মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।
ছত্রিশ.
আমি ঘোড়াচালিত গাড়িতে করে একেবারে তার দরজার সামনে গিয়ে তাকে তুলতে পারিনি। বেশ কয়েক বছর আমি ভক্সওয়াগন জেট্টা টিডিয়াই চালাতাম। যখন ব্রিটিশ কলম্বিয়ায় থাকতাম, তখন সেই গাড়িই ছিল আমার ভ্যাংকুভার আর মন্ট্রিয়লে আসা যাওয়ার একমাত্র বাহন। কিন্তু ঐ গ্রীষ্মে আমার সেই জেট্টা’টা চুরি হয়ে গিয়েছিল, আর ঐ সময়ের মধ্যে আমি আর নতুন গাড়ি কিনিনি। ওর পরিবর্তে আমি মিশেলের ফোর্ড ব্রোনকো’টা চালাতাম, ঐ গাড়িটার সাথে আমার আবেগের একটা সম্পর্ক ছিল, কিন্তু ঐটা দিয়ে আমার খুব বেশি কাজ হচ্ছিল না। মিশেলের মৃত্যুর পর সেটা সেই শীতের সারাটা সময় কোকানী হিমবাহের ওপরের রাস্তায় বরফের নীচে ঢাকা পড়েছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সেই গাড়িতে মরিচার যে গন্ধ লেগেছিল সেটা দূর করতে পারিনি। সোফি এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ করেনি এটা সত্যি, কিন্তু এটা নিয়ে সে কিছুটা হাসাহাসি করেছিল।
সেই ডিনারে খেতে খেতে আমরা শত শত বিষয় নিয়ে কথা চালিয়ে গিয়েছিলাম, তবে আমাদের কথায় মিশেল, আমার বাবা আর সেই আশির দশকের বিভিন্ন স্মৃতি ঘুরে ঘুরে আসছিল। সোফি তার সেই স্কুলের দিনগুলো থেকে শুধু মিশেলকেই চিনতো না, বরং তার বন্ধুদের মাধ্যমে প্রায়ই সে স্কি হিল এ শাসার সাথে কথা বলতো।
তখন আমার এমনটা মনে হচ্ছিল, আমরা দু’জন একই সাথে এক সমান্তরাল জীবনের পথে হাঁটছিলাম যেটা শেষ পর্যন্ত একে অপরের সাথে মিলে মিশে একেকার হয়ে গেলো। আমার মনে হয় কোনো এক মেয়ের প্রতি আকর্ষিত হওয়ার এক জরুরি বিষয় হচ্ছে, তার চমৎকার সুন্দর প্রকাশ ভংগি, সৌন্দর্য আর সাবলীলতা। সোফি ছিল এমন এক মেয়ে যার মধ্যে ঘনিষ্ঠ হওয়ার যে সব গুণগুলো থাকার প্রয়োজন তার সব কিছুই ছিল। এখন বিষয়টা দু’জনকেই খুব হাসায়, যখন সে বলে সেই সময়টা ছিল আমাদের প্রেমে ঘনিষ্ঠ হওয়ার এক চরম ‘অস্বস্থিকর স্বস্থিদায়ক পরিস্থিতি’। কিন্তু দু’জনের এই বুঝাপড়ার মধ্যে যদি হৃদয়ের সুরের ঐক্যতান না থাকে তাহলে শুধুমাত্র বাহ্যিক আকর্ষণের মাধ্যমে দু’জনের হৃদয়ের ইশারায় কি বলতে যাচ্ছি, সেটা বুঝা দূরুহ হয়ে পড়ে। সেই ইশারার কাজটা অনেকটায় সম্ভব হয়েছিল আমার পরিবার বিশেষ করে আমার বাবা আর ভাইদের কারণে। সেই জন্য এটাকে একেবারে কাকতলীয় বলা যাবে না যে আমি আপনা আপনি এই অপূর্ব সুন্দর মেয়েটার দিকে এমনি এমনিই আকৃষ্ট হয়েছিলাম আর সেও আমার প্রতি এতো বেশি টান অনুভব করছিল। সোফি আমাদের পরিবারকে খুব ভালোভাবে জানতো আর জানতো আমরা সবাই কেমন ধরনের মানুষ।
আমাদের দু’জনের মধ্যে যে গভীর আর সুন্দর ভালোবাসা গড়ে ওঠেছিল তার অন্যতম কারণ ছিল আমাদের দু’জনের এক ঘনিষ্ঠ অতীত ছিল আর আমাদের দু’জনেরই সংস্কৃতি ও মূল্যবোধে ছিল এক পরম মিল। বিষয়গুলো ছিল এমনই যে এগুলোর কোনো ব্যাখ্যা হয় না, সম্ভবত শত চেষ্টা করেও এগুলোকে ব্যাখ্যা করা যায় না। এগুলোর ফলে যাকে জীবনের সঙ্গী হিসেবে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়, তার সম্পর্কে জানার বা অনেক বেশি খোঁজ খবর নেয়ার আর কোনো প্রয়োজন পড়ে না। সেই ডিনারের পর আমার এটাও মনে হয়েছিল, আমার মন্ট্রিয়লে ফিরে আসার একটা অন্যতম কারণ ছিল সোফি, যদিও তখন আমি ওর নামটাও জানতাম না। আমি তাকে আকৃষ্ট করার জন্য সেই সময় বাড়িয়ে কোনো প্রেমময় বাক্য আওড়াতে চাইনি, সে জন্য আমি ওসব না বলে শান্ত থাকার চেষ্টা করেছিলাম। ডিনারের শেষে আইস্ক্রিমের খোঁজে যখন আমরা রু প্রিন্স-আর্থার ফুটপাত ধরে হাঁটছিলাম, তখন সোফি হঠাৎ বলে উঠেছিল, ‘চলো কারোকী’তে যাই! খুব মজা হবে।’
সেই সময় কারোকী’টা এত চলতো যে অধিকাংশ বারগুলোতে ঐ সময়ের মধ্যে সব ফুরিয়ে যেতো। কিন্তু আমি রু দ্য লা মন্তাগনি’র এক এশীয় বার এ ঢুকে দেখলাম ওখানে সৌখিন গায়করা গান গেয়ে চলেছে। ওটা দেখে আমরা ব্রোনকো’তে করে সেখানে গিয়ে ঢুকলাম এবং সেখানে বসে মওলীন রগ ছবির সাউন্ডট্রাকে গলা মিলিয়ে দু’জন গান গাওয়া শুরু করলাম। সোফির গানের গলাটা সত্যিই চমৎকার ছিল, আমারটা তেমন ছিল না। তবে ওটাতে এমন কিছু যায় আসেনি। আমি ধীরে ধীরে তার প্রতি আরো বেশি বিমোহিত হয়ে পড়ছিলাম এবং আমার বারবার মনে হচ্ছিল, আমি একটা আনন্দ আর প্রশান্তি খুঁজে পাচ্ছি যা আমি পূর্বে কখনো পাই নি। আমি তখন একই সাথে অস্থির আর নিরাপদ বোধ করছিলাম এবং সেই অপূর্ব সুন্দর এক সুখানুভূতি আমাকে কিছুটা এলেমেলো করে তুলছিল, সেটা এমন হয়ে যাচ্ছিল যে, আমি বার থেকে বের হয়ে একটা ল্যাম্পপোস্টের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেটা আমার জীবনের প্রথম ডেটিং হওয়ায় আমি কিছুতেই সোফি’কে বুঝাতে পারছিলাম না যে, আমি আসলে কোনো বিষয়ে এমন লাজুক বা ভড়কে যাওয়ার বান্দা নই, তবে এই ব্যাপারটা অর্থাৎ সেই রাতে আমার ওমন আচরণটা সত্যি সত্যিই তাকে ভালোভাবে অনুধাবন করাতে আমার কয়েক বছর লেগে গিয়েছিল।
সেই রাতে আমার এপার্টমেন্টে ফিরে সোফায় বসে ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত কথা চালিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা যতই নিজেদেরকে একে অপরের কাছে উন্মুক্ত করছিলাম, আমরা ততই একে অপরের ঘনিষ্ঠ হচ্ছিলাম, এবং আমাদের কথাবার্তায় মূলত আমাদের বেদনা রাজ্যের স্মৃতিগুলোই বারবার ফিরে ফিরে আসছিল। সোফি তার স্কুল জীবনে বুলিমিয়ার বিরুদ্ধে নিজের সুস্থ সাবলীলভাবে লড়াই চালিয়ে যাবার গল্প করছিল, সেই সাথে সে জানাচ্ছিল পিতা মাতার একমাত্র সন্তান হওয়ায় কিভাবে নিঃসংগতার মধ্য দিয়ে তাকে দিন অতিবাহিত করেতে হয়েছে। আমাদের এই স্মৃতিচারণে আমি তাকে জানিয়েছিলাম, কেমন ঝঞ্ছা-বিক্ষুব্ধ শৈশব আমি পার করে এসেছি।
যেহেতু আমাদের প্রথম দিনেই আমরা খুবই কাছাকাছি চলে এসেছিলাম, আমি কিছুটা ঘোরের মধ্যেই বুঝতে পারছিলাম যে, আমি জীবনে যে কয়েকজন মেয়ের সাথে কথা বলেছি, তাদের মধ্যে সোফিই হচ্ছে শেষজন যাকে নিয়ে আমি ঘর বাঁধার কথা ভাবতে পারি। আমার এই অনুভূতিটা সেই সময় এত প্রবলভাবে কাজ করছিল যে, আমি তাকে বলেই বসলাম, ‘আমার বয়স একত্রিশ, আর এই একত্রিশ বছর বয়সে আমার মনে হচ্ছে, আমি এই সারাটা সময় আমি শুধু তোমার জন্যই অপেক্ষা করেছিলাম।’ আমি একটু থেমে আবার তাকে বলেছিলাম, ‘আমরা কি বন্ধুত্বের সম্পর্ক ডিঙ্গিয়ে সোজাসুজি এংগেজমেন্টের কথা ভাবতে পারি, যেহেতু আমরা আমাদের বাকী জীবন একসাথে কাটাতে চাচ্ছি।’ আমাদের দু’জনেরই এই প্রবল আবেগ আর উচ্ছ্বাস এমন এক বাঁধ ভাংগা অবস্থায় গড়িয়েছিল যে, দু’জনেই দু’জনকে ওভাবে আবিস্কার করে আর দু’জন দু’জনকে পাওয়ার আনন্দে আমরা একই সাথে হেসেছিলাম আর কেঁদেছিলাম। আমাদের জীবনে হঠাৎ করেই এমন এক মুহূর্ত দমকা বাতাসের মত আসায় আমরা দু’জনের আর কি কথা বলবো সেটা ভেবে দু’জনেই নির্বাক হয়ে পড়েছিলাম। আমি যখন তাকে তার বাসায় নামাতে গেলাম, তখন অনেক পাওয়ার আনন্দে ভরপুর হয়েছিলাম, ওটা অন্যরকম এক আনন্দের, কিন্তু সেই সাথে এক অপার পাওয়ার আনন্দে একেবারে নীরবও হয়ে গিয়েছিলাম। (চলবে)
মনিস রফিক ঃ চলচ্চিত্রকর্মী, টরন্টো, কানাডা