মণিজিঞ্জির সান্যাল : একরাশ মন খারাপ ছেয়ে ফেলেছে আপনাকে। কালো মেঘগুলো আপনাকে ঘিরে রাখছে অবারিত। ইচ্ছে করছে এই ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসতে কিন্তু পারছেন না কিছুতেই। আসলে আপনি বুঝতেই পারছেন না এই পুঞ্জীভূত কালো মেঘগুলো কোথা থেকে কিভাবে এসে পড়ল আপনার জীবনে।
একসাথে জমে থাকা এই কালো মেঘগুলোই কি ডিপ্রেশন? আপনি কি এর মধ্যেই আটকে পড়েছেন? কী করে বুঝবেন যে আপনি এই কালো মেঘগুলোর শিকার? সত্যিই কি আপনি ডিপ্রেশনে ভুগছেন?
আপনি কিন্তু একটু ইচ্ছে করলেই বুঝতে পারবেন আপনার বিষন্নতার মুহূর্তগুলোকে। যে কোনো মানুষই নিজের চেষ্টায় নিজেই এর থেকে মুক্তি পেতে পারেন কিন্তু তার জন্যে প্রথমেই নিজেকে সচেষ্ট হতে হবে। প্রথমেই তাকে নিজের কাছে নিজেকে পরীক্ষা দিতে হবে।
তিনি যে ধীরে ধীরে বিষন্নতার করাল ছায়ায় আবিষ্ট হচ্ছেন তা নিজের কাছে নিজেই অনুমেয়। ধীরে ধীরে সেই পর্বগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।
যেমন, প্রথমেই আপনি খেয়াল করবেন আগের মতো কাজের প্রতি সেই ইচ্ছেটা আছে কি না।
তার মানে …
(১) আপনার কি কাজের প্রতি অনীহা তৈরি হয়েছে? মানে আপনার শখের কাজগুলোতে আপনি ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছেন কি? আগে আপনি বেশ উৎসাহ নিয়ে সব কাজকর্ম করতেন, এখন কি আগের মতো সেই উৎসাহ নেই?
সারাদিন শুয়ে বা বসে বসেই সময়গুলোকে কাটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে? কোনো কাজেই কি আর আগ্রহই খুঁজে পাচ্ছেন না?
যদি তাই হয়, তবে সত্যিই আপনি ধীরে ধীরে ডিপ্রেশন বা অবসাদ বা বিষন্নতার পথে পা বাড়িয়েছেন।
এরপরে খেয়াল করে দেখুন তো আপনার খাওয়া দাওয়ার অভ্যাস কি পালটে গেছে?
তাহলে দ্বিতীয় কারণ হিসেবে আপনি বলতেই পারেন খাওয়া দাওয়ার পরিবর্তন…
(২) ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হলে আপনার রেগুলার খাদ্যাভাসে পরিবর্তন দেখা দেবে। হয় আপনি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খাবেন আর নয়তো আপনার খাবারে অরুচি দেখা দেবে। এ ফলে আপনার ওজন হয় দ্রæত বাড়বে বা কমতে থাকবে যা আপনার শরীরে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি করবে।
এরপর যে সমস্যাটা দেখে দেবে দীর্ঘকালীন অনিদ্রা। খেয়াল করে দেখবেন আপনার কিছুতেই রাতে ঘুম আসছে না। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে করতেই ভোর বা মাঝরাতে কোনও কারণ ছাড়াই কাঁচা ঘুম কোথায় হারিয়ে গেল। পরে আর ঘুমই আসছে না। এটা হয়, কারণ যারা অবসাদে ভোগেন তাদের মাথায় একসঙ্গে অনেক চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। ঘুমের মধ্যেও তা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয় না।
সুতরাং তৃতীয় কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে ঘুম না হওয়া…
(৩) দীর্ঘ সময় ধরে অনিদ্রা বিষন্নতার একটি লক্ষণ। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যারা বিষন্নতায় ভুগছেন তাদের আশি ভাগেরই অনিদ্রার সমস্যা রয়েছে। যাদের দীর্ঘকালীন অনিদ্রাজনিত সমস্যা রয়েছে তাদের বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবতা তাদের চেয়ে তিন গুণ বেশি যাদের এ সমস্যা নেই। অনেক চিকিৎসকরা বিশ্বাস করেন, অনিদ্রা রোগের যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে বিষন্নতা রোগের তীব্রতা প্রশমন করা সম্ভব। যদি আপনার দীর্ঘকালীন নিদ্রাহীনতাজনিত সমস্যা থেকে থাকে, তবে আপনি হয়তো বা বিষন্নতা রোগে ভুগছেন।
আর ঘুম যদি ভাল না হয় তাহলে কোনো কাজেই মনোযোগ দিতে পারবেন না। এটাও আসে ডিপ্রেশন থেকে। রাতে ঘুম ঠিক না-হওয়ায়, কাজে ভুলভ্রান্তি বাড়ে। মনোনিবেশ করা যায় না। ঘন ঘন হাই ওঠে।
এরপর আরো একটি বিষয় হল অবসাদ। আপনি কোনো কাজেই আর উৎসাহ পাচ্ছেন না।
অর্থাৎ ….
(৪) বিষন্নতায় আক্রান্ত হলে অবসাদ আপনাকে গ্রাস করবেই করবে। তাই যখন দেখবেন আপনি অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন, কোন কিছুতেই উৎসাহ পাচ্ছেন না তখন বুঝবেন আপনি একজন ডিপ্রেশনের রোগী ।
এরপর যে বিষয়টি খেয়াল করবেন তা হল আপনি কি সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন? বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় পরিজন সবার থেকে আপনি ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছেন। তাহলে এই লক্ষণটিও কিন্তু বিষন্নতার আরো একটি দিক।
(৫) বিষন্নতার কারণে আপনি নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে ফেলছেন। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গ ভালো লাগবে না। সামাজিকতা অনেক সময় অসহনীয় হয়ে দেখা দেবে। একাকীত্ব ঘিরে ফেলবে আপনাকে যা আপনার অসুস্থতা আরো বাড়িয়ে তুলবে।
ধীরে ধীরে কোনো কাজেই আর মনোযোগ দিতে পারছেন না। কারো কথা শুনতে ভাল লাগছে না। নিজের কোনো ছোট্ট কাজেও আগের মতো আর মন নেই। সবকিছুতেই মনোযোগের অভাব।
অর্থাৎ …
(৬) বিষন্নতার ফলে আপনি একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছেন। কোন কিছুতেই ঠিকভাবে মনোনিবেশ করতে পারছেন না। অন্যদের কথা মন দিয়ে শুনতে ইচ্ছে করে না বা কোন আলোচনায় অংশ নিতে মন চায় না।
এভাবে চলতে চলতে একসময় আপনি সবকিছুতেই নেগেটিভ ভাবনা পোষণ করেন। সব বিষয়েই আপনি নেগেটিভ মনোভাব পোষণ করেন। মানে ….
(৭) দুঃখবোধ, আশাহীনতা ও হতাশা আপনাকে ঘিরে ফেলবে। সবকিছুতেই নেগেটিভ ভাবনা দেখা দেবে।
তারপর সময়ে অসময়ে শরীর খারাপ লাগবে। শরীরে নানান রকম উপসর্গ দেখা দেবে। যেমন মাথা ব্যথা ও গাস্ট্রিকের সমস্যা ইত্যাদি।
তাহলে …
(৮) মনের সমস্যা থেকে ধীরে ধীরে হজমের দেখা দেবে । শুধু বদহজমই না, গা গোলানো, বমি, ঘন ঘন পেট খারাপ এমন অনেক সমস্যা দেখা যায়। ওষুধে কিছুদিন ঠিক থাকে। তারপরে আবার!
অর্থাৎ মনের সমস্যা থেকে শারীরিক সমস্যার সূত্রপাত হবে আপনার নিজেরই অজান্তে।
নিয়মিত মাথা ব্যথা ও হজমে সমস্যাও ডিপ্রেশনের লক্ষণ।
আচ্ছা আপনার আরো একটি সমস্যা হচ্ছে কি? এই যেমন আপনার প্রিয় মানুষটির সঙ্গে মিলনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কি? তাহলে ধরে নেওয়া যাক ….
(৯) আপনার যৌনাকাঙ্ক্ষা বা কামশক্তি কমে আসছে। কেউ দীর্ঘ সময় ধরে অবসাদে ভুগলে, তার মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই যৌনাকাঙ্ক্ষা কমে আসে। মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তি থেকেই সেক্সে আগ্রহ হারিয়ে যায়। আত্মবিশ্বাসও হারিয়ে যায়।
আপনি আরো একটি জিনিস খেয়াল করে দেখুন তো আপনি কি নিজের মধ্যে অদ্ভুত এক অস্থির অস্থির ভাব অনুভব করছেন ……
(১০) অবসাদ কি আপনাকে অস্থির করে তুলছে? এই অস্থির অস্থির ভাব দেখেও বোঝা যায় আপনি অবসাদগ্রস্ত কি না। এরফলে সহজেই কিন্তু মেজাজ হারিয়ে যায়।
আচ্ছা আপনি কি ক্রমাগত অলস হয়ে পড়ছেন?
একটানা মন খারাপের মধ্যে থাকলে যে মানসিক অবসাদের জন্ম নেয় তার ফলে আপনার মধ্যে ক্ষিপ্রতা কমে আসবে …….
( ১১ ) আক্ষরিক অর্থেই তখন কাজে একটা ধীর গতি চলে আসে। চলাফেরায় তো বটেই এমনকী কথা বলার সময়েও একটা আলিস্যি ফুটে ওঠে। এই অবস্থাকে বলা হয় সাইকোমোটর রিটার্ডেশন।
নীচে উল্লিখিত ন’টি লক্ষণ যদি আপনার সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে নিশ্চিত থাকুন আপনিও ভুগছেন অবসাদে।
অর্থাৎ সংক্ষেপে বললে যা বোঝায় —
আজেবাজে না খেয়েও দিনে দিনে ফুলছেন। রাতে ঘুমই আসছে না বা, যখন তখন অসময়ে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। মেজাজ একেবারে সপ্তমে ইত্যাদি নানান সমস্যায় যদি আপনার প্রতিটি দিন কাটছে মনে হয় তবে বুঝবেন আপনি ডিপ্রেশনকে সঙ্গী করেছেন বা মানসিক অবসাদে ভুগছেন।
অর্থাৎ আপনি ডিপ্রেশনের পথে পা বাড়িয়েছেন। কিন্তু একজন মানুষ পারে না পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই। একমাত্র মানুষই পারে সমস্ত কিছুকে সম্ভব করতে। তাই আপনি চাইলেই এই সমস্যার হাত থেকে সহজেই বাঁচতে পারেন। সহজেই নতুন পথের সন্ধান বের করতে পারেন , নতুন আলোর পথে জীবনটাকে সুন্দর ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন কেবলমাত্র আপনিই। তাই খুব জোরের সঙ্গে বলুন আমি পারব, আমাকে পারতেই হবে এই অবস্থা থেকে বেরতে কারণ জীবন একটাই, আর এই জীবনকে নষ্ট করার কোনো অধিকার আমার নেই, আর এতে কোনো মহত্বও নেই।
মণিজিঞ্জির সান্যাল: কথা সাহিত্যিক, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ