অনলাইন ডেস্ক : তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র ভাবনা আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের ছিল। আজকের বাংলাদেশে তাকে খুব দরকার।’ শক্তিমান অভিনেতা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের এ দুটি বাক্যই বলে দেয় বাংলা চলচ্চিত্রে তারেক মাসুদ সেই আক্ষেপের নাম, যে আক্ষেপের শেষ নেই। তার প্রথম চলচ্চিত্র মাটির ময়নায় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। খুব কাছ থেকে দেখেছেন ক্ষণজন্মা এ চলচ্চিত্রপ্রাণ মানুষটাকে। আজকের বাংলাদেশে তারেক মাসুদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তিনজন পরিচালক এসেছিলেন, যারা চলচ্চিত্রের বাঁক বদলে দিয়েছিলেন। যাদের হাত ধরে চলচ্চিত্র নতুন মোড় নিয়েছিল। যাদের চলচ্চিত্র ভাবনা ছিল আধুনিক এবং আন্তর্জাতিক মানের। তারা হলেন জহির রায়হান, আলমগীর কবির ও তারেক মাসুদ। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে তাদের তিনজনকেই অকালে হারিয়েছে। আজকের বাংলা ও আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের মান বিচারে তাদের খুব প্রয়োজন ছিল।’
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট বাংলাদেশসহ দুনিয়ার বাংলা ভাষাভাষী মানুষ একজন চলচ্চিত্রকারের অকালপ্রয়াণে হাহাকারে ডুবেছিল। তিনি তারেক মাসুদ। তার অকালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু কত বড় ক্ষতি, তা এখন টের পাওয়া যায় বাংলা চলচ্চিত্রের দুরবস্থার দিকে তাকালে। তার মতো কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার বাংলাদেশ মনে হয় পাবে না। আর পেলেও তিনি তারেক মাসুদ হবেন না। তার মৃত্যু বারবার মনে করিয়ে দেয় ১৯৮৯ সালে ২০ জানুয়ারি বাংলাদেশের আরেক বরেণ্য পরিচালক আলমগীর কবিরের দুর্ঘটনায় অকালে চলে যাওয়া।
তারেক মাসুদ ১৫৬৫ সালে তদানীন্তন ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার নূরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ভাঙ্গা ঈদগা মাদ্রাসায় পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকার লালবাগের একটি মাদ্রাসা থেকে মৌলানা পাস করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার মাদ্রাসাশিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।
যুদ্ধের পর তিনি ফরিদপুরের ভাঙ্গা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাইভেটে মেট্রিক পরীক্ষায় অংশ নেন। এরপর আইএ পাস করেন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ থেকে ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স শেষ করে তার প্রথম প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন।
তারেক মাসুদের সিনেমা বুঝতে ও তাকে চিনতে তার ‘চলচ্চিত্রযাত্রা’ বইটা পড়ার বিকল্প নেই। ক্ষণস্থায়ী জীবনেই তিনি যে মাপের সবকিছু নিয়েই পড়াশোনা করেছেন, আর যা সিনেমা দেখেছেন সেই আমলে, তার তুলনা নেই।
এসএম সুলতানের জীবন নিয়ে ‘আদম সুরত’ বানাতে অনেক দিন লেগেছিল। সবাই হাসাহাসি করত, অনেকেই জিজ্ঞেস করত—‘শেষ করতে পারবা না আর ছবিটা? নাকি সুলতানের মরণের জন্য ওয়েট করছ?’ তারেক মাসুদ হেসে বলতেন, ‘আমি শেষ করতে চাই, তবে তা শেষ করার জন্য নয়, কাজটা শেষ হলেই শেষ করব।’
সুলতান নির্মাণের সময়ের বেশির ভাগ সময়েই কথা হতো মানুষের জীবনদর্শন নিয়ে। বিশেষ করে বাঙালির সমাজ, ইতিহাস, সংস্কার-সংস্কৃতি নিয়ে। তার সঙ্গে এসএম সুলতানের সাত বছর ধরে চলা সময়ের কথা বলতেন।
বলতেন, ‘সুলতান ভাইয়ের ওপর ছবি করতে আমার সাত বছর লেগেছে। সাত বছরে মানুষ হয়তো ১৩টা ছবি করে। কিন্তু আমার জীবনে পরববর্তীতে যা অর্জন, সবই এ সাত বছরের জন্য অর্জিত হয়েছে।’
মহান শিল্পী এসএম সুলতানের কথা প্রায়ই বলতেন। বলতেন, ‘আাামি গ্রামের ছেলে কিন্তু সত্যিকারের গ্রাম দেখতে শিখেছি সুলতান ভাইয়ের চোখ দিয়ে।’
তার প্রথম সিনেমা মাটির ময়না শুধু বাংলাদেশেই না, পুরো বিশ্বের সিনেমাপ্রেমীদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। এছাড়া নরসুন্দর, অন্তর্যাত্রা, রানওয়ে সিনেমাগুলোও বাংলা সিনেমার মাইলফলক হয়ে আছে।
তারেক মাসুদকে পরিচালক আলমগীর কবির বলেছিলেন, ‘চারটা রেপ সিন, ১০টা গুলি ফাইট, পাঁচ-ছয়টা স্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা বানানোর চেয়ে না বানানো ভালো।’ তারেক মাসুদ সেই পথেই হেঁটেছেন। তার প্রতিটা কাজের মান আন্তর্জাতিক কিন্তু গভীরভাবে শিকড়ে প্রোথিত। খুব চাইতেন দেশে একটা ভালো ফিল্ম আর্কাইভ হোক। এই ওটিটি প্লাটফর্মের যুগে নিশ্চিতভাবে তিনি দারুণ কাজ করতে পারতেন।
এখনকার ছেলেমেয়েরা এত সিনেমা দেখে এটাকে তিনি খুব বড় সুযোগ হিসেবে ভাবতেন। কিংবদন্তি ইরানি পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তামি তাকে স্নেহ করতেন। অনেক বড় বড় চলচ্চিত্রবোদ্ধা তার সিনেমা দিয়ে বাংলাদেশকে দেখেছেন। আর তাই জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের মতো অনেকেই বলেন, ‘এ সময়ে আমাদের একজন তারেক মাসুদের খুবই প্রয়োজন ছিল।’