ফরিদ আহমেদ : তুতানখামুনের জন্ম যীশু খ্রিস্টের জন্মের তেরো শো বছর আগে। তার বাবার নাম আখেনাতেন। আখেনাতেন ছিলেন মিশরের রাজা। তাঁদেরকে ফারাও বলা হতো। আখেনাতেনের আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। সেই সময়ে তুতানখামুনের বয়স মাত্র নয় বছর।
আগেকার দিনে রাজার ছেলে রাজা হতো। যোগ্যতার কোনো বালাই ছিলো না। অবশ্য এখনো যে সেই নিয়ম পাল্টেছে তা নয়। আগেকার দিনে রাজতন্ত্র ছিলো, সেটা এখন স্বৈরতন্ত্রে রূপ নিয়েছে। স্বৈরতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র হলে আপনি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা পদ পেয়ে যেতে পারেন বিনা আয়াসে। মেয়রের মেয়ে হলে পেতে পারেন চীফ হট অফিসারের পদ। স্বার্থের সংঘাত বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব রাজতন্ত্রে কিংবা স্বৈরতন্ত্রে নেই। কেউ এই প্রশ্ন করলেই বরং তাকে তুলো-ধুনো করা হয়। রাজতন্ত্র কিংবা স্বৈরতন্ত্রে অসংখ্য সুবিধাভোগী এবং সুবিধাভোগবিহীন ভক্তিবাদী থাকে। এরা ভক্তির চুড়ান্ততা প্রদর্শন করে রাজা, রানী কিংবা স্বৈরাচারকে প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠা দেয়। রাজা কিংবা রানীদের বিরুদ্ধে কিছু বললেই এরা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের উপরে।
তুতানখামুনকেও রাজা হতে তাই কোনো যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়নি। নয় বছরের একটা বাচ্চার যোগ্যতা থাকারও কথা নয়। কিন্তু, রাজার পুত্র হবার বিশেষ যোগ্যতা বলে সে মিশরের রাজা হয়ে যায়। সুখের সাগরে ভাসতে থাকে সে।
তুতানখামুনের এই রাজ সুখ অবশ্য বেশিদিন টেকেনি। নানাবিধ শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্মেছিলো সে। ফলে, মাত্র উনিশ বছর বয়সে তুতানখামুন মৃত্যুবরণ করে। ফারাওদের ঐতিহ্য অনুসরণ করে তার মৃতদেহকে মমি করে রেখে দেওয়া হয় সমাধিক্ষেত্রে। তবে, তাকে অনেকটা অবহেলাতেই কবর দেওয়া হয়। যেহেতু তার কোনো উত্তরাধিকার ছিলো না, এক মন্ত্রী নিজে রাজা হবার জন্য তাকে কোনো রকমের মমি করে কবরস্থ করে। তুতানখামুনের স্মৃতি মুছে ফালার চেষ্টা করা হয়।
সেই চেষ্টা অবশ্য কাজ করেনি। মৃত্যুর প্রায় বত্রিশ শো বছর পরে তার সমাধি এবং মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। আর এই আবিষ্কার তুতানখামুনকে বিখ্যাত করে তোলে। এখন ইচ্ছা করলেও কেউ আর তুতানখামুনকে মুছে ফেলতে পারবে না। ইতিহাসে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে সে।
মিশরে একটা সময়ে অসংখ্য প্রত্নতাত্তি¡ক খননকাজ চালানো হয়েছে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতাকে তুলে আনার জন্য। শুধু সভ্যতাকে আবিষ্কার করাটাই যে এর পিছনে মূল কারণ ছিলো তা নয়। ফারাওদের সমাধিতে ধন-রত্নও রাখা হতো। পরকালে গিয়ে সম্রাটদের যাতে অর্থকষ্টে না পড়তে হয়, সেটাই ছিলো মূল কারণ। এখনকার যুগেও স্বৈরাচার কিংবা সম্রাটদের পরকালের খরচের জন্য ধন-রত্ন দেওয়া হয়। তবে সেটা কবরে গচ্ছিত থাকে না, গচ্ছিত থাকে সুইস ব্যাংকে।
১৮৯১ সালে মিশরবিদ পার্সি নিউবেরি মিশরে গিয়েছিলেন খননকার্য চালানোর জন্য। সেই মিশনে তিনি সাহায্যকারী হিসাবে যোগ দেন হাওয়ার্ড কার্টার। তাঁর বয়স তখন মাত্র সতেরো বছর। সতেরো বছরের এই ছেলে মাত্র পনেরো বছর পরে মিশরের ডিপার্টমেন্ট অব অ্যান্টিক্যুইটির ম্যানেজার হয়ে বসেন নিজের যোগ্যতায়। কে কোথায় খনন করবে, তার অনুমতি তখন তাঁর কাছ থেকে নিতে হতো সবাইকে।
লর্ড কার্নাভনের আর্থিক অবস্থা তখন খুবই খারাপ। আর্থিক অবস্থা ফেরাতে শেষ জুয়া হিসাবে তিনি মিশরে ইনভেস্ট করার সিদ্ধান্ত নেন। যোগাযোগ করেন হাওয়ার্ড কার্টারের সাথে। লর্ড কার্নাভনের টাকা দিয়ে ১৯১৪ সালে ভ্যালি অব কিংসে খননকার্য শুরু হয়। খননকার্য শুরু হবার আট বছর পরে ১৯২২ সালে তুতানখামুনের সমাধি খুঁজে পাওয়া যায়। লর্ড কার্নাভন এই সুসংবাদ জানতে পেরে কন্যা এভলিনকে নিয়ে মিশরে চলে আসেন।
এই বিখ্যাত আবিষ্কারের সাথে এক কুখ্যাত অভিশাপেরও জন্ম হয়। বলা হয় যে তুতানখামুনের সমাধি যাঁরা আবিষ্কার করেছেন তাঁরা সবাই অপঘাতে মারা গিয়েছে। তুতানখামুন নিভৃতে থাকতে চেয়েছিলো। তাঁকে যাঁরা প্রকাশ্যে এনেছে তাঁদের সবার প্রতি সে নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নিয়েছে তাঁদের হত্যা করে। পৃথিবীর অনেক মানুষই এটা বিশ্বাস করে। একে ফারাওয়ের অভিশাপ বা তুতানখামুনের অভিশাপ বলা হয়।
‘ফারাওয়ের অভিশাপ’ একটা গুজব ছাড়া আর কিছুই নয়। এই গুজবের জন্মের পিছনে অনেক ফ্যাক্টর রয়েছে। শুরুটা হয়েছে বলতে গেলে খননকারী দলের প্রধান হাওয়ার্ড কার্টারের হাত ধরেই। কৌতূহলী লোকজন এসে যাতে ঝামেলা না করে এবং প্রেসের মনোযোগ পাবার জন্য তিনি এই অভিশাপের কথা বলেছিলেন। অবশ্য ফারাওদের সবার ব্যাপারে এই ধরনের অভিশাপের কথা মিশরে জনমুখে এমনিতেই প্রচলিত ছিলো। এতে অবাক হবার কিছু নেই। কুসংস্কারে বিশ্বাস করা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। বিজ্ঞানের চেয়ে অপ-বিজ্ঞানে মানুষের ঝোঁক বেশি, যুক্তির চেয়ে অযৌক্তিক কুসংস্কারের প্রতি তারা বেশি আগ্রহ দেখায়। এর পিছনে কারণও আছে। বিজ্ঞান বুঝতে গেলে কষ্ট করতে হয়, যুক্তির পথে হাঁটতে গেলে অন্যদের থেকে আলাদা হওয়ার সাহস লাগে। এই পরিশ্রম করার মানসিকতা কিংবা সাহস দেখানোর সদিচ্ছা সবার থাকে না।
হাওয়ার্ড কার্টারের কারণেই যে এই অভিশাপ চারিদিকে ছড়িয়ে ছিলো তা নয়। ঝামেলাটা বাধে এই প্রজেক্টের যিনি অর্থায়ন করেছিলেন সেই লর্ড কার্নাভন কবর খোঁড়ার পরের বছরে মারা গেলে। ভদ্রলোক মশার কামড়ে মারা যান। যে রাতে মারা যান, সে রাতে আবার ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না কায়রোতে। এমন হয়তো প্রায় সময়ই হয়। কিন্তু এগুলোকে দুইয়ে দুইয়ে যোগ করে কেউ কেউ। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে যে তিনি অভিশাপের কবলে পড়ে মারা গিয়েছেন। বাস্তবতা হচ্ছে ভদ্রলোক ভগ্ন স্বাস্থ্যের লোক ছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতায় ভুগছিলেন। এমনিতেই বেশিদিন তিনি টিকতেন না।
তিনি মারা যাবার পরদিন শার্লক হোমসের স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের একটা লেকচার দেবার কথা ছিল। সেই লেকচার ছিল স্পিরিচুয়ালিটির উপরে। সেখানে এক সাংবাদিক তাঁকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি লর্ড কার্নাভনের মৃত্যুর পিছনের ভুত-প্রেত থাকতে পারে বলে উল্লেখ করেছিলেন। এর পরে বহু মানুষ এটা নিয়ে বাণিজ্য করেছেন, বহু মানুষ অন্ধের মতো অভিশাপকে বিশ্বাস করেছে। খুব কম মানুষই যৌক্তিকভাবে চিন্তাভাবনা করেছে।
এই প্রজেক্টে কয়েক ডজন মানুষ জড়িত ছিলেন। সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে তাঁরা মারা গেছেন। কারো স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে, কারো বা অস্বাভাবিক মৃত্যু। অভিশাপে বিশ্বাসী লোকেরা তাদের পছন্দ মতো উদাহরণগুলোকে টেনে নিয়ে সেই বিশ্বাসকে পোক্ত করেছে।
বাস্তবতা ছিলো ভিন্ন ধরনের। প্রত্নতাত্তি¡ক প্রজেক্টের প্রধান হাওয়ার্ড কার্টার মারা গেছেন ষোল বছর পরে পরিণত বয়সে। লর্ড কার্নাভনের কন্যা লেডি এভলিন মারা গেছেন সাতান্ন বছর পরে।
সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, এই কবর পাহারা দেবার একজন ব্রিটিশ সৈন্যকে রাখা হয়েছিলো। তাঁর নাম হচ্ছে রিচার্ড এডামসন। তিনি সাত বছর ওই সমাধিতে ঘুমিয়েছেন। এমন ‘গর্হিত’ অপরাধ করার পরেও তাঁকে কোনো অভিশাপ স্পর্শ করতে পারে নাই। তিনি মারা গেছেন ১৯৮০ সালে। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিলো তাঁর।
প্রজেক্টে যুক্ত মানুষদের মৃত্যুর গড় বয়স ছিল তেহাত্তর বছর। ওই সময়ের উচ্চ শ্রেণীর মানুষের গড় আয়ু ছিল সত্তর বছর। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে তাঁরা অন্যদের চেয়ে বেশি সময় বেঁচেছেন। জেমস র্যান্ডি মজা করে বলেছিলেন যে, এই অভিশাপ বরং বিপরীত কাজই করেছে। তিনি তাঁর “An Encyclopedia of Claims, Frauds, and Hoaxes of the Occult and Supernatural” বইতে লিখেছেন,
“এই দলের লোকজন গড়ে তেহাত্তর বছরের বেশি পরে মারা গেছেন, সেই সময়ের এবং সামাজিক শ্রেণীর ব্যক্তিদের চেয়ে এক বছরের বেশি বেঁচেছেন তাঁরা। ফারাওয়ের অভিশাপ তাই একটি উপকারী অভিশাপই বলা যায়।”