক্ষতার বিষয়টা সারা জীবনের জন্য কালিমা লেপে দেয়।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ‘দ্য ন্যাশনাল এনার্জী প্রোগ্রাম’ এবং এর নেতিবাচক ফলাফল আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল, রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব চরিত্র হচ্ছে একটা বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত। আমি অবশ্যই এটাকে কোন নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছি না। একটা বহুজাতিক দেশ যখন জাতীয়ভাবে স্থানীয় পরিচয়কে গুরুত্ব দেয়, তখন তাদেরকে সত্যিকারভাবে মূল্য দিতে হবে যেন কাজে ও কর্মে তাদের বিষয়টা প্রাধান্য পায়। তুমি পানোকা, উইনইয়ার্ড এবং নীপাওয়ার কোন কফি শপে তোমার চোখ মুখ নীল হওয়া না পর্যন্ত সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে তর্ক করতে পারো যে কোন নীতি পশ্চিম কানাডার জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে, কিন্তু তুমি যদি সঠিক মানুষকে এই তর্কে না পাও, তাহলে এই তর্ক-বিতর্ক কোন সমাধানের পথে এগুবে না। সে কারণে আমার এই প্রচারণায় আমি খুবই গুরুত্ব দিয়েছিলাম আমাদের দলে বয়োজ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা এবং সংগঠক হিসেবে এলাকার সবচেয়ে ভালো ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিতে, যারা পরবর্তীতে লিবারেল পার্টির ব্যানারে পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করবে। আমরা যতই অত্যাধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করি না কেন, বা সাফল্য আর ব্যর্থতা নিয়ে যতই গবেষণা করে পদক্ষেপ নিই না কেন, সমাজের কাছে ভালো আর গ্রহণযোগ্য মানুষের কোন বিকল্প নেই।

শেষে বলতে চাই, ‘দ্য ন্যাশনাল এনার্জী প্রোগ্রাম’ পশ্চিম কানাডা সম্পর্কে আমাদেরকে বিশেষ এবং ইতিবাচক কিছু শিক্ষা দিয়েছিল। আমাদের র?্যালীতে প্রেস্টন ম্যানিং যখন চিৎকার করে বলে উঠেছিল ‘দ্য ওয়েস্ট ওয়ান্টস ইন’, সেটা সত্যি সত্যিই সবার নজর কেড়েছিল। এই শ্লোগানটার মধ্যে একটা আশা উদ্রেক করার একটা ব্যাপার ছিল এবং কানাডা সম্পর্কে পশ্চিমাদের আরও ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছিল। শ্লোগানটায় কিন্তু বলা হয় নি, ‘দ্য ওয়েস্ট ওয়ান্টস আউট’। এই বিষয়টি পশ্চিমাদের ভালোভাবে চিত্রিত করেছিল। কারণ, কাউকে কোন মহাযজ্ঞের বাইরে রেখে গোটা দেশের জন্য কোন ভালো কিছু করা সম্ভব নয়। তুমি যখন একটু সময় নিয়ে বিষয়টা চিন্তা করবে, তখন অনুধাবন করবে, কি এক অসাধারণ অর্জন ছিল সেটা, বলা যেতে পারে এটা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছিল অনন্য।

আমি জানি, এটা একটা বিতর্কিত দাবী হতে পারে, কিন্তু আমি মনে করি, হার্পারের কনজারভেটিভরা ভুলেই গিয়েছিল কনজারভেটিভ পার্টির সাফল্যের মূলে কী ছিল।

২০১২-১৩ সালের নেতৃত্বের প্রচারণার অধিকাংশই হয়েছে কানাডার কনকনে শীতের সময়। ঐ সময়ের অধিকাংশই আমি কাটিয়েছিলাম কানাডার পশ্চিম দিকে। সেই সময়ের অনেক মনে রাখার মত স্মৃতি আমার মানসপটে গেঁথে আছে। তবে কাম্পলুপ্স এর এক শীতার্ত সন্ধ্যার ঘটনা আমার অন্য সব স্মৃতিকে বারে বারে ছাপিয়ে যায়। সেই দিনগুলোর মতই সেটা ছিল এক দিন যখন সূর্য উঠার পর খুব তাড়াতাড়িই সেটা অস্ত গিয়েছিল। আমরা এত দূরে ছিলাম যে সে এলাকায় লিবারেল এর নাম গন্ধ তেমন ছিল না। ওকানাগান এ সারাদিন প্রচারণা চালাবার পর আমরা প্রচারণার ভলিন্টিয়ার্সদের সাথে একটা মিনিভ্যানে করে অসোইয়ুস এবং কেলোওয়ানা হয়ে উত্তর দিকে কোকুইহাল্লার দিকে যাচ্ছিলাম। আমরা থম্পসন রিভার্স ইউনিভার্সিটি’তে একটা ছোট রুম ভাড়া নিয়েছিলাম, আমাদের পরিকল্পনায় ছিল এলাকার অল্প কয়েকজন কিন্তু নিবেদিত প্রাণ লিবারেল কর্মীদের সাথে আলাপ করবো। আমরা সেই জায়গায় উপস্থিত হবার মাত্র কিছুক্ষণ আগে আমার এই প্রচারণায় যিনি আমাদের সাথে সব সময় আছেন, সেই গ্যারি ব্যাটস এর কাছে একটা ফোন এলো। ফোনটা এসেছে সেখানকার আয়োজনের দায়িত্ব যার ছিল, তাঁর কাছ থেকে। তিনি জানালেন, একটা সমস্যায় পড়েছেন তিনি। এই সমস্যায় তিনি কিছুটা হিমশিম খাচ্ছেন। তিনি গ্যারিকে বললেন, তাদের প্রত্যাশার চেয়ে পাঁচ শ জন বেশী উপস্থিত হয়ে গেছে, এখন একটা বড় জায়গা না নেবার কোন বিকল্প নেই।

সেই মানুষগুলোর অনেকেই এসেছিল লিবারেল পার্টি সম্পর্কে জানতে, আর অন্যরা এসেছিল নিজেদের অপ্রাপ্তি থেকে। যাদের মধ্যে ঔৎসুক্য ছিল, তারা লিবারেল পার্টি সম্পর্কে খুব ভালো কিছু জানতো না, আর তারা যেটা জানতো সেটা লিবারেল পার্টি সম্পর্কে সঠিক কিছু নয়। আমি তাদের সাথে প্রশ্ন ও উত্তরের মাধ্যমে এই পার্টি এবং এর পরিকল্পনা সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা দিয়েছিলাম, যেটা আমি সব সময় আমার প্রচারণায় করে থাকি। এদের মধ্যে একজন ছাত্র আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘রাজনীতি কিভাবে করতে হবে সেটা আমি আমার বাবার জীবন থেকে কেমন শিখেছি’। আমি শুধু বলেছিলাম, ‘যখন আমি স্যালমন আর্ম (ব্রিটিশ কলম্বিয়ার একটা ছোট শহর)এ, তখন আমি আমার পাঁচ আঙ্গুল নাড়িয়ে সবাইকে আপন করতে চাই।’ আমার প্রচারণায় অনেক সময়ই আমার নিরস কৌতুকের মাধ্যমে সবাইকে আমার আসল কথাটা বুঝাতে ব্যর্থ হই, কিন্তু এটা বলার পর লক্ষ্য করলাম সবাই আনন্দ আর হাসিতে উচ্ছ¡সিত হয়ে পড়লো।

আদিবাসী পোশাকে জাস্টিন ট্রুডো (ডানে)

আমার সু² পর্যালোচনায় আমি অনুধাবন করতে পারলাম, সেই জমায়েত হওয়া মানুষগুলোর অনেকেই এসেছে তাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে। তারা যে দলকে পছন্দ করে তাদের প্রতিনিধিদের অটোয়ায় পাঠিয়েছিল, তারা তাদের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য কিছুই করে নি এবং সেই পার্টিও তাদের চিন্তা ভাবনা বা প্রত্যশাকে কোন মূল্য দেয় নি। কনজারভেটিভ পার্টি বার বারই উচ্চারণ করে, তাদের এই সাফল্যের জন্য তারা প্রধানত ঋণী তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে, কিন্তু হার্পার মূলত এই তৃণমূল পর্যায়ের মানুষদের ব্যবহার করেছে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর পদ পরিষ্কার করার জন্য। এটা সত্য, গত কয়েক দশকে কোন সরকারই এই মানুষদের নিয়ে ভাবেন নি, এবং এমপি’দের তেমন কোন ক্ষমতায়ন হতে দেয় নি, এবং এই আধুনিক যুগে সংসদীয় গণতন্ত্রকে সফল হতে দেয় নি। বলা হয়, বর্তমান সরকার ব্যস্ত নতুন নতুন বক্তব্য দেয়া আর পার্টির শৃংখলাকে আরও মজবুত করায়। আমি জানি, এই মানুষগুলো এগুলো শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আমি এগুলো আমার প্রচারণা চালাতে গিয়ে বার বার শুনেছি। সব শেষে আমি সেই একই কথা বলেছিলাম, যা কানাডার পশ্চিম দিকের প্রচারণায় আমি সব সময়ই উল্লেখ করতাম, ‘আপনার অটোয়ায় আপনাদের প্রতিনিধি পাঠানোর জন্য ভালো মানুষকে নির্বাচিত করুন। আপনারা কখনই শুধু স্টিফেন হার্পারের কথা আপনাদের কমিউনিটিতে বাজতে দিয়েন না।’

আমার এই কথাটা বলার পর, আমি কখনই এক সাথে এত মানুষকে মাথা নেড়ে আমাকে সমর্থন করতে দেখি নি।
কানাডার মানুষ সব সময় জানতে চায়, সত্যি সত্যিই কি তাদের ভোটের মূল্য আছে! ‘পার্লামেন্ট কিভাবে কাজ করে’ – এ বিষয়টা বলার জন্য সেই রাতে সবাইকে উপস্থিত হওয়ার আয়োজন করা হয় নি। আসলে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তারা যাদেরকে নির্বাচিত করে পার্লামেন্ট এ পাঠান তাঁরা কিভাবে তাদের প্রত্যাশাকে পার্লামেন্ট এ উপস্থাপিত করে। অথবা যারা নির্বাচিত হন, তাঁরা কিভাবে তাঁদের এলাকার মানুষের প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দিয়ে সেই মত কাজ করে এবং তাদের প্রয়োজনকে মিটানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
জনগণ এখন বুঝতে পারে বিগত সময়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে প্রত্যাশিত বিষয়গুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তারা জানে যখন তাদের এমপি কথা বলেন, সেটার মধ্যে তাঁদের এক ব্যর্থতার চিহ্ন দেখা যায়, তাঁরা সত্যিকারভাবে বা বলিষ্ঠভাবে কিছু বলতে পারে না, অথচ এমন কিছু বলার কথা ছিল তাঁদের। মিস্টার হার্পারের একগুঁয়েমির ফলে তাঁর ককাস থেকে শুরু করে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সেই সব প্রতিনিধিরা এখন আর তেমন কিছুই করতে পারে না। আমি মনে করি, নেতা নির্বাচনে এটা একটা মারাত্মক ভুল, আর সেই কারণেই আমার কিছু বিশেষ পরিকল্পনা আছে, যা এই সমস্যার সমাধান করার জন্য কার্যকরী ভ‚মিকা পালন করবে।