অনলাইন ডেস্ক : করোনার বছরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমলেও মূলধন সংরক্ষণ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি, বরং ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি ১০টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা (২৮ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা)।
গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১১ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ১৯ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত তিন মাসে এ ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। আর ২০১৯ সালে ডিসেম্বরে ১২ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল ২৩ হাজার ৬১২ কোটি টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেওয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসাবে সংরক্ষণ করা হয়। কোনো ব্যাংক মূলধনে ঘাটতি রেখে তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ায় মূলত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ঋণের গুণগত মান বাড়ানো ছাড়া মূলধন পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। এজন্য ঋণের গুণগত মান বাড়াতে প্রথমত খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে নতুন ঋণ বিতরণের আগে ভালোভাবে যাচাই করে দিতে হবে। ঋণটা সঠিক খাতে ব্যবহার হচ্ছে কিনা, তা দেখতে হবে।
এছাড়া সব ধরনের অপচয় রোধ করে আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মূলধন পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ কম দেখালেও প্রকৃত খেলাপি ঋণ তো অনেক বেশি।
বিপুল অঙ্কের ঋণ অবলোপন এবং ঋণ পুনঃতফসিল হচ্ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে অধিকাংশ ঋণের মান ভালো না। সে কারণে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে হয়। এছাড়া ব্যাংকের আয়ও এখন বন্ধ। সব মিলিয়ে মূলধন ঘাটতি বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক ব্যাসেল-৩ নীতিমালা অনুযায়ী, ঝুঁকি বিবেচনায় ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বর্তমান নিয়মে একটি ব্যাংকের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ অথবা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি, সেটি ন্যূনতম পরিমাণ হিসাবে মূলধন রাখতে হয়। কোনো ব্যাংক এ পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে মূলধন ঘাটতি হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিকে মূলধন সংরক্ষণের এই শর্ত পূরণ করতে পারেনি ১০ ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ৫টি, বেসরকারি ৩টি ও বিশেষায়িত ২টি ব্যাংক। তবে এ সময়ে বেশিরভাগ ব্যাংকের মূলধন উদ্বৃত্ত থাকায় সার্বিক ব্যাংকিং খাতে মূলধন উদ্বৃত্ত রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ বিবেচনায় ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর মূলধন রাখার কথা এক লাখ ১৫ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। তবে আপৎকালীন সুরক্ষা সঞ্চয়সহ ব্যাংক খাতে মূলধন রয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা। এতে করে সার্বিক উদ্বৃত্ত রয়েছে ১৫ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। যা গত সেপ্টেম্বরে ছিল ১১ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
এদিকে ২০১৬ সাল থেকে ক্যাপিটাল কনজারভেশন বাফার বা আপৎকালীন সুরক্ষা সঞ্চয় হিসাবে ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত মূলধন রাখতে হচ্ছে। ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নের আওতায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শূন্য দশমিক ৬২৫, ২০১৭ সালে ১ দশমিক ২৫, ২০১৮ সালে ১ দশমিক ৮৭৫ ও ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে এই বাড়তি পুঁজি সংরক্ষণ করার নির্দেশনা ছিল। এভাবে ন্যূনতম মূলধন এবং সংস্থান বজায় রেখে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততার হারের লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে ১০ দশমিক ৬২৫, ১১ দশমিক ২৫, ১১ দশমিক ৮৭৫ ও ১২ দশমিক ৫০ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলা ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫৯ ব্যাংকের মধ্যে ৪৫টির মূলধন সাড়ে ১২ শতাংশের ওপরে আছে। ঘাটতিতে থাকা ১০ ব্যাংকসহ ১৪ ব্যাংকের মূলধন সংরক্ষণের পরিমাণ এর কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, কোনো ব্যাংক যদি ন্যূনতম মূলধন বজায় রাখার পর বাফার আপৎকালীন সুরক্ষা সঞ্চয় হারে মূলধন রাখতে না পারে, সেই ব্যাংক কোনো নগদ লভ্যাংশ কিংবা বোনাস দিতে পারবে না। তবে কেবল বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমতি নিয়ে বোনাস শেয়ার ইস্যু করতে পারে।
সাধারণভাবে খেলাপি ঋণ বাড়লে মূলধন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বাড়ে। তবে গত বছর খেলাপি ঋণ প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা কমেছে। জানা যায়, করোনার কারণে জানুয়ারি থেকে চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত কেউ কিস্তি না দিলেও তাকে খেলাপি দেখানো হয়নি।
এ সুযোগের ফলে গত বছর খেলাপি ঋণ ৫ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা কমে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ।