Home কানাডা খবর টরন্টো ফিল্ম ফোরাম-এর আয়োজনে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত-কে স্মরণ

টরন্টো ফিল্ম ফোরাম-এর আয়োজনে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত-কে স্মরণ

গত ২৮শে আগস্ট, শুক্রবার সন্ধ্যায় টরন্টো ফিল্ম ফোরামের ৩০০০ ড্যানফোর্থ, টরন্টো’র কার্যালয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল (অবঃ) চিত্তরঞ্জন দত্ত (সি আর দত্ত), বীর উত্তম-এর প্রয়াণ উপলক্ষে এক স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উল্লেখ্য, সি আর দত্ত গত ২৪শে আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার এক হাসপাতালে ৯৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সি আর দত্ত ১৯২৭ সালের ১লা জানুয়ারী পিতা পুলিশ অফিসার উপেন্দ্র চন্দ্র দত্তের কর্মস্থল অবিভক্ত ভারতের আসামের রাজধানী শিলং শহরে এ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়ী বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায়। সি আর দত্ত শিলং এর লাবান সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়, হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়, কলকাতার আশুতোষ কলেজ এবং খুলনার বি এল কলেজে পড়াশুনা করেন। ১৯৫১ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে যোগ দেন এবং ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে কোম্পানী কমান্ডার হিসেবে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেন এবং ৪ নম্বর সেক্টরের কমান্ডারের হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে সি আর দত্ত রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে যোগ দেন এবং বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী গড়ে তোলার জন্য তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ রাইফেলস (বর্তমানে বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ) গঠিত হলে তিনি প্রথম মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট এবং ১৯৭৯ সালে বিআরটিসি (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন)’র চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

সি আর দত্ত ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। আজীবন সৎ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধের রুখে দাঁড়ানো সি আর দত্ত স্বাধীন বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের চার মূল নীতির প্রতি সব সময় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং ১৯৮৮ সালের রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’ ঘোষিত হলে এর সরব প্রতিবাদ জানান। সংখ্যালঘু মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য সি আর দত্ত আজীবন লড়াই চালিয়ে গেছেন।

টরন্টো ফিল্ম ফোরাম আয়োজিত স্মরণ অনুষ্ঠানের শুরুতে চলচ্চিত্র শিক্ষক ও লেখক গাস্ত রোবেজ, সাংবাদিক রাহাত খান এবং সি আর দত্ত’র উপর এনায়েত করিম বাবুল সম্পাদিত একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। স্মরণ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন টরন্টোতে বসবাসরত সি আর দত্তের কন্যা ব্যারিস্টার চয়নিকা দত্ত, সি আর দত্তের জামাতা মুক্তিযোদ্ধা রনী প্রেন্টিস রয়, সাংবাদিক শেখ শাহনওয়াজ ও কবি দেলওয়ার এলাহী এবং উপস্থিত ছিলেন ৪ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা এম আর জাহাংগীর।

চয়নিকা দত্ত তাঁর আলোচনায় তাঁর পিতার দৈনন্দিন সাধারণ জীবনের কথা তুলে ধরেন। আজীবন সততা ও কষ্টের মাধ্যমে জীবন তৈরি করার গভীর অনুপ্রেরণা সি আর দত্ত তাঁর সন্তানদের হৃদয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। চয়নিকা দত্ত বলেন, সি আর দত্ত’র সন্তান হিসেবে তিনি সব সময় গর্ব বোধ করেন যিনি একাধারে সংসার ও দেশের জন্য আলো এনে দিয়েছেন এবং মানুষের হ্রদয়ের ভালোবাসা অর্জন করেছেন। তিনি আরো বলেন, সি আর দত্ত এমন একজন মানুষ যিনি বাংলাদেশ সৃষ্টির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন এবং যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবেন।

রনী প্রেন্টিস রয় তাঁর আলোচনায় উল্লেখ করেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নিজে ৪ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করার সময় সি আর দত্ত’কে একজন দক্ষ ও অনুপ্রেরণাদায়ী কমান্ডার হিসেবে পেয়েছেন যিনি খুব সহজেই যোদ্ধাদের মনোবলকে অটুট রেখে যুদ্ধ জয় করার জন্য তৈরি করতে পারতেন। তিনি আরো উল্লেখ করেন, তাঁর জামাতা হবার পর তাঁর সাথে এক সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যা ছিল পরম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার। রনী প্রেন্টিস রয় সি আর দত্ত’র নির্লোভ জীবনের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এ অবস্থিত তাঁর বাড়ীটি তিনি অনেক আগে ক্রয় করেছিলেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ঢাকা শহরে জায়গা দিয়ে চাইলে নিজের একটি থাকার জায়গা আছে বলে সেটা তিনি আর গ্রহণ করেন নি। সি আর দত্ত আজীবন সৎ থেকেছেন এবং প্রাণ থেকে চেয়েছিলেন দেশ ও মানুষের সার্বিক উন্নয়ন করতে।

টরন্টো ফিল্ম ফোরামের কার্যনির্বাহী সদস্য সাংবাদিক শেখ শাহনওয়াজ তাঁর বক্তব্যে সি আর দত্তের শিক্ষা ও কর্মময় জীবনের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সি আর দত্ত এমন এক আদর্শ মানুষের প্রতীক যিনি যুগে যুগে নতুন প্রজন্মের কাছে অনুসরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি আরো বলেন, সি আর দত্তের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ চিরদিন ঋণী হয়ে থাকবেন তাঁর সময়োচিত কাজ আর পদক্ষেপের জন্য।

টরন্টো ফিল্ম ফোরামের প্রকাশনা সম্পাদক কবি দেলওয়ার এলাহী সি আর দত্তের প্রতি সম্মান জানাতে গিয়ে উল্লেখ করেন, তিনি বাংলাদেশের এমন এক মহাপ্রাণ যিনি মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন লড়াই চালিয়ে গেছেন। কবি এলাহী উল্লেখ করেন, এই মহাপ্রাণের দীর্ঘ বর্ণিল জীবনকে আমাদের সব সময় উদযাপন করা প্রয়োজন। তাঁর দেহগত প্রয়াণ কখনও বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতি থেকে তাঁকে মুছে ফেলতে পারবে না। তিনি আজীবন মানুষের হৃদয়ে অম্লান হয়ে জেগে থাকবেন।

টরন্টো ফিল্ম ফোরামের সভাপতি এনায়েত করিম বাবুলের সভাপতিত্বে এই স্মরণ অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন টরন্টো ফিল্ম ফোরামের কার্যনির্বাহী সদস্য সোলাইমান তালুত রবিন।

Exit mobile version