শওগাত আলী সাগর : ড. নুহ ইভেশের কথাগুলো মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না। ‘শোনো, এটা তুমি, আমি, তোমার মা, তোমার সন্তান। শোনো, হতে পারে, তুমি কোভিডকে ভয় পাওনা। কিন্তু তুমি তো তোমার সন্তানকে কেয়ার করো, তোমার মা, স্ত্রীকে নিয়ে তোমার উদ্বেগ আছে, ভালোবাসা আছে। যদি তাই থাকে, সত্যি যদি তাই থাকে, তা হলে আমাদের কথা শোনো। তুমি ঘরে থাকো। এই সময়টায় কোনো আত্মীয়ের বাসায় যেয়ো না, বন্ধুর বাসায়ও না।’ ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর ফ্যামিলি মেডিসিনের অধ্যাপক তিনি। সিবিসি টেলিভিশনে হাসপাতালগুলোর অবস্থা তুলে ধরে তিনি যেনো কাকুতি মিনতি করছিলেন ড. ইভেশ।

‘আজ যদি তুমি কোনো কারণে গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হও, তোমার যদি অবস্থা এমনি হয় যে এক্ষুনি সার্জারি লাগবে, তোমার অবস্থা যদি এমন হয় যে তোমার আইসিইউ দরকার। বিশ্বাস করো, তোমাকে আমরা আইসিইউ দিতে পারবো না।’ -ড. ইভেশের আকুতিতে যুক্ত হয় কথাগুলো। ড. ইভেশের কথাগুলো সারাক্ষণই যেনো কানের কাছে বাজছে।

কোভিড নিয়ে আমি কখনোই হতাশার খবর শেয়ার করি না। খুঁজে খুঁজে আশাবাদের খবর, সম্ভাবনার খবর তুলে এনে সেগুলো নিয়েই লিখি। সেগুলোই শেয়ার করি। ক্রিকেট ম্যাচের ফলাফলের মতো মৃত্যু আর সংক্রমনের সংখ্যা সোশ্যাল মিডিয়া পোষ্ট করাকে আমি বলতে গেলে ঘৃণাই করি। মানুষ আমার কাছে সংখ্যা নয়, মানুষ আমার কাছে ‘সন্তান, ভাই বোন, মা-বাবা’, মানুষ আমার কাছে একেকটি পরিবার, মানুষ আমার কাছে আমার ভালোবাসা। কিন্তু গত ক’দিন ধরে টরন্টোর হাসপাতালগুলোয় বেড আর আইসিইউ নিয়ে হাহাকার শুনতে শুনতে মনটা ভারি হয়েছিলো। কোভিডে আক্রান্ত হওয়া মানুষকে আইসিউতে জায়গা দিতে না পেরে চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীদের আহাজারী যেনো লেক অন্টারিও আর শহর টরন্টোর বাতাসকেও ভারি করে তুলেছে। প্রভিন্সের অধিকর্তা প্রিমিয়ার ডাগ ফোর্ডও হাহাকার করছেন, ‘আমাদের পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, কেবল গুড়ালিতে আটকে আছি আমরা। এইটুকু মাটি সরে গেলে– ডাগ ফোর্ড কথা শেষ করতে পারেন না। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি দায় স্বীকার করেন, আমি ব্যর্থ হয়েছি। অথচ আমরা জানি, এই কোভিডে পুরো কানাডায় তিনজন রাজনীতিক সব চেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রæডো, অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড আর অন্টারিওর প্রিমিয়ার ডাগ ফোর্ড। প্রভিন্সিয়াল রাজনীতিক ডাগ ফোর্ড জাতীয় পর্যায়ের নেতা হিসেবে অভিসিক্ত হয়েছেন কোভিড ব্যবস্থাপনায় তার আন্তরিকতার কারণে।

কিন্তু এখন চিকিৎসকদের এই আহাজারি কেন? প্রভিন্সের শাসকের মনে এই হাহাকার কেন? সংক্রমণের হার যেভাবে বাড়ছে, আইসিইউতে রোগীর সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সেটি সামাল দিতে পারছে না হাসপাতালগুলো। ডাক্তাররাই বলছেন, অন্টারিওর হাসপাতালে এখন সাত শতাধিক রোগী আইসিউতে আছে। এপ্রিলের শেষ হওয়ার আগেই এই সংখ্যা হজারে গিয়ে পৌঁছুবে। চিকিৎসরা জানাচ্ছেন, আমরা যতো আন্তরিকতা আর শক্তি দিয়ে সেবা দেই না কেন এর ২০ থেকে ৩০ শতাংশ রোগীকে আসলে বাঁচানো যাবে না। শত শত রোগী মরে যাবে। অথচ প্রতিটি মৃত্যুই ঠেকানো যেতো, ঠেকানো দরকার ছিলো। এই যে ‘প্রতিটি মৃত্যু ঠেকানো যেতো, ঠেকানো দরকার ছিলো’- এই বোধটাই চিকিৎসকদের হাহাকার করতে বাধ্য করছে। তারা আসলে মানুষ বাঁচাতে চান।

ঠিক এই মুহূর্ত থেকে পরিপূর্ণভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাই ঘরে বসে গেলেও পরিস্থিতি বিশেষ করে হাসপাতাল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে। কেননা সংক্রমন কমতে এই সময়টা লাগবে। আর সেটি করা না গেলে? তারা সতর্ক করে দিচ্ছেন- টরন্টো হবে নিউইয়র্ক কিংবা ইতালী। কার মুখ থেকে অক্সিজেনটা সরিয়ে কার মুখে লাগাবেন- এমন দুর্বিসহ সিদ্ধান্ত নেয়ার পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে টরন্টো হাসপাতালগুলোয়।

মানুষ যদি মানুষ বাঁচানোর চেষ্টা না করে, নিজ সন্তান, ভাই-বোন, বাবা-মাকে বাঁচাতে না চায়, সরকার কিংবা চিকিৎসকরা কিভাবে বাঁচাবেন তাদের। চিকিৎসকরা নিজেরাইতো ভেঙ্গে পরার মতো অবস্থায়! আর সেই কারণেই টরন্টোর চিকিৎসকরা বারবার আকৃতি জানাচ্ছেন, দোহাই লাগে, এই সময়টা ঘরে থাকো, কোথাও যেয়ো না, বন্ধুর বাড়িতেও না। ড. ইভেশের কথাগুলো কানে বাজতে থাকে, শোনো, হতে পারে, তুমি কোভিডকে ভয় পাও না। কিন্তু তুমি তো তোমার সন্তানকে কেয়ার করো, তোমার মা, স্ত্রীকে নিয়ে তোমার উদ্বেগ আছে, ভালোবাসা আছে। যদি তাই থাকে, সত্যি যদি তাই থাকে, তা হলে আমাদের কথা শোনো। তুমি ঘরে থাকো। এই সময়টায় কোনো আত্মীয়ের বাসায় যেনো, বন্ধুর বাসায়ও না।’
লেখক: শওগাত আলী সাগর, নতুনদেশ এর প্রধান সম্পাদক।