আহমেদ হোসেন : আমি কামাল ভাই ডাকতাম। যদিও বন্ধুবর দেলওয়ার এলাহী তাঁকে মামা বলে সম্বোধন করতেন। বন্ধুদের কেউ কেউ তাঁকে আংকেল ডাকতেন। ইচ্ছে ছিল তাঁর একক বক্তৃতার অনুষ্ঠান করবো। নাম ঠিক করে রেখেছিলাম ‘আমার যত কথা’। তিনি জানতেন রাজ্যের কথা। অফুরান ভান্ডার তাঁর। এই অনুষ্ঠান না করতে পারলেও অনেক অনেক অনুষ্ঠানে, ব্যক্তিগত আড্ডায় অনেক আলাপ শুনেছি তাঁর। জেনেছি কত শত তথ্য উপাত্ত।
কামাল ভাইকে চিনি বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশে তাঁর সাথে অত সখ্যতা ছিল না। আত্মিক সম্পর্ক প্রগাঢ় হয়েছিল উনি যখন মন্ট্রিয়ল থেকে টরন্টোতে বসবাস শুরু করলেন তখন থেকে। কামাল ভাই আমাদের সব অনুষ্ঠানে আসতেন। আলোচনার কিছু থাকলে কথা বলতেন।
মাঝে মাঝে বিব্রত হতাম আমায় নিয়ে ভালোবাসায় অনেক প্রশংসা করায়। একবার পত্রিকায় লিখে ফেললেন বাংলা ভাষার বিখ্যাত নট, আবৃত্তিকারের সাথে তুলনা করে। পরে অভিমান করে অভিযোগ করেছেন এত প্রশংসার পর কেন তাঁকে ফোন করে ধন্যবাদ দেই নাই। ক্ষমা চেয়ে বলেছিলাম লজ্জায়। একটা সময় কামাল ভাই প্রায় প্রতিদিন ফোন করতেন। শিল্প সাহিত্য আমাদের এখানকার চর্চা, বাংলাদেশের রাজনীতি, সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল, কবিতা সকল বিষয়ে কথা হতো তাঁর সাথে। গতরাতে না ফেরার দেশে চলে যাবার আগে সপ্তাহ দুয়েক আগে শেষ কথা হয়েছিল। বললেন কিছু বই পাঠিয়ে দেবার জন্যে। ফেব্রæয়ারি ২০২০ বাংলাদেশ থেকে তিন চারটি বিশেষ সংখ্যা ঈদ সংখ্যা এনে দিয়েছিলাম যা তাঁর ছোট মেয়ে দিয়েছিল। আকণ্ঠ পাঠ করতেন তিনি। আর কি আছে আর কি আছে করতেন। বই পড়ার এমন মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। ফোনে বলেছিলাম কিছু প্রবন্ধের বই পাঠাবো। মিজান আর জাহাঙ্গীর ভাই স্থানীয় পত্রিকার সব সংখ্যা নিয়ে যেতেন সব সময়। গত শনিবার যখন বাংলা কাগজের জাহাঙ্গীর ভাই এ সপ্তাহের সব পত্রিকা, কয়েকটি বই নিয়ে যাবেন বলে ঠিক করছিলেন তখন এই সপ্তাহে আমিও কিছু বই দেব বলে রেখেছিলাম। আজ সেই পড়ার মানুষটি না ফেরার দেশে।
টরন্টো এসে গোটা পনের স্মরণিকা সম্পাদনা করেছি। যারপরনাই উৎসাহ দিতেন তিনি। লেখা দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন কিভাবে ছাপাতে হবে। টরন্টোর বাংলা বইমেলার স্মরণিকা তাঁর লেখা ছাড়াও সব লেখার গুণগত মান নিয়ে আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেন, প্রশংসা করতেন, উৎসাহ দিতেন।
বৃদ্ধাশ্রমে উঠার আগে কামাল ভাই বাঙালি অধ্যুষিত ক্রিসেন্ট টাউনে অনেকদিন থাকেন। তার আগে মেয়ে রিংকি একটি বাড়ি কিনলে সেখানে কিছুকাল থাকেন। সেই সময়টাতে শেখর গমেজ, অনিন্দ্য শান্ত, আমি “মুক্তমন- সত্য সুন্দর আনন্দ কল্যাণ” নামে একটি আবৃত্তি সংগঠন গড়ে তুলি।
এখানে সেখানে মিনিট পনের বিশের “আশা নিরাশার কাব্য” ‘দ্রোহের কবিতা’ ইত্যাদি নামে প্রযোজনা করে আসছি। সেটা পত্রিকা মারফত জেনে ফোনে বললেন পরের অনুষ্ঠান যেখানেই হোক তাঁকে জানাতে। আমি বললাম, মুক্তমন আপনার একার জন্যেই প্রযোজনা নিয়ে আপনার বাসায় আসবে। সেদিন আমরা তাঁকে মিনিট ৪৫ আবৃত্তি শুনিয়েছিলাম। দর্শকশ্রোতা নবু ভাবী আর কামাল ভাই। দুজনে আমাদের প্রযোজনার প্রশংসা করলেন।
বছর দশেক আগে কামাল ভাইকে নিয়ে প্রায়ই বাজার করতে যেতাম। চাইনিজ দোকান থেকে এটা, বাংলা দোকান থেকে সেটা কিনে রাজ্যের গল্প করতে করতে ফিরতাম। শেষের দিকে আর বাজার করার সময় দিতে পারতাম না বলে ফোন করে অভিমানী সুরে কথা বলতেন।
২০০৪/৫ সালে অগ্রজ এনায়েত করিম বাবুল আমাকে তাঁর একটি এইচভিএস ক্যামেরা দিয়েছিল। সেটাতে কামাল ভাই নিয়ে ভিডিও করতাম। তাঁকে বলে রেখেছিলাম আমি আপনাকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র করবো। করবো করবো করে কত প্রজেক্ট যে আলোর মুখ দেখে নাই তারমধ্যে এইটি একটি।
কামাল ভাই তাঁর কলকাতার জমি বিক্রি, ছেলের জন্যে পাত্রী, মেয়ের সুখ দু:খের কথা বলতেন। বলতেন তাঁর পিতার কথা, তাঁর নবুর কথা। স্ত্রী বিয়োগের পর যতবার ফোন করেছেন ততবার ভাবীর প্রসঙ্গ এনে তার কবরের শায়িতকালে ছিলেম বলে কৃতজ্ঞতা জানাতেন।
গতকাল সন্ধ্যে ৬টায় আকতার ভাই ফোন করেন কামাল ভাই কেমন আছেন কিছু জানি কিনা। না বলে রিংকিকে ফোন করলে সে জানালো হাসপাতালে ঢুকছে। ডাক্তার বলে দিয়েছে যেকোন সময় সে চলে যাবেন। তাই গেলেন রাত ১১টা ২০ কি ৪০।
কামাল ভাই আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আজ থাকতে পারি নাই।
আসছি আমি আমরা। সেখানেও হবে জয় বাংলা। হবে মা, মাটি, মানুষের গল্প। স্মরণিকার জন্যে লেখাটা প্রস্তুত রাখবেন প্লিজ।
আহমেদ হোসেন
জানুয়ারি ২৫, ২০২১
টরন্টো