সোনা কান্তি বড়ুয়া : জন্মভূমি বাংলাদেশ থেকে সহস্রাব্দের পারঘাটে দাঁড়িয়ে দেখি এখনও বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে কানাডা সবচেয়ে কাঙ্খিত দেশ। টরন্টোতে হাজার হাজার বাঙালীর বাস এখানে, সেখানে গড়ে উঠেছে ভিক্টোরিয়া সাবওয়ে এবং মেইন ষ্ট্রীট সাবওয়েকে ঘিরে ড্যানফোর্থের মিনি বাংলাদেশ ও বাংলাবাজার। বদলে যাচ্ছে ড্যানফোর্থ, স্বাগতম প্রবাসী বাঙালীরা। আসা যাবার পথে পথে বাংলা গানের সুর ভেসে আসে। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জোড়কলম শব্দটা বাংলাদেশে বসে যে ভাবে চোখের সামনে ভাসে, সেই অক্ষদ্রাঘিমা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে বসে তার আদলটা বোঝা অত সহজ কাজ নয়। বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু আজকাল ড্যানফোর্থের বাংলা নাটক ও সিনেমার ভিডিওতে বিরাজমান। সবাই বলাবলি করছেন, “এইবার যুদ্ধাপরাধীরা ফেঁসে গেছে। জাতীয় মীরজাফর ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন ছাড়া দেশে আর ও সাহেব বিবি গোলাম বিরাজমান। দেশপ্রেমিক মরহুম তোফাজ্জল হোসেনের সুপুুত্র মইনুল কেন যে জামায়াতের সঙ্গদোষে কুলাঙ্গার হয়ে তার নিজের বদনাম ছড়ায়। সুপুত্র হয় রাখে বাপের নাম। মইনুল তার বাপের বংশের কুপুত্র হয়ে জামায়াতের পিছে পিছে ঘুরে ঘুরে রাজাকারের দলে চলে গেলি কেন? ছি:! মইনুল ছি:। তোফাজ্জল হোসেন সাহেবের ছেলে হয়ে তোর কি লজ্জা শরমের বালাই নেই?”
আমাদের কমিউনিটিতে একতা না থাকলেও অনেক সমিতি আছে। মন্দির ও মসজিদ আছে। নাচের ও গানের স্কুল আছে। আছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, রাজনীতির কেডার, উকিল, মৌলবী, পুরোহিত, গায়ক, গায়িকা, ধনী-গরীব, ব্যবসায়ী, দালাল, সাংবাদিক, লেখক-লেখিকা, শিল্পী, কবি, ধ্যানী, জ্ঞানী মানুষ। সব রকমের মানুষের জীবনটাই প্রতিযোগীতা বা রেসের মাঠ। তা সেই রেসের মাঠে লাল পরীর পাশে নীল পরীও যদি দৌড়াতে চায় ক্ষতি কি? আঁধার আলোর সাথে যদি দৌড়াতে চায় কী অন্যায় আছে? আসলে যে যার নিজের দৌড়টাই তো দৌড়ায়। এ দৌড় বেঁচে থাকার দৌড়। বেঁচে থাকার জন্যে দৌড়ানোর পর জীবন সায়াহ্নে এসে জনৈক বন্ধুর মুখে শুনি, “ঢাকা শহরের মতো টরন্টো শহরের রংবাজারে রঙের বেচাকেনার নানা রুপ দেখে এলাম। ছেলে মেয়েদেরকে ভালভাবে মানুষ করতে কানাডায় এসেছিলাম। কিন্তু তারা তো মানুষ হয়েছে, আমরা বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তো সিনিয়ার সিটিজেন বিল্ডিং এ রোগে শোকে জর্জরিত হচ্ছি।”
নতুন বা পুরানো প্রজন্মদের মধ্যে এখানে অনেকেই এখন চোখ বেঁধে ছুটে চলেছে। কাল পরীক্ষিত সমস্ত বাঁধন, প্রচেষ্টা, নীতি আদর্শ বিসর্জিত। বিবাহবর্জিত সংসার, দায়িত্বহীন সংসার পালন। নানা রকমের দুর্ঘটনার মধ্যে সংঘাতই সঙ্গীত, অপঘাতই প্রয়াণের পথ, ধর্ম হচ্ছে আহার, নিদ্রা ও মৈথুন। নীতিবোধ না থাকলে মানুষ মানুষে সম্পর্ক হবে পশুর মতো, পারস্পরিক দংশন। কমিউনিটির মিলনায়তনে যত ধরাধরি, দড়ি টানাটানি। কয়েক বছর আগে প্রিয়াঙ্গনের এপারে ফোবানা যাবার জন্যে ছবিসহ বিজ্ঞাপনের জয়যাত্রা, ওপারে ঢাকা ষ্টোরের দেয়াল জুড়ে বাংলাদেশ উৎসবে যাবার জন্য নানা ছবিসহ বিজ্ঞাপন। দুটি উৎসবের আসন্ন একই সঙ্গে ছিল। নাচ ও গানের তিন নম্বর অনুষ্ঠানটির আসর বসেছিল ইয়র্কউড্ লাইব্রেরীতে।
বাঙালী বিশ্বে ধন্য হয়েছে সংস্কৃতির জোরে। টরন্টোয় দুটো নাটকের অভিনয় সার্থক হয়েছিল। ফতে মোল্লার লেখা “নিঃশব্দ গণহত্যা” এবং আকতার হোসেনের লেখা “আলতা বানু” দর্শকদের মন জয় করার পর ও প্রত্যেক বছর নাটকের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। “আমরা যেথায় আছি যে যেখানে,/ বাঁধন আছে প্রাণে প্রাণে।” টরন্টোতে অনেক বছর জীবন যাপন করার পরও আমরা বাংলাদেশকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারি না কেন জানেন? পৃথিবীর প্রথম আলো দেখেছি যে দেশে, সেই আমার মাতৃভূমি। অন্য প্রাণীরা বুঝতে পারে না জন্মভূমি কাকে বলে? মানুষ মরমে মরমে জানে মাতৃভূমি কেমন তরো গভীরভাবে উপলদ্ধি করার সাইকোলেজি। তাই টরন্টোর ড্যানফোর্থে আমরা আমাদের প্রয়োজনে মিনি বাংলাদেশ রচনা করে চলেছি। আজও স্মৃতির ঝাঁপিতে বিরাজমান প্রিয় বাংলাদেশ। কিন্তু চোখে ড্যানফোর্থ এবং মনে বাংলাদেশ। গত সপ্তাহে আমার শ্যালিকা অর্চনা দেবী টরন্টো বেড়াতে এসেছিলেন মায়ামী থেকে। তিনি ইলিশ মাছ ও চানাচুর দেশের গ্রোসারীগুলো ঘুরে ঘুরে কিনেছেন। অর্চনা আমাকে বললেন, “দাদা টরন্টোর ড্যানফোথের্ আসলে আমার কাছে এটা মিনি বাংলাদেশ বলে মনে হয়। কত জিনিস, কী যে কিনতে ইচ্ছা হয়। তিনটা বাংলা পত্রিকাসহ কত কি যে সংগ্রহ করে নিলুম। তবুও মনে হয় দরকারী জিনিসগুলো এখনও কেনা হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার তরী কবিতায় পড়েছি, “ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী / আমার সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।”
এই উত্তর আমেরিকার মহা জনঅরণ্যে আমাদের আগামী প্রজন্ম হারিয়ে যাবার ভয়ে আমি ভীত। তাই বাসায় আমাদের ছেলে মেয়েকে নিয়ে যথাসময়ে বাংলা ভাষা শেখাই, বাংলা গান গাই এবং ভাল বাংলা সিনেমা দেখি।” সংস্কৃতি সচেতনতা নিয়ে বাঙালীর দর্প। একাত্তরে পরাধীনতার দুঃখ সমুদ্র মন্থন করে স্বাধীনতার যে দুর্লভ অমৃত খন্ড আমরা পেলাম, তা নিয়ে আজ দেবাসুরের যুদ্ধে সব লন্ড ভন্ড হয়ে গেল। এক আকাশের নীচে অনেকের স্বপ্নে সম্মিলিত একটি হৃদয় বাংলাদেশ। বিন্দুতে সিন্ধু দর্শণের মতো আমরা ড্যানফোর্থকে মিনি বাংলাদেশ মনে করি। বাংলাদেশের সুখে দুঃখের সব ঢেউ ড্যানফোর্থে এসে লাগে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, বৌদ্ধ ভারতের অনুকরণে একদা থাইল্যান্ডে গড়ে উঠে ছিল, ব্যাঙ্কক শহর থেকে মাত্র ত্রিশ মাইল দূরে পুরানো রাজধানীর নাম অযোধ্যা। বর্তমান থাইল্যান্ডের রাজার নাম ভূমিবল অতুল্যতেজ-নবম রাম। রাজিনীর (রানী) নাম শ্রীকীর্তি। ভারতবর্ষের প্রাচীন বৌদ্ধ সংস্কৃতি অনুসারে থাইল্যান্ডে আজ রাম ও অযোধ্যা দুটোই বিরাজমান।
বাংলাদেশ আজ আর পাকিস্তানের হাতে নেই। কারও মুখ চেয়ে, আগ্রাসনবাদী সংস্কৃতির ধাক্কা খেয়ে, বশীভূত কণ্ঠে কথা বলার ধাত বাঙালীর নয়। তা যদি আমরা করি, তা হলে বাঙালীর সাংস্কৃতিক সাগর শুকিয়ে যেতে বাধ্য। নিজের সাংস্কৃতিক জাতি বৈশিষ্ঠ্য আগলে রেখে তার প্রবৃদ্ধি ঘটানোর কাজ অত্যন্ত জরুরী এই টরন্টোর প্রবাসী বাঙালী সমাজে। কোথায় তার ঘুন ধরেছে, কোথায় তার আত্ম অবহেলা, কিসে তার ভরাডুবি থেকে মুক্তি তার জন্যে আমাদের ছেলে মেয়েদেরকে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ক্রেডিট কোসের্ ভতির্ হতে উৎসাহিত করতে হবে। এই একমাত্র সুবনর্ সুযোগ। এইভাবে ভবিষ্যতে টরন্টোতে বাঙালী পাঠক ও লেখক গোষ্ঠি সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ আমাদের সেই সৃষ্টি সুখের উল-াসের অপেক্ষায় থাকবে। কানাডা-আমেরিকা সীমান্তে নায়গ্রা মহাজলপপ্রাতের উত্তাল জল তরঙ্গে কান পাতলে বাঙালিরা আজ ও শুনতে পায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বাংলার স্বাধীনতার নির্ঝরের স্বপ্নমঙ্গলের অমৃতধারা,
“ওরে উথলি উঠেছে বারি
ওরে প্রাণের বাসনা প্রানের আবেগ
রুধিয়া রাখিতে নারি।
খর খর করি কাঁপিছে ভধুর শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে,
ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল গরজি উঠিছে দারুণ রোষে।
হেথায় হোথায় পাগলের প্রায় ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায় বাহিরিতে চায়,
দেখিতে নব পায় কোথায় কারার দ্বার।
কেন রে বিধাতা পাষাণ হেন, চারিদিকে তার বাঁধন কেন।
ভাঙরে হৃদয়, ভাঙরে বাঁধন, সাধরে আজিকে প্রানের সাধন,
লহরীর পরে লহরী তুলিয়া আঘাতের পরে আঘাত কর।
মাতিয়া যখন উঠেছে পরান কিসের আঁধার, কিসের পাষাণ।
উথলি যখন উঠেছে বাসনা জগতে তখন কিসের ডর।”
সগৌরবে বিজয় দিবস পালনের দিনে দেশে বিদেশের বাঙালির কন্ঠে ধ্বনিত হয় ”জয় বাংলা।”
লেখক সোনা কান্তি (Bachelor of Arts, University of Toronto) সাবেক সভাপতি, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, টরন্টো, খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, কথাশিল্পী, বিবিধগ্রন্থ প্রনেতা প্রবাসী কলামিষ্ঠ, লাইব্রেরীয়ান, বিশ্ববৌদ্ধ সৌভ্রতৃত্ব পত্রিকার সহ সম্পাদক এবং জাতিসংঘে বিশ্ববৌদ্ধ প্রতিনিধি।